সমাজচক্রের গতি যখন শ্লথ হয়ে পড়ে তখন সমাজদেহে দেখা দেয় নানা আবিলতা-পঙ্কিলতা৷ তাতে সমাজচক্রের গতি যখন রুদ্ধ হয়ে যায় এইরকম সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে যুগসন্ধিতে আবির্ভাব হয় যুগপুরুসের৷ তারকব্রহ্ম নামে তিনি পরিচিত হন সমাজে৷ ধর্ম-সংস্থাপনার ব্রতই তার মূলমন্ত্র৷ ইতিহাসে দেখা গেছে আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর আগে যুগপুরুষ তারকব্রহ্ম ‘সদাশিব’রূপে মানুষের সমাজে আবির্ভূত হয়েছিলেন৷ সে যুগেও তিনি পাপ শক্তির নানা বাধা-বিপত্তি ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন৷ পুরাণের গল্প অনুযায়ী সদাশিব সৃষ্টিকে রক্ষা করতে গরল পান করে হয়েছিলেন নীলকন্ঠ৷
প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয় মথুরায় তার মামা কংসের কারাগারে৷ জন্মের পরই তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিল অত্যাচারী কংস৷ কিন্তু যিনি স্বয়ং জীবের পরিত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন তাকে কে মারবে? সেদিন কংগ্রেসের কারাগারের লৌহ শৃঙ্খল যুগপুরুষের মহান সংকল্পকে শৃঙ্খলিত করতে পারেনি৷
ঠিক তেমনি এ যুগের যুগপুরুষ তারকব্রহ্ম শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী অধ্যাত্মভিত্তিক এক অখণ্ড বিশ্বমানব পরিবার গড়ার লক্ষ্যে মানবসমাজকে উপহার দিয়েছেন এক পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যেমন ছিল সুদর্শনচক্র৷ ঠিক তেমনি আনন্দমূর্ত্তিজীর সুদর্শন হল প্রাউট৷ কৃষ্ণের সুদর্শনচক্রকে রোখার ক্ষমতা যেমন মহাভারতের যুগে কারও ছিল না তেমনি এ যুগের ‘সুদর্শন’ প্রাউটকে রোখার ক্ষমতা বিশ্বের কোন ব্যষ্টির, গোষ্ঠীর বা রাষ্ট্রের নেই৷ বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কমিউনিজম যখন মধ্যগগনে সেই সময় ১৯৫৯ সালে প্রাউট দর্শনের আবির্ভাব হয়৷ তৎকালীন কমিউনিজমের পিতৃভূমি সোভিয়েত ইউনিয়ন এ কমিউনিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা প্রাউট দর্শনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কোন ত্রুটি বিচ্যুতি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন৷ ফলে সারা বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীত হয়ে পড়েন ক্রেমলিনের শাসকরা৷ তাদের অঙ্গুলি হেলনে ছদ্মবেশী কমিউনিষ্ট তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী সিবিআই এর মাধ্যমে হীন ষড়যন্ত্র করে ৰাৰা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী গ্রেপ্তার করান৷ সিবিআইকে দিয়ে তাকে অশেষ নির্যাতন করেও প্রাউট দর্শনকে প্রত্যাহার করাতে পারেননি৷ শেষে ১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী তাকে ভয়ানক বিষপ্রয়োগ করে মেরে ফেলার চক্রান্ত করে সিবিআই৷ কিন্তু সেই বিষ আনন্দমূর্ত্তিজী হজম করে ফেলেন৷ পরে তার প্রতি বিষ প্রয়োগের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবীতে শুরু করেন অনশন৷ জেল কর্ত্তৃপক্ষ যাতে তাকে জোর করে অনশন ভঙ্গ করাতে না পারে তা এড়াতে দিনে মাত্র দু কাপ ঘোল খেতেন৷ মিথ্যা বিচারের নামে প্রহসন করে আনন্দমূর্ত্তিজীকে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা দেওয়া হয়৷ এর প্রতিবাদে তিনি ১৯৭৩ সাল থেকে ৫ বছর ৪ মাস ২দিন অনশন করেন৷ ১৯৭৮ সালে নির্বাচনে ইন্দিরা সরকারের পতন হয় ও জনতা সরকার ঘটিত হয়৷ জনতা সরকারের আমলে আনন্দমূর্ত্তিজীর যাবজ্জীবন কারাবাসের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পুনরায় শুনানী শুরুর আবেদন জানানো হলে তা সরকার কর্ত্তৃক অনুমোদিত হয় ও শেষে পটনা হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায়ে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সম্পূর্ণ নির্র্দেষ প্রমাণিত হন৷ অবশেষে ১৯৭৮ সালের ২রা আগষ্ট হাইকোর্টের নির্দেশে বাঁকীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে পরমারাধ্য ৰাৰার ছাড়া পাওয়ার দিন ঠিক করেন জেল কর্ত্তৃপক্ষ৷
