জলটান

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

সংস্কৃত ‘মদ’ ধাতুর একটি অর্থ হল যা শুষে আরাম পাওয়া যায় (ভাবারূঢ়ার্থ), যোগারূঢ়ার্থে জল, সরবৎ, পানা, ফলের রস ও যে কোন তরল বস্তু যা পানীয় পর্র্যয়ভুক্ত৷ উপরি-উক্ত যে বস্তু খেলে জলটান হয় অর্র্থৎ যে আহার গ্রহণের পর বারৰার  জলতেষ্টা পায় সেই বস্তুকে ম+ড= ‘ম’ নামে আখ্যাত করা হয়ে থাকে৷ যেমন কম জলে  ছাতু গুলে খেলেও বার বার জলতেষ্টা পায়৷ এই ধরনের জলতেষ্টাকে ‘জলটান’ ৰলা হয়৷

তোমরা সেই ৰলাগড়ের ব্রজবল্লভ ৰসাকের জলটানের  গল্প শুণেছ তো! যদি না শুণে থাক তো একবার ৰলি৷ ব্রজবল্লভ ৰসাক থাকতেন ৰলাগড়ে--- তাঁর পৈতৃক ভদ্রাসনে৷

কিন্তু ব্রজবল্লভ  ৰসাকের  অন্তরঙ্গ  বন্ধুরা ৰেশ কিছুটা দূরে থাকতেন ৰন-হুগলীতে, অপর অন্তরঙ্গ বন্ধু বিজিত বসু  থাকতেন  ৰাজেশিবপুরে৷ বিজিত ৰাঁরুজ্জের  ছেলেটি লেখাপড়া সমাপ্ত করে সদ্য সেই যে কী যে একটা সরকারী বিভাগ আছে যেখানে খাদ্যশস্য ওজন করে দাম দিয়ে গুদামজাত করা হয় সেই বিভাগটিতে অল্পদিন হল কাজ পেয়েছে৷ আর বিজিত বসুর  ছেলেটি এম.এ. পাশ করেছে, হুগলীর কোন একটি কলেজে  তার পেপেচুরির চাকরি হলো-হলো৷

একদিন প্রাতর্ভ্রমণ সেরে ব্রজবল্লভ বসাক বাড়ী ফিরে আসতেই তাঁর স্ত্রী সেয়ানাসুন্দরী বললেন, ‘‘ওগো শোন, তোমার বন্ধু বিজিতৰাৰু এইমাত্র খৰর পাঠিয়েছেন, আজ রাত্তিরে ওঁর ছেলের ৰউ-ভাত৷ তোমাকে নেমতন্ন রক্ষা করতে যেতেই হৰে৷ নইলে উনি মনে ভারী দুঃখু পাৰেন৷ কাজকর্মে অত্যধিক ব্যস্ত থাকায় নিজে আসতে পারলেন না৷ নইলে তিনি নিজেই এসে তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন’’৷

ব্রজবল্লভ বসাক সেয়ানা সুন্দরীকে শুধোলেন---‘‘কোন জায়গাটার  নাম করেছে ৰল তো--- ৰনহুগলীর না ৰাজেশিবপুরের’’৷

সেয়ানাসুন্দরী ৰললেন---‘‘অত তো জিজ্ঞেস করিনি৷ কারণ যে লোকটি এসেছিল সে ৰললে  বিজিতৰাৰু ব্রজৰাৰুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ৷ নাম নিলেই ৰুঝতে পারৰেন’’৷

ব্রজবল্লভ বসাক বললে---‘‘তাও তো জিজ্ঞেস করিনি কারণ লোকটি বললে, নেমতন্নকারীর নাম শুণলেই ব্রজৰাবু  বুঝতে পারবেন, বেশী বলার দরকার  পড়বে না’’৷

ব্রজবল্লভ মহাফাঁপরে পড়লেন৷ তিনি এবার বাস্তব বুদ্ধি প্রয়োগ করলেন৷ বিজিত বাঁডুজ্জের ছেলেটি চাকরী করে৷ সুতরাং চাকরী পাওয়ার পরে নিশ্চয় তার বিয়ের ঘটকালি শুরু হয়েছিল৷ তাই তার বিয়েই বেশীই সম্ভব৷ বিজিত বসুর ছেলেটি পেপেচুরির কাজ পাৰে, তারপরে পাত্রীর সন্ধান হবে, তারপরে দেনাপাওনার কথা হবে, ঠিকুজী গোষ্ঠী বিচার করে তারপরে পাকা দেখা হবে৷ তারপরে না বিয়ে! শতকরা ৯৯.৯ ভাগ সম্ভাবনা বিজিত বাঁড়ুজ্জের ছেলের বিয়ে৷

বলাগড় থেকে ৰাজেশিবপুর যেতে গেলে সোজা ট্রেনে  যাওয়া যাবে না৷ গঙ্গা পার হতে হবে৷  কিন্তু বনহুগলী যেতে গঙ্গা পার হতে হয় না৷ কিন্তু ৰনহগলী যেতে গঙ্গা পার হতে হয় না৷ ব্রজবল্লভ বসাক কী করৰেন! ঘনিষ্ঠ বন্ধু তো৷ আত্মীয়ের  চেয়ে বন্ধুর টান বেশী৷ তাই তিনি যেভাবেই হোক বনহুগলীতে গিয়ে পৌঁছুলেন সন্ধ্যে একটু আগেই৷ বন্ধুর ছেলের বিয়ে...... একেবারে ৰাইরের লোকের মত এসেই হাতটি ধুয়ে পাতে ৰসে  পড়া যায় না৷  দরকার পড়লে ময়দা মাখতে হৰে, নুচি ৰেলতে হৰে, এমনকি  কোমরে গামছা জড়িয়ে নুচি ভাজতে হৰে কিংবা ৰাঁ হাতে ডালের ৰালতি,ডান হাতে হাতা নিয়ে  পরিবেশন করতে হবে৷ ঘাম মোছবার জন্য কাঁধে একটি গামছাও রাখতে হবে৷ তাই একটু আগেই  যাওয়া দরকার৷

বনহুগলীতে পৌঁছলেন ব্রজবল্লভ বসাক৷ কিন্তু এ কি! বিজিত বাঁড়ুজ্জের বাড়ী দেখে বিয়ে বাড়ী ৰলে তো মনেই হচ্ছে না৷  বাইরের দিকে একটা আলোও জ্বলছে না৷ সামনে বৈঠকখানায় একটা কম পাওয়ারের আলো টিমটিম করে জ্বলছে৷ কড়া নেড়ে দরজা খোলাতে হল৷

বিজিত বাঁড়ুজ্জে বললেন--- ‘‘এসো এসো, ব্রজ, তোমার যে আজকাল টিকিই দেখতে পাই না৷

ব্রজবল্লভ ঘরে ঢুকে যা দেখলেন তাতে তার মনে নেৰে  এল সন্দেহের  কালো ছায়া৷ এ ৰাড়ী তো বিয়ে-ৰাড়ী নয়৷ পরিস্থিতি সামলাবার জন্যে বিজিত বাঁড়ুজ্জের সঙ্গে তিনি দু’চারটি কুশল সংবাদের আদান প্রদান করলেন ৷ বিজিত বাঁড়ুজ্জের চোখ মুখ দেখে মনে হল তার ঘুম আসছে৷ তখন রাত্রি পৌনে ন’টা৷ বিজিত বাঁড়ুজ্জে হাঁই তুূলতে তুলতে ৰললেন, ‘‘একটু সকাল সকাল খাই কী না  আর  বোঝ তো বয়স হয়েছে--- বিশেষ কিছু সহ্য হয় না৷ রাত্তিরে খই দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ি৷ ওটা একটু হাল্কা জিনিস তো৷’’

ব্রজবল্লভ বসাক ৰললেন, হ্যাঁ, আমিও অনেকক্ষণ ধরে উঠৰ উঠৰ করছিলাম৷ অনেকদিন পরে তোমাকে দেখে এত আনন্দ হচ্ছে যে কী ৰলৰ৷ ......আচ্ছা চলি৷ তা তোমার  ছেলেটি এখন কী করছ? তার বিয়ে-থার কী হল?’’

বিজিত বাঁড়ুজ্জে বললেন,---‘‘পাত্রীর খোঁজ তো চলছে, তবে পাত্রী পছন্দ হচ্ছে তো দেনা-পাওনায় মিলছে না, আবার দেন-পাওনা মিলছে তো পাত্রী পছন্দ হচ্ছে না৷ তবে আশা করি সামনের  মাঘ মাসে বিয়ের ব্যবস্থা হৰে৷ সে   খবর তো তুমি আগেই  পেয়ে যাৰে’’৷

ব্রজবল্লভ বসাক বাড়ীতে ফিরে এলেন৷ কড়া নাড়তেই সেয়ানা-সুন্দরী দরজা খুলে দিলে৷ ঘরে ঢুকেই  ব্রজবল্লভ স্ত্রীর দিকে একটু বিষণ্ণ্ মুখে তাকালেন৷

স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন---বিয়েবাড়ীতে কেমন খাওয়া-দাওয়া হ’ল?

ব্রজবল্লভ বসাক বললেন---‘‘আগে এক গেলাস ঠাণ্ডা জল দাও দিকি’’৷

ব্রজবল্লভ ধপাস্‌ করে চেয়ারে ৰসে হাতটা রাখলেন ডানগালের নীচে৷ জোরে একটা               দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন৷ মনে মনে বললেন, নুচি-পোলাও দুই-ই৷ সেয়ানাসুন্দরী জল নিয়ে এলো৷ ব্রজবল্লভ বসাককে বললে,---‘‘কী খেয়েছো তোমাকে আর বলতে হবে না, আমি  ৰুঝে নিয়েছি’’৷

ব্রজবল্লভ বসাক ৰললেন---‘কী খেয়েছি ৰল  দেখি’?

সেয়ানাসুন্দরী বললে,---‘নিশ্চয়ই পোলাও’৷

ব্রজবল্লভ শুধোলেন--- ‘কী করে ৰুঝলে’?

সেয়ানাসুন্দরী ৰললে---‘ওটুকু আমি জানি গো জানি, পোলাও খেলে দারুণ জলটান হয়’৷