ওড়িশার ব্যাঘ্রকুলের কৃষ্ণবর্ণ প্রাপ্তিতে কপালে মেঘ জমেছে বাঘ বিশেজ্ঞদের

সংবাদদাতা
পি.এন.এ.
সময়

দুধে-আলতায় সে যে ধবল ছিল, এমন নয়৷ তবে তার কৃষ্ণ-পিঙ্গল আঁকাবাঁকা ডোরা, সেই আদিম রঙের উপরে কে যেন ঘন কালির প্রলেপ এঁকে দিয়েছে৷ ওড়িশার সিমলিপালে ব্যাঘ্রকুলের ক্রমশ এই কৃষ্ণবর্ণ প্রাপ্তিতে কপালে মেঘ জমেছে বাঘ বিশেজ্ঞদের৷

১০ থেকে তারা এখন ১৩৷ বন কর্তাদের হিসাব বলছে, দু’বছরে সংখ্যা বৃদ্ধি তিন৷ বাড়বৃদ্ধিতে সচরাচর স্বস্তি মেলে৷ এ ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো, সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের শাল-পিয়ালের গহীন জঙ্গলে, গোটা ৩৬ বাঘের প্রায় ৩৭ শতাংশই কৃষ্ণবর্ণ হয়ে ওঠায় বাঘের আদি রূপের অস্তিত্ব থাকবে তো, প্রশ্ণটা তাড়া করছে দেশের বন কর্তাদের৷ বাঘ সংরক্ষণে দেশের সর্র্বেচ্চ সংস্থা এনটিসিএ’র (ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি) সদস্য সচিব গোবিন্দ ভরদ্বাজ কবুলও করে ফেললেন সে কথা ‘‘মেলানিজম (কৃষ্ণবর্ণত্ব)-এর ফলে বাঘের আদি চেহারাটাই মুছে না যায়!’’ সে অনিশ্চয়তার হদিশ করতে তাবড় বিশেষজ্ঞরা এখন তড়িঘড়ি সরেজমিন তদন্তে ছুটেছেন সিমলিপালে৷

পশ্চিম ভারতের রুখু জঙ্গল কিংবা উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি অরণ্যে অহরহ ব্ল্যাক প্যান্থার বা কালো চিতাবাঘের দেখা মেলে৷ তার কারণও মেলানিজম৷ তা বলে, হলুদ-কালো ডোরা কাটা জাতীয় পশুর কৃষ্ণবর্ণ প্রাপ্তি! বাঘ বিশেষজ্ঞ তথা ডব্লুপিএসআই-এর (ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি) ডিরেক্টর বেলিন্ডা রাইটস বলেছেন, ‘‘আপাত ভাবে ব্যাপারটা সুন্দর হলেও প্রাণিজগতের ভারসাম্যের প্রশ্ণে কিন্তু এই রূপান্তর খুব কাম্য নয়৷’’ তা হলে মেলানিজম রোখার উপায়?

প্রাণিবিজ্ঞানী টিএস মাথুর বলছেন, ‘‘এ এক জিনগত সমস্যা৷ এর ফলে প্রাণীদের চামড়া কিংবা রোমে কালো রঙের প্রাচুর‌্য বেড়ে গায়ের আদি রঙটাকেই আড়াল করে দেয়৷ বাঘের হলুদ ডোরা এ ভাবেই কালোর আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে৷ ব্ল্যাক প্যান্থারের ক্ষেত্রেও কারণটা একই৷ তাদের হলুদ বর্ণের উপরে চাকা চাকা দাগ কালোর আস্তরণে ঢেকে যায়৷’’ সেই সঙ্গে তিনি ধরিয়ে দেন, এর বিপরীত ক্ষেত্রে চামড়ার রং অত্যধিক সাদা হয়ে যাওয়া অ্যালবিনো বা সাদা বাঘের উৎপত্তির কারণ৷

কয়েক বছর ধরে কালো বাঘের সুলুক সন্ধান করছেন প্রাণিবিশেষজ্ঞ উমা রামকৃষ্ণান৷ তাঁর অনুমান, ইনব্রিডিং বা নিকট আত্মীয়তার মধ্যে প্রজননের ফলেই সিমলিপালে কালো বাঘের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে৷ কিন্তু সেই ব্যক্তিগত মেলামেশায় বাধ সাধে কার সাধ্য! সিমলিপালের বনকর্তারা জানান, সমগ্র জঙ্গল জুড়ে নয়, ওই ব্যাঘ্র প্রকল্পের নওরঙ্গা রেঞ্জের বড়মকাবাড়ি এলাকাটাই কালো বাঘের ডেরা৷ ওই নির্দিষ্ট এলাকায় যে ক’টি বাঘ থাকে, মিলন হচ্ছে তদের মধ্যেই৷ বাঘ বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘বাঘের ইনব্রিডিং বন্ধ করা সহজ নয়৷ এমনকি ঠিক কোন বাঘের জিনে মেলানিন রয়েছে তা আগাম অনুমান করাও সম্ভব নয়৷ আবার এ কথাও ঠিক, বাঘিনীর জিনে মেলানিন রয়েছে মানেই পরবর্তী প্রজন্মের সব শাবকের গায়ের রং কালো হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই৷’’ ধাঁধাটা এখানেই৷ ওড়িশা সরকারের পর্যটন দফতরের অবশ্য এ সব জটিল ধাঁধা নিয়ে মাথাব্যথা নেই৷ বরং পর্যটক টানতে গত কয়েক বছর ধরে সিমলিপালের কালো বাঘের ঢালাও প্রচারে নেমেছে তারা৷ শুরু হয়েছে ‘কালো বাঘ সাফারি’৷ যা শুনে বাঘ বিশেষজ্ঞ জয়দীপ কুণ্ডুর প্রশ্ণ, ‘‘কালো বাঘ কতটা বাস্তব আর কতটা প্রচার সেটাও খতিয়ে দেখার বিষয়! আর মেলানিন ঘটিত কারণে যদি বাঘের গাত্রবর্ণ কালো হয়ে থাকে তবে সে ঘটনা দেশের অন্যত্রও ঘটতে পারে৷ সজাগ থাকা উচিত সে ব্যাপারেও৷’’ বিভিন্ন ট্র্যাপ ক্যামেরা অবশ্য নিছক প্রচারের কথা বলছে না৷ বরং অন্ধকার রাতে সেই আঁধার কালো রঙ নিয়ে সে বার বার ধরা দিয়েছে ক্যামেরায়৷ সিমলিপালের এক বনকর্মী বলছেন, ‘‘শুধু রাতে নয়, বনের গভীরে ক্যামেরা বসাতে গিয়ে দুপুরেও দেখেছি তাকে, সে বড় ভয়ঙ্কর রূপ৷’’ বন-মুগ্দ কিপলিং সাহেব বলেছিলেন ‘তার রূপের ছটায় জঙ্গল বুঝি আরও রূপবতী হয়ে ওঠে!’ সেই পিঙ্গল রূপ কালো-ছায়ায় চিরতরে হারিয়ে যাবে না তো!