মাতৃভাষার অধিকার

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক সার্ভিস কমিশন সিদ্ধান্ত নেয় পশ্চিমবঙ্গে ডব্ল বিএসসি পরীক্ষায় বাংলাভাষা বাধ্যতামূলক করা হবে৷ কিন্তু নবান্ন থেকে সেই সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়৷ বাংলা ভাষা নিয়ে রাজ্য সরকারের এক পা এগোনো দু-পা পিছানো এই প্রথম নয়, এর আগেও সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছিয়ে এসেছে রাজ্য সরকার৷ কারণ এইরাজ্যে অনেক অ-বাংলা ভাষী আছে৷

প্রশ্ণ হচ্ছে মহারাষ্ট্র, গুজরাট রাজস্থানে কিন্তু অনেক বাঙালী আছে৷ সেইসব রাজ্যে কর্মক্ষেত্রে স্থানীয় ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ অর্থাৎ ওই সব রাজ্যে ভিন্ন রাজ্যের ভিন্ন ভাষা-ভাষীর জনগোষ্ঠী ওই রাজ্যের স্থানীয় ভাষা শিখতে বাধ্য হচ্ছেন৷ আর এটা কোন সংবিধান বহির্ভূত কাজ নয়৷ ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র৷ এখানে নানা ভাষা-ভাষীর জনগোষ্ঠীর বাস৷ শুধু ভাষা গত নয়, আহার-বিহার, পোষাক-পরিচ্ছদ, চালচলনেও রয়েছে বৈচিত্র্যময় পার্থক্য৷ ভারতবর্ষকে তাই বলা হয় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য৷ এই একতাকে যদি রক্ষা করতে হয় তবে বৈচিত্র্যের মধ্যে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর যে স্বতন্ত্রতা আছে, যে বৈশিষ্ট্য আছে তাকেও রক্ষা করতে হবে৷ তাই যে সব রাজ্য সেই রাজ্যের স্থানীয় ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে তারা নিজ রাজ্যের জনগোষ্ঠীর স্বার্থেই তা করেছে৷ এর মধ্যে অন্যায় কিছু নেই, দেশ বিরোধী বা সংবিধান বিরোধী তো নয়ই৷

অন্যরাজ্যের সরকার যা পারে পশ্চিমবঙ্গের সরকার তা পারে না কেন? এই প্রবণতা স্বাধীনতার পর থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ বিধানচন্দ্র রায়ের মতো ব্যষ্টিও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না৷ স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব সহ গোটা দেশেই একই দলের শাসন ছিল৷ অথচ পঞ্জাব যেভাবে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান করেছে বিধানচন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রী থেকেও তার ছিটে-ফোঁটা করতে পারেননি৷

স্বাধীনতার পর থেকেই দেশভাগে বিপর্যস্ত পশ্চিমবঙ্গের পাশে কেন্দ্রীয় সরকারকে কখনই পাওয়া যায়নে৷ এই নিয়ে বিধান রায় থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কখনও মুখ খোলেননি৷ এমনকি রাজ্যের সীমানা নিয়েও দিল্লির বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙলার কোন রাজনৈতিক দল কখনও সরব হয়নি৷ স্বাধীনতার প্রায় আট দশকে দিল্লির শাসন ও শোষণে বাঙলার অর্থনীতি তলানিতে পৌঁছে গেছে৷ বাঙালী জনগোষ্ঠীর যেটুকু প্রাণশক্তি এখনও আছে সেটা তার ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির জন্যে৷ কিন্তু তাও হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী হাঙরের আগ্রাসনের শিকার৷

ভাষা সম্পর্কে মহান দার্শনিক প্রাউট প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---‘‘ভাষা মানুষের অন্তরের ভাবপ্রকাশের এক শক্তিশালী মাধ্যম৷ এই ভাষা মানুষের প্রাণীন সম্পদ---যা তার প্রাণধর্ম অর্থাৎ সত্তাগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পর্কিত৷

তাই একটা জনগোষ্ঠীকে বিলুপ্ত করতে হলে তার ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতিকে প্রথমেই

অবলুপ্ত করতে হবে৷ স্বাধীন ভারতের শাসক স্বাধীনতার জন্মলগ্ণ থেকেই বাঙলাকে ধনে প্রাণে মেরে চলেছে৷ বর্তমান শাসকের আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের সেই প্রয়াসে গতিবৃদ্ধি হয়েছে কিন্তু বাঙলার শাসক ও জনগোষ্ঠী কারোর কোন হেল দোল নেই৷

ভারতবর্ষে ভাষা সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় শাসক কখনও কোন উদ্যোগ নেয়নি৷ বরং জোরপূর্বক হিন্দি চাপানোর প্রয়াসে সমস্যা আরও গভীর হয়েছে৷ দক্ষিণ ভারতে হিন্দির প্রবেশ একপ্রকার নিষিদ্ধ৷ কিন্তু দক্ষিণ ভারত যেটা পারে পশ্চিমবঙ্গ সেটা পারে না৷ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী কিছুটা ব্যতিক্রম হলেও ভাষার ক্ষেত্রে তিনি এক পা এগিয়ে দু-পা পিছিয়ে যান৷ প্রথম কারণ হয়তো পশ্চিমবঙ্গে হিন্দিভাষীর আধিপত্য, দ্বিতীয় তিনিও দিল্লির সিংহাসনে বসার স্বপ্ণ দেখছেন তাতে বাঙলা থাক বা যাক্‌৷

এখন প্রশ্ণ মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান প্রভৃতি রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালীরা যদি সেই রাজ্যের ভাষা শিখতে বাধ্য হয়, বাঙলায় বাধা কিসের? তার ব্যাখ্যা বাঙলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এখনও পাওয়া যায়নে৷ একটি বিশেষভাষাকে জোর করে অন্য ভাষার ওপর চাপানোর পরিণামে ভারতের সংহতির ভিত আলগা হচ্ছে৷ তাই জোর করে একটি বিশেষ ভাষা চাপানোর আত্মঘাতী প্রয়াস থেকে সরকার সরে আসলেই দেশের মঙ্গল৷ ভাষা প্রতিটি জনগোষ্ঠীর জন্মসিদ্ধ অধিকার ও ভারতের সংবিধানেও তা স্বীকৃত৷