এইচ.এন.মাহাত ঃ স্বাধীনতা দিবসের ৭৫ বছর পালন করার আগে দেশমাতৃকার সেবক যে সব বীর বাঙালীর রক্তে রাঙ্গা হলো স্বাধীনতা, সেই সকল বিপ্লবীদের স্মরণ করুণ, যাঁদের আত্মত্যাগে আমরা তথা কথিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি৷ একবার ভেবে বলুন তো বাঙালী কী পেয়েছে এই তথা কথিত স্বাধীনতায়! আজ তো তার বাক স্বাধীনতাও রুদ্ধ৷ ৭৫ বছরে দেশের মানুষ পেয়েছে কী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের পরিকল্পনার অর্থনৈতিক গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা৷ বাঙালীর রক্তে ঝরা রাজনৈতিক স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর সেই বাঙালীকে সমগ্র ভারত জুড়ে বিশেষ করে অসম,ত্রিপুরা, মনিপুর সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাঙালীদের প্রতি পদক্ষেপে শুণতে হচ্ছে বাঙালীরা নাকি চালচুলো অস্তিত্বহীন উদ্বাস্তু, ঘুসপেটিয়া, বহিরাগত, নাগরিকত্বহীন ভাসমান একটি জনগোষ্ঠী৷ যে বাঙালীর শানিত রক্তে ব্রিটিশ রাজশক্তি পালাতে বাধ্য হয়েছিল সেই বাঙালী আজ সকল রাজনৈতিক দলের কাছে কৃপার পাত্র! শুধুমাত্র ভোটাধিকার পাওয়া ছাড়া কি পেয়েছে বাঙালী? তারা এখনো নাগরিকত্ত্বের পূর্ণাঙ্গ অধিকার পায়নি, সীতার মত নাগরিকত্ত্বের অগ্ণিপরিক্ষা দিতে হচ্ছে,ডিটেনশন ক্যাম্প তার জলজ্যান্ত উদাহরণ৷ ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করেছিলো বাঙলা ও পঞ্জাব ভাগের বিনিময়ে৷ পশ্চিম পঞ্জাব থেকে দেশ ভাগের বলি হয়ে যারা ভারত ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল তাদের জন্য তাৎকালিক ভারত সরকার সকলকে স্থায়ী নাগরিকত্ব সহ পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরখণ্ড, হিমাচল রাজ্যের সংলগ্ণ স্থানে এক জায়গায় বসতিস্থাপন করিয়ে তাদের জাতিসত্তাকে মজবুদ করে যুথবদ্ধ করার মানসিকতা তৈরী করে দিয়ে ছিলো৷ ভারতবর্ষ ভাগের জন্য জিন্নাহ সহ মুসলমানরা পাকিস্তান চেয়েছিলো কখনই বাঙলা ভাগের কথা উচ্চারণ করেনি৷ কিন্তু সুবৃহৎ বাঙালীস্তানকে পশ্চিমি বেনিয়া ও গুজরাঠিরা ও বাঙালী বিদ্বেষী ভারতীয় নেতৃবর্গ বলেছিলেন ওপার বাঙলা থেকে রাজনৈতিক ভাবে অত্যাচারিত হয়ে যারাই এপারে আসবেন সকলকেই নাগরিকত্ব সহ সুনিদিষ্ট পুর্নবাসন দেওয়া হবে৷ কার্যত বাঙালীরা যাতে একত্রিত না হয়ে অর্থনৈতিক , ভাষা-সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলন করতে না পারে তাই বাঙালীদের উদ্বাস্তু তকমাটা সঙ্গে দিয়ে দণ্ডকারণ্যে, মালখানগিরি, রাজস্থানে, আন্দামানে, ভারতের অস্বাস্থ্যকর ধূসর মরু বা বিভিন্ন বনাঞ্চলে বসতি স্থাপন করার কয়েক বছরের মধ্যেই স্থানীয় অধিবাসীদের অত্যাচারে অত্যাচারিত হয়ে আবার উদ্বাস্তুর মত দেশের বিভিন্ন প্রত্যান্তে ছড়িয়ে পড়ার ফলে বাঙালী তার ভাষা-সংস্কৃতি হারিয়ে অসহায় উদ্বাস্তু জাতিতে পরিণত হয়েছে৷ পাশাপাশি দেখুন তখনকার বাঙালীস্তানের বিহার প্রদেশ আজকের ঝাড়খণ্ড ও বাঙলার সিংভূম, গোপভূম, সামন্তভূম, বরাহভূম, শবরভূম, মানভূম, ভঞ্জভূম,ধবলভূম, ব্যাঘ্রভূম, শিখরভূম, ভুরিশ্রেষ্ঠ বা ভূরশুট, সপ্তশতী, মল্লভূম সহ গিরিডি জেলার বিস্তৃত অঞ্চলে ফাঁকা স্থান পড়ে থাকার পড়েও সেই সকল জায়গাতে বাঙালীকে বসতিস্থাপনে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার সাহায্য করেননি৷ কারণ জায়গাগুলি ছিলো বাঙালীস্তানের৷ এতদ অঞ্চলে বাঙালী প্রাধান্য হলে দিল্লীর গদি বাঙালীর দ্বারা পরিচালনা হতো সেই ভয়েই এখানে বাঙালীদের বসতিস্থাপন করতে দেয়নি৷ তৎসহ বাঙালীর জাতীয়তাবোধ, ভাষা ও সংস্কৃতি পঞ্জাবিদের থেকে বেশী প্রবল হতো৷ আজকের ওই অঞ্চলটি বাঙালীস্তান হওয়ার পরেও অবাঙালীরা দাপিয়ে রাজত্ব করছে৷ বাঙালীর ভাষা সংস্কৃতিকে কেড়ে নিয়ে একটি জগাখিচুড়ি হিন্দী ভাষাকে বাঙালীর মুখে চাপিয়ে দিয়েছে৷ বাঙালী আজ ভাষা সংস্কৃতি বৈপ্লবিক চেতনা হারিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছে৷ বাঙালীর জন্য কর্মসংস্থান বা অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর পরিকল্পনা রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই৷ রাজ্যে ও কেন্দ্রীয় সরকার ভোটের আগে কিছু খয়রাতি ও দাদনের ব্যবস্থা করলে পাঁচ বছরে একদিনের জন্যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে স্বাধীনতার গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করেন৷ এটাই কী বাঙালী হাজারো মায়ের কোল খালি করা বলি প্রদত্ত দামাল যুবক ও যুবতীদের রক্তের বিনিময়ের স্বাধীনতা৷
বাঙালীকে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর শপথ নেওয়ার পালা৷ পাশাপাশি আর এক বাঙালী প্রাউট প্রবক্তা মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ভাষায় ‘‘বাঙালীকে বাঁচতে হলে বাঙালীর নিজের মাতৃভূমি বাঙালীস্তান গড়তেই হবে৷ যেমন গুজরাঠিদের জন্য গুজরাট, রাজস্থানীদের জন্য রাজস্থান, তামিলদের জন্য তামিলনাড়ু বা মারাঠিদের জন্যে মহারাষ্ট্র হলে বাঙালীদের জন্য বাঙালীস্তান হলে ক্ষতিটা কি, প্রমাণ হবে এটাই বাঙালীদের বাসস্থান ৷ তিনি প্রাউট দর্শনে বলেছেন রাজনৈতিক স্বাধীনতা মানুষকে রাজনৈতিক ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না৷ স্বাধীনতার পূর্ণতাপ্রাপ্তি করতে হলে চাই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা৷ বাঙালীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হলে প্রথমে তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে মজবুত করার সাথে সাথে বহিরাগতদের দাদাগিরি ও অর্থনৈতিক বর্হিস্রোত একশত শতাংশ বন্ধ করা , একটি ব্লক ও কয়েকটি ব্লকের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের সুষ্ঠু পরিকল্পনা৷ গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করতে কুটির শিল্পের উৎসাহের সাথে সাথে বাজার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা যাতে ফরেদের হাতে পরে স্থানীয় মানুষকে অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত হতে না হয়৷ তবেই হবে স্বাধীনতার পূর্ণমূল্যায়ন৷
দেশের ও ব্যষ্টির সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নতি করতে তিনি বাস্তবমুখী সামাজিক আর্থিক ও সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা রূপায়ণে তিনি লিখেছেন একগুচ্ছ বই অর্থাৎ সমাজের সকল সমস্যার সমাধান বা ‘‘মকরধবজ’’৷ কণিকায় প্রাউট ১৪টি খণ্ড, প্রাউট অর্থনীতির নব দিগন্ত, অভিমত কয়েকটি খণ্ড মানুষের সমাজ দুটি খণ্ড, বাঙলা ও বাঙালী, আজকের সমস্যা, দেশ প্রেমিকের প্রতি, সভ্যতার আদি বিন্দু রাঢ়, নদী ও সভ্যতা, বরেন্দ্রভূমি, কৃষি কথা ইত্যাদি আরো অনেকগুলি বই৷’’ প্রাউটকে বাস্তবায়ন করতে এগিয়ে আসুন তবেই আপনি আগামী প্রজন্মকে সমৃদ্ধ সামাজিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহ উন্নতি পরিকাঠামো যার ভিত্তি হলো মানবতা, নৈতিকতা ও প্রগতিশীলতায় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ নব্যমানবতার মানব সমাজ গড়তে সাহায্য করবে৷ সেটাই হবে স্বাধীনতার পূর্ণমূল্যায়ন৷