তখন আমি সন্ন্যাসী হইনি, ছাত্র ছিলুম৷ ১৯৭৮ সালে দু-দুবার পটনায় বাঁকীপুর সেন্ট্রাল জেলে ও বাইরেগুরুদর্শনের বিরল সৌভাগ্য হয়৷ প্রথমবার ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে বাঁকীপুর সেন্ট্রাল জেলে গুরুর সঙ্গে আমার ‘গ্রুপকনট্যাক্ট’ হয়৷ এর কয়েকমাস পরই অগাষ্টে জেলমুক্ত ৰাৰাকে পুনরায় সন্দর্শনের মহা সৌভাগ্য লাভ করলাম৷ ১৯৭৮ সালের ২রা আগষ্ট আক্ষরিক অর্থেই ছিল এক ঐতিহাসিক দিন৷ সেদিন আমার লৌকিক স্থানের মার্গীরা ছাড়াও অনেক নন-মার্গীও ২রা আগষ্টের ঐতিহাসিক দিনে যোগ দিয়েছিল৷ বাঁকীপুর সেন্ট্রাল জেলের সামনে বেলা দশটায় পৌঁছে দেখলুম সেখানে তখন জনসমুদ্র৷ পটনা শহরের রাস্তায় রাস্তায় দুইদিকে বাড়ীর বারান্দা ছাদ যেদিকে তাকাই শুধু অগণিত মানুষের মাথা দেখা যাচ্ছিল৷ দেশ বিদেশ থেকে আনন্দমার্গের হাজার হাজার ভক্ত সহ অসংখ্য নন-মার্গীও সেদিন সেই সমাবেশে সামিল হয়েছিল৷ গোটা পটনা শহরের লোক ভেঙ্গে পড়েছিল সেই সমাবেশে৷ পরমারাধ্য ৰাৰার এই ঐতিহাসিক জেলমুক্তির ক্ষণটির স্বচক্ষে দেখতে তথা সাক্ষী থাকতে দেশ বিদেশ থেকে অনেক ভক্ত সুসজ্জিত ঘোড়া ও হাতি নিয়ে এই শোভাযাত্রায় যোগ দিয়েছিল৷ সেই বিশাল জনসমারোহে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের ইয়ূনিটের মার্গীরা পতাকা, ফেসটুন, প্যাকার্ড নিয়ে এসেছিল৷ ছিল ঢোল, তাসা ও ব্যাণ্ডের রকমারি বাজনা৷ জেলের সামনের গেট থেকে দুই সারিতে ভক্তরা দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রতিজনের পিছনে অন্তত দশজন করে৷ মাঝখানে ৰাৰার গাড়ী যাওয়ার রাস্তা খালি রাখতে বিশাল দেহী ভি.এস.এস পোশাক পরিহিত স্বেচ্ছাসেবীরা চেষ্টা করছেন৷ সবার মুখে ৰাৰা নাম কেবলম্ কীর্ত্তন, শ্লোগান, সবার হাতে ফুল,মালা৷ প্রকৃত অর্থে এই বর্ণাঢ্য সমাবেশ ছিল ঐতিহাসিক৷ দেশবিদেশের সাংবাদিকরাও এই ঐতিহাসিক ক্ষণটি প্রত্যক্ষ করতে হাজির ছিল৷ শ্রাবণ মাসের ভ্যাপসা গরম ও আদ্রতায় সবাই গল গল করে ঘামছেন, হঠাৎ মাথার ওপরে কোথা থেকে এক চিলতে মেঘ উড়ে এসে ঢেকে ফেলল আকাশ৷ একটু পরেই শুরু হল পুষ্পবৃষ্টি সদৃশ ফিনফিনে বৃষ্টি৷ জামাকাপড় ভিজল না অথচ শরীর মনে এনে দিল স্নিগ্দতার পরশ৷ এমন সময় জেলের গেট খুলে গেল৷ যার জন্যে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল সেই পরমারাধ্য ৰাৰার রজনীগন্ধা ও গোলাপ সজ্জিত দুধ সাদা এ্যামবাসাডার গাড়ী জেল গেটের সামনে দেখা গেল৷ সবাই পরমপিতা ৰাৰা কি জয়ধবনিতে পটনা শহরের আকাশ বাতাস মুখরিত হল৷ ৰাৰার গাড়ী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতেই অনেকেই ৰাৰার গাড়ীতে হুমড়ী খেয়ে পড়ল৷ গাড়ীর ভিতরে নমস্কার মুদ্রারত ৰাৰার স্মিত হাসি দেখে ভক্তরা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল৷ কেউ হাসছে, কেউ বা আনন্দে কাঁদছে, সত্যি সে এক অভিনব দৃশ্য৷ স্বেচ্ছাসেবীদের শত চেষ্টাও ভক্তদের রুখতে পারছে না৷ দীর্ঘদিন ৰাৰার পার্থিব দর্শন থেকে ভক্তরা যে বঞ্চিত! তাই মুহুর্ত্তেই আবেগের বিস্ফোরণ হল৷ গাড়ী এগিয়ে যেতেই সবাই উন্মত্তের মতে৷ গাড়ীর পিছন পিছন ছুটতে লাগল৷ আমিও সবাইকে অনুসরণ করে ছুটতে লাগলুম, অবশেসে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাসহ ৰাৰার গাড়ী উজ্জয়িনীতে ৰাৰার বাসভবনে এসে শেষ হল৷ সেখানে হাজির ছিলেন ৰাৰার বড়দিদি হীরাপ্রভা৷ তার হাত থেকে ডাবের জল খেয়ে বাবা দীর্ঘ উপবাস ভঙ্গ করেন৷ পরের দিন ছিল ধর্মমহাচক্র৷ সেখানে ৰাৰা সংক্ষিপ্ত প্রবচন দিয়েছিলেন৷ সেদিনের সেই ২রা আগষ্টের স্মৃতি আমার মনের মণিকোঠায় আজও সযতনে আছে৷ আমৃত্যু যা জাগ্রত হয়ে থাকবে৷
(লেখক-আচার্য প্রসূনানন্দ অবধূতের প্রত্যক্ষ দর্শনের অভিজ্ঞতা থেকে)