খাদ্যরস সাধারণতঃ ছয় প্রকারের৷ এই ষড়রস হচ্ছে–তিক্ত, কটু, কষায়, লবণ, অম্ল ও মধুর৷ তন্ত্র–ভারতীয় ভেষজবিজ্ঞান এই হিসাবকেই অনুসরণ করে৷ প্রথম পাতে খেতে হয় তিক্ত (যেমন পলতা, শুক্তো, নিম–বেগুন, শিউলি পাতার ঝোল প্রভৃতি)৷ দ্বিতীয় পাতে খেতে হয় কটু অর্থাৎ ঝাল (যেমন একটু বেশী লঙ্কা বা গোলমরিচ বা পিপুল দিয়ে তৈরী রান্না–আলু–মরিচ, নিরামিষ ঝাল, ৰড়ির ঝাল)৷ তৃতীয় পাতে খেতে হয় কষায় জিনিস (যেমন ডুমুর, মোচা, থোড়, কাঁচকলা প্রভৃতি)৷ চতুর্থ পাতে খেতে হয় লবণযুক্ত জিনিস (যেমন অচার, পাঁপড়, নোনতা পোলাও, নিমকি, সিঙ্গাড়া প্রভৃতি)৷ পঞ্চম স্তরে খেতে হয় অম্লরস যুক্ত খাদ্য (অম্বল, চাটনি, টক, তেঁতুল, আমড়া, জলপাই, করমচা, কামরাঙা, কাঁচা আমের ঝোল, দই প্রভৃতি)৷ ষষ্ঠ স্তরে খেতে হয় মিষ্টবস্তু (ৰাংলার খাদ্য তালিকায় মিষ্ট বস্তু বলতে বেশী করে ৰোঝায় পায়েসকে–চালের পায়েস, চিড়ের পায়েস, চষির পায়েস, লাউয়ের পায়েস, সেমাইয়ের পায়েস প্রভৃতি)৷ খাদ্য তালিকা দীর্ঘ করলুম না, কারণ তাহলে অনুমান করি তোমরা বাড়ীতে গিয়ে উৎপাত শুরু করে দেবে৷
এই বিভিন্ন রসযুক্ত খাদ্য গ্রহণের ধাপও ৰেঁধে দেওয়া আছে–ৰেঁধে দেওয়া আছে বিধিও৷ এই ধাপগুলিই হ’ল–তিক্ত, কটু, কষায়, লবণ, অম্ল ও মধু৷ প্রথম পাতে তেতো খেতে হয় খেতে হয় নিম–বেগুন, উচ্ছে ভাজা বা শুক্তো৷ তিক্ত প্রথমে খেতে হয় কারণ তিক্ত লালাস্রাবী৷ ওই লালাই ব্দ্ত্রপ্তন্ল্ত্রগ্গ পরবর্তী খাদ্যগুলিকে হজম করতে সাহায্য করে৷ শেষ পাতে খেতে হয় মিষ্টি জিনিস, কেন না মিষ্টি আদৌ লালাস্রাবী নয়৷ তাই মিষ্টি আগে গ্রহণ করে পরে অন্য খাদ্য গ্রহণ করলে তাতে পরিপাকে অসুবিধা দেখা দিতে পারে৷ লবণের পরে অম্ল খাদ্য গ্রহণ করতে হয়, কারণ লবণ অম্ল খাদ্যের এ্যাসিডিটি ন্তুন্স্তুন্ব্ধম্ভগ্গ দোষকে সন্তুলিত ন্দ্বব্ভব্ধব্জ্ত্রপ্তন্ম্ করে দেয়৷ সেই জন্যে ৰলা হয়ে থাকে ‘‘দধিলবণেন সহ ভক্ষয়েৎ’’৷
রসগুলির মধ্যে মানুষের, বিশেষ করে শিশুর খেতে সবচেয়ে কম ভালো লাগে তিক্তরস৷ তবু প্রথমপাতে খেলে তাতে কিছুটা মানিয়ে নেওয়া যায়, তারপরে আর তা করা যায় না৷ শীতের শেষে কচি নিম পাতা প্রথম পাতে মন্দ লাগে না৷ কিন্তু সাধারণভাবে মানুষ তিক্ততাকে এড়িয়ে যায়৷ জিব দিয়ে তিক্ত রস গৃহীত হলে যে ধরনের একটা প্রতিকূল বেদনা অনেক সময় অনুভূত হয়, কোন মানুষের সংস্পর্শে এলে যদি মনোজগতে কতকটা সেই ধরনের প্রতিকূল বেদনা অনুভূত হয়, তবে সেই মানুষকে ৰলি তিক্ত মানুষ৷ যাইহোক আমরা জানি তিক্ত বস্তুর শরীরে প্রয়োজন আছে৷
কটু বা ঝাল জিনিসটারও শরীরের পক্ষে দরকার আছে৷ কিন্তু এই জন্যে কাউকে মুঠো মুঠো ধানী লঙ্কা খেতে ৰলা হচ্ছে না৷ তবে একটু আধটু কাঁচা লঙ্কা খেলে মন্দ কী! ঙ্মযেমন ঝালমুড়িতেৰ অল্প পরিমাণে ঝাঁলযুক্ত সর্ষের তেল (ঝাল বা ঝাঁঝের জন্যে সর্ষের তেলের সংস্কৃত নাম কটুতৈল তাই থেকে উত্তর ভারতে করুয়া তেল) ও কাঁচা লঙ্কা মেশানো না থাকলে খেতে কেমন ঘাস ঘাস লাগে না কি! কী বল গো তোমরা!
