সভ্যতা, বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিক প্রগতি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

আজকের আলোচনার বিষয় হ’ল, সভ্যতা, বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিক প্রগতি৷ মানুষের বিভিন্ন ভাবের অভিব্যক্তির সামূহিক নাম ‘কালচার’ বা ‘সংস্কৃতি’৷ শুরুতেই আমি তোমাদের ৰলে রাখছি, গোটা মানুষ জাতির সংস্কৃতি একটাই৷

সভ্যতা কী? আমাদের জীবনের বিভিন্ন অভিব্যক্তির মধ্যে শিষ্টাচারের যে সূক্ষ্ম ভাবের সংস্পর্শে আমরা আসি, তাকেই ৰলে সভ্যতা৷ একটা উদাহরণ দিই, মনে কর, বাড়ীতে একজন অতিথি এসেছেন৷ আমরা নিরুত্তাপভাবে তাকে ‘‘এসো’’ বা ‘‘আসুন’’ ৰলে আহ্বান করতে পারি, আবার স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে এও বলতে পারি, ‘‘অনুগ্রহ করে আসুন’’ বা ‘‘অসুন, আসুন, ভেতরে আসুন’’৷ এই যে অতিরিক্ত ভাষা বা ভাবের দ্বারা ভদ্র সম্ভাষণের অভিব্যক্তি এটাই সভ্য বা সভ্যতা-সম্মত আচরণ৷ কারণ এখানে শিষ্টাচারের সূক্ষ্মভাবটা স্বতঃস্ফূর্ত৷ স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, সাধারণ নিরুত্তাপ আহ্বান সূচক ‘এসো’ বা ‘আসুন’ কথাটা সম্ভাষণের উত্তাপরহিত ---এটা শিষ্টাচারের অভাবেরই ফল৷ সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, সংস্কৃতি বা কালচারের ক্ষেত্রে ভাল মন্দ দু’টো দিকই আছে, কিন্তু শিষ্টাচারের যে সূক্ষ্মভাব---এটাই সভ্যতার কষ্টিপাথর৷ সংস্কৃতি বা কালচারের মাধ্যমে শিষ্টাচারের যে সূক্ষ্ম ৰোধ আমরা পাই, সেটা মানুষের সূক্ষ্ম বিচার-ক্ষমতা বৃদ্ধি করে৷ আমরা মানুষের সেই সব আচার আচরণকেই সভ্য ৰলতে পারি যা বৃহত্তর ক্ষেত্রে মানুষের সূক্ষ্ম বিচার ক্ষমতার পরিচয় বহন করে৷ অনেক সময় দেখা যায়, কোন বিশেষ গোষ্ঠীর জনসাধারণের আচার-আচরণ বিচারের সমর্থন লাভ করেছে, কিন্তু অন্য এক গোষ্ঠীর আচার-আচরণ বিচারের সমর্থন লাভ করছে না৷ এখন যদি ওই বিশেষ বিচারে প্রথোমোক্ত গোষ্ঠীকে সভ্য ও অপর গোষ্ঠীকে অর্ধসভ্য ৰলি, তাহলে সেটাও যুক্তিযুক্ত হৰে না৷

ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থায়, নারীকে মায়ের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তাদের সেরকম সম্মান দেখানো হয় না৷ অপরপক্ষে ইয়ূরোপীয় সমাজে যদিও মায়ের মর্যাদা নেই, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে নারীরা নিশ্চিতভাবে পুরুষের সমান অধিকার ও সম্মান ভোগ করে থাকেন৷ এখন এই দু’টোর মধ্যে কোনটি অধিকতর সভ্য, এটা ৰলা খুবই শক্ত৷ এক্ষেত্রে আমি ৰলবো, কাজ-কর্মে, আচার-আচরণে বিচারের সমর্থন যতটা ৰেশী থাকৰে, সভ্যতার প্রকাশ তথা বিকাশও তত বেশী হৰে৷

সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যেকার পার্থক্য খুব        সূক্ষ্ম৷ সংস্কৃতি জীবনের সকল অভিব্যক্তির সামূহিক রূপ৷ সংস্কৃতি ৰৌদ্ধিক স্তরের অভিব্যক্তি, কিন্তু সভ্যতা জীবনের ভৌতিক দিকটার প্রকাশ৷ সুতরাং একজন মানুষ ভৌতিক উন্নতির ব্যাপারে সভ্য হত পারে , কিন্তু তার মানসিক বিকাশের দিকটা বিচার করলে সে উন্নত সংস্কৃতি সম্পন্ন নাও হতে পারে৷ বস্ততঃ ৰৌদ্ধিক বিকাশ না হলে একজন মানুষের পক্ষে যথার্থ সভ্য হওয়া সম্ভব নয়৷

