সম্প্রতি যোশীমঠের ভূমি বিপর্যয়ের ধবংসাত্মক কারণ হিসাবে বিভিন্ন তথ্য উঠে আসছে৷ একটি দিক অনেকে বিশেষজ্ঞের নজর এড়িয়ে গেলেও সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই বিপর্যয়ের৷ সেটি হল হিমালয়ের বুকে পর্যটকদের বিশাল চাপ৷ ভ্রমণ এখন আর প্রকৃতি পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য নয় বরং ভ্রমণ এখন বিলাস-ব্যসনে পরিণত হয়েছে৷ ভ্রমণ বিলাসী পর্যটকদের বেলাগাম আচরণ ও ব্যবহার প্রকৃতিকে ভিতরে ভিতরে একটু একটু করে ক্ষয় করে দিচ্ছে৷ উত্তরে অলকানন্দা, দক্ষিণে ধৌলিগঙ্গা, পূর্বে ঢাকনালা, করমনসা নদী বেষ্টিত পাহাড়ের খাড়া ঢালে স্থিত যোশীমঠ, অতিবিপজ্জনক ভূ-কম্প প্রবণ এলাকা৷ এতসব বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য নিয়েই যোশীমঠ দেবভূমির প্রবেশদ্বার৷ এই পথ যুগ যুগ ধরে তীর্থযাত্রীদের স্বাগত জানিয়েছে বদ্রীনাথ, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, হেমকুণ্ডু সাহিব,আদি শংকরাচার্য পীঠ মন্দির যাত্রাপথে৷ অগণিত ভ্রমণ পিপাসুদের আশ মিটিয়েছে ভ্রমণ লেখক শঙ্কু মহারাজ, প্রবোধ কুমার সান্যাল প্রমুখদের ভ্রমণকাহিনী থেকে৷ যারা মনে করত এপথ হল ত্যাগ-তিতিক্ষার, কষ্ট স্বীকারের৷ যারা ফুর্ত্তি বা বিলাস-ব্যসনের জন্য আসত এ পথ তাদের জন্য নয়৷ এ পথ সব পথিকদের জন্য নয়৷ যারা নির্জনতার মধ্যে ঈশ্বরের পরশ অনুভব করত৷ তাই তারা হত বিনম্র ও শ্রদ্ধালু৷ কয়েক দশক আগেও হিমালয় ভ্রমণপিপাসুদের এই মনোভাব ছিল৷ এখন ভোগবাদের করাল গহ্বরে যা তলিয়ে গেছে৷
কালক্রমে সরকার অতিরিক্ত আয়ের লোভে মৌন হিমালয় ভ্রমণকে কোলাহল মুখর পর্যটন শিল্পে পরিণত করে ফেলল৷ তাই যে পথ সবার জন্য ছিল না, সে পথে সবাইকে পৌঁছে দিতে, ভ্রমনকে আরও সুখকর ও আরামদায়ক করার লক্ষ্যে একে একে এসে গেল ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর৷ ভ্রমণ বিলাস থেকে ব্যসনও এসে গেল৷ এককালে ভ্রমণপিপাসুদের হোল্ড অল, স্টোভ, রসদের রেশন নিয়ে দীর্ঘ পদযাত্রা বাতিল হল৷ সরকারী মদতে পরিবেশের নিয়ম কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিলাসী পর্যটক টানতে যেখানে সেখানে হোটেল, রিসর্ট ইত্যাদি গড়ে উঠল৷ ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল সরাইখানা চটি, ধর্মশালা প্রভৃতি৷ এককালে যারা ছিল ভ্রমণপিপাসু এখন তাদের পরিবর্ত্তে নব্যপ্রজন্মের ভ্রমণবিলাসীদের দীর্ঘ যাত্রাপথের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে উত্তরাখণ্ড সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনায় দুর্গম চারধাম যাত্রাকে সুগম করার লক্ষ্য নিল৷ এশিয়ার উচ্চতম ও দীর্ঘতম চারধাম প্রকল্পের মসৃন রাস্তায় ভিড় জমাল ভ্রমণ বিলাসী ট্যুরিষ্ট৷ তীর্থযাত্রীদের কাঁধঝোলা কাঁখে পুটুলি নিয়ে, চড়াই, উৎরাই, পাকদণ্ডি বেয়ে হাঁফ ধরে গেলে চটিতে জিরিয়ে নেওয়া নয়, একালের ভ্রমণ বিলাসী ট্যুরিষ্টদের জন্য চাই ঝা চকচকে মসৃন রাজপথ৷ তাই তাদের জন্য মাইন বিস্ফোরণ করে ভার্জিন পাহাড় ফাটিয়ে তৈরী হচ্ছে রাজপথ৷ পাহাড়ের বুক চিরে দেবতাত্মা হিমালয়ের মৌনতা আদিমতাকে ধবংস করে৷ নোতুন প্রজন্মের পর্যটকদের অপর্যাপ্ত বিদ্যতের যোগান দিতে তৈরী হচ্ছে পাহাড়ের নীচে সুড়ঙ্গ করে বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প৷ দুর্গম হিমালয়ের বুকে একদা লুকিয়ে থাকা নির্জন তীর্থক্ষেত্রগুলি এই নব্য ভ্রমণবিলাসী পর্যটকদের কলরবে ভঙ্গ হবে হিমালয়ের মৌনতা৷ উত্তরাখণ্ডের দেবভূমি নিয়ে সরকারের অপরিনামদর্শী ও অবিবেচনা প্রসূত পরিকল্পনা ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনছে গোটা হিমালয়ে৷ এর অনিবার্যপরিণতি স্বখাদসলিলে ধবংস৷ ‘যোশীমঠের বিপর্যয় একটা অশনি সংকেত৷ তাই হিমালয়কে বাঁচাতে হলে প্রকৃতি পরিবেশের (হিমালয়ের পাহাড়, ঝরণা, জলপ্রপাত জঙ্গল সমন্বিত) ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে৷