প্রাচীন ভারতে ঝালের মুখ্য উপদান ছিল দু’টি–(১) গোলমরিচ (কটূবীজম) (২) পিপুল (পিপ্পলী)৷ লঙ্কা আমাদের দেশে এসেছে অনেক পরে........ মোগল যুগের শেষাশেষি৷ এনেছিলেন পর্তুগীজেরা৷ তাই লঙ্কার কোন সাবেকি নাম নেই৷ বিদেশ থেকে মরিচ (মরিচ শব্দটি ফার্সি মীর্চ থেকে এসেছে) এসেছিল বলে তার নাম দেওয়া হ’ল লঙ্কা মরিচ৷ কালক্রমে মরিচ শব্দটি সরে গিয়ে রয়ে গেল লঙ্কা শব্দটি (রাঢ়ী ৰাংলায় সাগরপারিয়া, তার থেকে সোপরে)৷ লঙ্কা তো এল৷ সে মানুষের জিব দিয়ে লালা ঝরালো, ঝাঁঝে মানুষের চোখে জলও এনে দিল৷ সেই ঝালের মাধুর্য্যে মানুষ মোহিত হয়ে গেল৷ আজ আমাদের রান্নাবান্না, গৃহস্থালী, পিঁড়ে, হাঁড়ি, উনুনের ঝিক–লঙ্কা বাদে অচল৷ পিপুল তাকে সসম্মানে পথ ছেড়ে দিল৷ (অবশ্য অনেকগুলো সঙ্গত কারণেই পিপুলকে সরে যেতে হ’ল)৷ আমাদের দেশে মোগল আমলের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলত পিপুলের একচ্ছত্র আধিপত্য৷ কথায় কথায় মেয়েরা শিলে পিপুল ৰাটতেন, হামানদিস্তায় পিপুল গুঁড়ো করতেন, অচার–কাসুন্দিতে পিপুল গুঁড়ো দিতেন৷ পিপুল থেকে আয়ুর্বেদের অনেক ঔষধ তৈরী হত৷ তোমরা যারা আয়ুর্বেদের সঙ্গে একটু পরিচিত তারা জান গুড়পিপ্পলী আয়ুর্বেদের একটি ঔষধ৷
যে দেশের জলবায়ু বেশী ভিজে, সে দেশে লঙ্কা খাবার প্রয়োজন অনুভূত হয়, অন্যথায় বাতরোগ হবার সম্ভাবনা থাকে৷ অবশ্য বেশী লঙ্কা খাওয়াও ভাল নয়৷ ঙ্মকাঁচা লঙ্কার মধ্যে ক্যান্সার প্রতিরোধের গুণ আছে৷ তাই পরিমিত মাত্রায় কাঁচা লঙ্কা খাওয়া ভাল৷ কিন্তু বিপদ হয় বেশী শুকনো লঙ্কা খেলেৰ৷
খাবার পাতে সব শেষে থাকে মিষ্টি..........‘‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’’৷ ভোজন রসিকেরা বলেন–আহার্যবিজ্ঞান মতে মিষ্টান্ন শেষে রাখা হয়েছে এটা হয়ত ঠিকই, কিন্তু এর চেয়ে বেশী ঠিক হচ্ছে অন্যান্য জিনিসগুলো কম খেয়ে শেষ পাতে মিষ্টান্নের জন্যে জায়গা রাখতে সুবিধে রয়েছে৷ আর মিষ্টান্নের পরে নাকি পাঁচটি রস খেতে গেলে তা জিবে তেমন রুচবে না৷
মানুষের খাদ্য প্রধানত পাঁচটি অঙ্গের সমষ্টি ঃ– (১) ভাত, রুটি, আলু, ওট প্রভৃতি প্রধান খাদ্য (২) প্রোটিন খাদ্য– যেমন ডাল, দুধ, ছানা, সয়াবিন (অথবা লোকের পছন্দানুসারে, আমিষ প্রোটিন) (৩) রন্ধনে ব্যবহার্য ড্রস্তুন্ত্ব্প্তন্দ্ব প্সন্প্তগ্গ তৈল বা স্নেহজাতীয় বস্তু (৪) মশলাপাতি (৫) শাকসব্জি, ফলমূল (মিষ্টিসহ)৷
(‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে)