ভারতে বাংলা ভাষা অবলুপ্তির পথে–বাঙালী উদাসীন

লেখক
সঞ্জীব বিশ্বাস

 

যে জাতি তার নিজের ভাষা সংস্কৃতিকে লোভ ও লাভের মোহে নিরাপত্তা দেয় না, অথবা উক্ত সম্পদকে আগলে রাখতে হীনন্মন্যতায় ভোগে, এই জাতির ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা জানতে হলে অবশ্যই বিশ্ব–ইতিহাসের সাহায্য নিতে হবে৷ যেমন আজকের মধ্যপ্রাচ্যের ‘কুর্দ’ জাতির পরিণতির কথা আমরা স্মরণ করতেই পারি৷ কিন্তু আলোচ্য বিষয় হতে পারে এই যে শত বছর পার করে এই জাতি গোষ্ঠীর বুদ্ধির মুক্তি ঘটলেও অতীতের দিনগুলি যে ফিরে পাবে না তা নিশ্চিত বা শাক্যমা জাতি তথা চাকমা জনগোষ্ঠীর কথা বলা যেতে পারে৷ ইতিহাস বলছে তারা আদিম বাঙালী জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বা আদি পিতা বলা যায়৷ কিন্তু প্রশ্ণ আসছে আজ কি এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা দাবী করতে পারবে আগের জায়গায় ফিরে যাব অথবা দাবী করলেই আজকের পোষাকী বাঙালীরা তাদের সমাজে স্থান দিতে যাবে কেন

বস্তুত আজ মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দরা উপজাতি, অন্যদিকে ভারত উপমহাদেশে শাক্যমা তথা চাকমারাও উপজাতি হিসাবে পরিচিত৷ এই পরিণতির জন্যে জাতি বা গোষ্ঠীগত অপকর্মকেই দায়ী বলে ধরে নিতে হবে৷ ইরাকে প্রাক্তন শাসক সাদ্দাম হোসেনের শাসনকালে প্রথা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কুর্দদের উপর চরম অত্যাচার ও নির্যাতন করা৷ আকাশ পথে বোমা ও স্থলে সেনা পাঠিয়ে বিতাড়ন ও হত্যার সঙ্গে নারীদের উপর চরম অমর্যাদাকর অত্যাচার করাই ছিল রাষ্ট্রীয় নীতি৷ বলতে গেলে জল, জমি ছাড়া আত্মমর্যাদাহীন জনগোষ্ঠীর প্রতি এটাই ছিল রাষ্ট্রীয় উপহার৷ অপর দিকে শাক্যমা তথা চাকমারাও একই অবস্থার শিকার৷ এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে এই যে, চাকমারা অত্যাচারিত হচ্ছে ইসলাম ধর্মী বাঙালীদের হাতে৷ অথচ প্রকৃত ইতিহাস পাঠক যদি থেকে থাকেন তবে তিনি অবশ্যই লক্ষ্য করে থাকবেন এই অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখে কোন দিনই এই সম্প্রদায়কে পড়তে হত না যদি বাঙালী হিন্দু নেতৃত্ব জওহরলাল নেহেরুর পদসেবক না হয়ে বাস্তবধর্মী হত৷