সভ্যতার বিকাশ কেমন করে ঘটে? সভ্যতার সঙ্গে বিজ্ঞানের একটা ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে, একই সঙ্গে এই দু’য়ের উন্নতি হয়৷ কিন্তু যেখানে বৈজ্ঞানিক উন্নতি, সভ্যতার উন্নতিকে পিছনে ফেলে যায়, সেখানেই সভ্যতার  ভরাডুবি ঘটে৷ উদাহরণ হিসাবে মিশর ও গ্রীসের ইতিহাসের কথা ধরা যাক৷ যতদিন এই দুই দেশের বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, সভ্যতার অগ্রগতি অব্যাহতই ছিল৷ কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতিতে যখন ভোগ্য-সামগ্রী প্রচুর পরিমাণে ৰেড়ে গেল, তখনই উভয় দেশের সভ্যতা ক্রমে ধবংস হয়ে গেল, কারণ তখন বিজ্ঞান সভ্যতার ওপরে স্থান অধিকার করেছে৷

বিজ্ঞান কী? যা বস্তুর যথাযোগ্য ব্যবহার শিখিয়ে দেয় তাই বিজ্ঞান৷ সভ্যতার বিকাশ যেখানে একেবারেই নগণ্য, সেখানে যদি বিজ্ঞানের অগ্রগতি উন্নতির উচ্চতম শিখরে পৌঁছায়, সেখানে বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে ধবংসেরই পথ প্রশস্ত করে৷ সুতরাং বিজ্ঞানের গবেষণা ও চর্র্চ যদিও অপরিহার্য তবুও একে সভ্যতার ওপরে স্থান দেওয়া মোটেই সঙ্গত কাজ নয়৷

এখন আমি তোমাদের ৰোধি-জ্ঞান সম্পর্কে দু’চার কথা ৰলবো৷ ভারতবর্ষে তন্ত্রের যুগ থেকে শুরু করে গুপ্তযুগ পর্যন্ত সভ্যতা ও বিজ্ঞান পাশাপাশি বিকাশ লাভ করে চলছিল বিজ্ঞান কখনই সভ্যতার থেকে বেশী সম্মান পায়নি৷ গুপ্তযুগ ভারতের সুবর্ণ যুগ৷ গুপ্তযুগের পর বিজ্ঞানের উন্নতির দিকে নজর দেওয়া হয়নি৷ এরফলে হয়েছিল ক্রমাবনতি ও অধঃপতন৷ পাঠান যুগে সভ্যতা ও বিজ্ঞান কোনটিরই বিকাশ হয়নি, তাই সে যুগে সমাজের উন্নতিও স্তব্ধ ছিল৷

মানব সমাজের সার্বিক প্রগতির তথা উন্নতির জন্যে সভ্যতা ও বিজ্ঞান উভয়কে একই সঙ্গে প্রোৎসাহিত করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হৰে৷ যেখানেই তুমি সভ্যতার উন্নতি দেখৰে, সেখানেই লক্ষ্য করৰে বৌদ্ধিক উন্নতি এর সঙ্গে রয়েছে৷ আবার যেখানে  বিজ্ঞানের চর্র্চ রয়েছে, সেখানেও ৰৌদ্ধিক বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন৷ তাই সভ্যতা ও বিজ্ঞান উভয়ের ক্ষেত্রেই বৌদ্ধিক জ্ঞান অপরিহার্য৷ সভ্যতা ও বিজ্ঞানের সুন্দর সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই আধ্যাত্মিক ও ৰোধি জ্ঞানের বিকাশ সম্ভব৷ যেখানে সভ্যতা ও বিজ্ঞানের সমন্বয় আদৌ নেই, সেখানেও ৰোধিজ্ঞানের বিকাশ সম্ভব হলেও, সভ্যতা ও বিজ্ঞানের মধ্যে সুষম সমন্বয় থাকলে, আধ্যাত্মিক প্রগতি ত্বরান্বিত হৰে৷ সুতরাং যাঁরা জ্ঞানী তাঁরা এই দু’য়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেই প্রগতির পথে এগিয়ে চলৰেন৷ এই দু’য়ের মধ্যে সম্বন্বয় সাধন ছাড়া ৰোধির জগতে প্রকৃত প্রগতির কথা চিন্তা করা অর্থহীন ৷

আজ আমাদের কর্তব্য কী? আমরা বিজ্ঞানের চর্র্চ করৰো, কিন্তু সেই সঙ্গে সভ্যতার উন্নতির দিকেও সমান লক্ষ্য রাখতে হৰে৷ প্রাচীন ভারত ও আধুনিক ভারতের মধ্যে একটা তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যাৰে আজকের যুগের বিজ্ঞানের উন্নতি সে-যুগের বিজ্ঞানের উন্নতি থেকে অনেক ৰেশী৷ কিন্তু সে যুগের সভ্যতা, বিশেষ করে বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র ও অষ্টাবক্র মুনির যুগে সভ্যতা অবশ্যই অনেক উন্নত স্তরের ছিল৷ আজকের যুগে সভ্যতা ক্ষয়িষ্ণু, কারণ বিজ্ঞান পাচ্ছে সভ্যতার চেয়ে উচ্চতর মর্যাদা৷ আজকে বিজ্ঞানের উন্নতির মত, যদি সভ্যতাকেও উঁচুতে তুলে ধরা যায়, তাহলে উন্নতির চরম শিখরে ওঠা সম্ভব হৰে৷

(মূল ইংরেজী থেকে অনূদিত)