অপরদিকে বিকৃত মনস্তত্ত্বের কারণেই ভারতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাঙালী জনগোষ্ঠীকে এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে৷ অথচ নেতা ও জনতা যার যার বৈয়ষ্টিক স্বার্থ পুর্ত্তির লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, বিশ্বাসঘাতকতা ও মিথ্যাচারের মতো জঘন্য পথে ঘুরপাক খাচ্ছে৷ কেউই স্বার্থের বাইরে এসে জাতি, সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি, বা জল–জমি রক্ষায় নেই৷ অথচ এই সামাজিক অবক্ষয়ের আবহে রাজ্যের নেতা ও জনতা সত্যের মুখোমুখি হলে শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, ভারতে বাঙালীরা পুনরায় ‘আত্মমর্যাদা’ নিয়ে উঠে দাঁড়াবার প্রাণশক্তি ফিরে পেত৷ কিন্তু অনুতাপের বিষয়, লোভ, লাভ ও লালসাকে পরিত্যাগ করে জাতির জন্যে নেতৃত্ব দেওয়ার লোক সমাজে খঁজে পাচ্ছে না বলেই ভাষা, সংস্কৃতি ছেড়ে বাঙালীরা হিন্দি সংস্কৃতির আড়ালে আত্মগোপন করে বাঁচতে চাইছে৷ কিন্তু জমি, জল, ভাষা, সংস্কৃতি হারা আত্মমর্যাদাহীন জাতিগোষ্ঠী বাঁচতে চাইলেই তাদেরকে মানুষের মতো বাঁচতে দেবার এমন দায়বদ্ধতা হিন্দিভাষী জনগণ নেবে কেন পরিবর্তে পদদলিত হয়েই বাঁচতে হবে৷ এই মর্ম কথাই বিশ্ব ইতিহাস থেকে জানা যায়৷ সম্প্রতি ডঃ মুকুন্দ মজুমদারের লেখা একটি প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে নজরে এল, আন্তর্জাতিক ভাষা সমীক্ষার মর্মবাণীটি৷ ওই সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে চলতি শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের পাঁচটি ভাষা অবলুপ্তির পথে যে চলেছে৷ উক্ত পাঁচটি ভাষার মধ্যে অন্যতম ঘটনা হচ্ছে ভারতে বাংলা ভাষার অবলুপ্তি৷ এই তথ্য জানার পর মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল৷ প্রশ্ণ এল, বিশ্ব–সাহিত্যে সুপরিচিত বাংলার সংস্কতি নিয়ে বিতর্ক চালাবার কোনও মঞ্চ থাকবে না পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতে বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চলে৷ কারণ বাংলা ভাষার বিলুপ্তি ঘটলে কে বিতর্কে যোগ দিতে যাবে আজ যেমন বিহার ও ঝাড়খণ্ডে বাংলা ভাষার বিলুপ্তি ঘটেছে৷ অথচ এই বিহারের বাংলা ভাষী অঞ্চলে একদিন বাংলা সাহিত্যের জমাটি আসর বসত৷ জন্ম হত নিত্য নতুন সাহিত্যিকের৷ কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৭৭ বছরের মধ্যে শুধু রাষ্ট্রীয় চাপে বিহার থেকে বাংলা ভাষা উধাও হলেও এর জন্যে বাঙালী নেতৃত্বকে প্রতিবাদী হতে কোন দিন শোনা যায়নি৷ এমতাবস্থায় প্রশ্ণ আসছে বিহার ও অধুনা ঝাড়খণ্ডের বাঙালীদের মাতৃভাষার প্রতি বিরূপ আচরণ দেখেই কি আন্তর্জাতিক সমীক্ষক দল এই সিদ্ধান্তে গেলেন যে, ভারতে বাংলা ভাষার দিন শেষ হতে চলেছে তাদের নজরে বাংলা ভাষী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ কি ধরা পড়েনি বলতে কি সমীক্ষক দলের নজরে ধরা পরেছে পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও৷ তাই তারা দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করতে পেরেছেন ভারতে বাংলা ভাষার দিন যে শেষ হতে চলেছে৷ সমীক্ষকদের নজর এড়ায়নি বাংলাভাষী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায় যে নিজের মাতৃভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা ও মমত্ব বোধহীন আচরণ করে থাকে৷ (দুই) সমীক্ষকরা প্রত্যক্ষ করেছেন, উক্ত বাংলা ভাষী সম্প্রদায় সজ্ঞানে উদাসীন থেকে দীর্ঘ বছর ধরে রাজ্যের অভ্যন্তরে যেমন, তেমনই বর্হিবঙ্গের বাঙালী অধ্যুষিত রাজ্যে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে যে আসছে৷ (তিন) রাজ্যের অভ্যন্তরে তথাকথিত জাতীয় ঐক্য ও সংহতির নামে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে পদদলিত করে হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতি যাতে প্রতিষ্ঠা পায় তার জন্যে এক বিরাট সংখ্যক বাঙালী দালালি করে যে বেড়াচ্ছে৷ এই দালাল শ্রেণীর সম্মিলিত উল্লেখযোগ্য সংঘটনটির নাম হচ্ছে ‘নাগরিক কল্যাণ পরিষদ’৷ ১৯৯৩ সালে ১৩ জুন পত্রিকার বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছিল, ওই দালাল চক্রটির সভাপতি, ‘কিশোর চ্যাটার্জি’ এই বলে রাজ্যবাসীর কাছে আবেদন রাখেন যে, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি বিরোধী মনোভাব প্রকাশ পেলে অবশিষ্ট ভারতে বাঙালীরা অসুবিধায় পড়বে৷ অর্থাৎ বাঙালী দালালদের মতে বাংলা ভাষীরা যত শীঘ্র মাতৃভাষা ছেড়ে হিন্দি ভাষা রপ্ত করতে পারবেন ততই মঙ্গল সাধিত হবে৷ (চার) বাঙালী দালালরা হিন্দি প্রচার সমিতি গড়ে জেলা, মহকুমা এমন কি ব্লক শহরগুলিতে পর্যন্ত প্রচারাভিযান যে চালাচ্ছে সেই খবর সমীক্ষকদের নজরে এসেছে বলে বিশ্বাস৷ (পাঁচ) রাজ্যের এক শ্রেণী বাঙালীর সমর্থন ও সহযোগিতায় রাজ্যের অভ্যন্তরে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত সংস্থা ব্যাঙ্ক, রেল, ডাকবিভাগ, কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, আয়কর বিভাগ প্রভৃতি সংস্থা গুলি তো বটেই, এমন কি ছোটকা ব্যবসায়ী সংস্থা যা হিন্দিভাষী পরিচালিত, সেখানেও রাজ্য–ভাষা বাংলাকে প্রবেশাধিকার দেওয়ার পরিবর্তে হিন্দিকে প্রধান কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ (ছয়) হিন্দির প্রতি বাংলা ভাষীদের অন্ধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা থাকায় এখন পর্যন্ত এমন কোন বাঙালীর দেখা মেলেনি যিনি হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে জানতে চেয়েছেন, রাজ্যের ভাষাকে অপসারিত করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে রাজ্যের ‘স্বাধিকার’ নীতি কেন্দ্রীয় সরকার অমান্য করেছে কিনা এই প্রবন্ধে বিষয়টা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে, কিন্তু পাঠক বৃন্দের অবগতির জন্যে একটি তথ্য তুলে ধরা একান্ত কর্তব্য বলে মনে করি৷ কারণ প্রাক্তন কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার গুজরাতি ভাষাকে অপসারিত করে সেরাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের অনুরূপ হিন্দি ভাষা চাপাতে গেলে গুজরাতিরা ২০১০ সাল ও ২০১২ সালে হাইকোর্টে দুটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে জানতে চায় এই প্রচেষ্টা বৈধ না অবৈধ উত্তরে একটি মামলায় হাইকোর্ট রাজ্যবাসীকে জানিয়ে দেয় ‘হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয়৷ ভারতে রাস্ট্রভাষা নেই’৷ অন্যটিতে হাইকোর্ট জানায় যে, ‘হিন্দি গুজরাতি জনসাধারণের কাছে বিদেশী ভাষা’৷ এতে হল কি, বাংলা ভাষী রাজ্যের মতো স্থানীয় হিন্দি সমর্থক ও অন্ধ ভক্ত তথা দালাল না পাওয়ায় গুজরাতি ভাষাকে অপসারিত করে হিন্দিকে চাপানো সম্ভব হল না৷ এমতাবস্থায় যে প্রশ্ণের উদ্ভব হচ্ছে তা হল পশ্চিমবঙ্গের হিন্দি প্রেমী তথা ভক্ত বাঙালীরা কি বলতে যাবেন হিন্দির বিরোধিতা করে গুজরাতি জনগণ ভারতীয় ঐক্য ও সংহতির বিপদ ডেকে আনছেন দ্বিতীয় প্রশ্ণ আসছে, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে দাঁড়িয়ে আপনারাই বলেছেন, হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতি হচ্ছে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রতীক, তার যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ গুজরাতিদের সম্মুখে তুলে ধরে বুঝিয়ে দিন, হিন্দির বিরোধীতা করে তারা যে দেশের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দিচ্ছে৷ তৃতীয় প্রশ্ণ আসছে গুজরাত হাইকোর্ট যে বলছে, হিন্দি হচ্ছে গুজরাতিদের জন্যে ‘বিদেশী ভাষা’, তার জন্যে পশ্চিমবঙ্গের দালাল বাঙালীরা উচ্চতর আদালতে গিয়ে চ্যালেঞ্জ জানাক এই যে, গুজরাত হাইকোর্ট হিন্দি ভাষাকে গুজরাতিদের কাছে বিদেশী ভাষা বলার আইনগত অধিকার আছে কিনা এর উত্তর দিক৷

তবে একটা আত্মপ্রবঞ্চক কাপুরুষ জাতিসত্ত্বাকে বিভ্রান্ত করে লুঠেপুটে খাওয়া যত সহজ, ততই কঠিন কাজ হচ্ছে জাতি অস্মিতা জনগোষ্ঠীকে বিপথগামী করা৷ এখানেই একটি জাতি অস্মিতা জনগোষ্ঠী ও আত্মপ্রবঞ্চক বাঙালী জনগোষ্ঠীর পার্থক্য সূচিত হয়৷ এখানেই প্রমাণ হয় একটা আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জনগোষ্ঠীর মৌলিকত্বে আত্মপ্রবঞ্চক জনগোষ্ঠীর পার্থক্য কোথায়৷ (ক্রমশঃ)