সদ্‌গুরুর দুর্লভ সান্নিধ্যে সাধক কমলাকান্তের মুক্তিলাভ

সংবাদদাতা
নিজস্ব সংবাদদাতা
সময়

গত ১৯শে মে জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে বাঁকুড়া জেলার পাত্র সায়ের ব্লকে বেতুল গ্রামের শ্মশানে সাধক কমলাকান্তের সমাধি লাভের দিনটি প্রভাতসঙ্গীত, ৰাৰা নাম কেবলম্‌ কীর্ত্তন, মিলিত সাধনা ও তারপর দিনটির ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য সম্বন্ধে আলোচনা করে আচার্য সত্যনিষ্ঠানন্দ অবধূত৷

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ৮৩ বছর আগে জ্যৈষ্ঠ মাসে এই শ্মশানে ঘটেছিল এমনি এক ঘটনা আপাত যুক্তিতে যার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না৷ বলাবাহুল্য ঘটনার মধ্যমণি ছিলেন তরুণ শ্রীপ্রভারঞ্জন সরকার, যিনি পরবর্তীকালে মহান দার্শনিক ও ধর্মগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি রূপে সারা বিশ্বে বন্দিত৷ ঘটনাটি তিনি নিজেই তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন৷ সেটি ছিল সংক্ষেপে এইরূপ ০০ঃ ১৯৪০ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে নিমন্ত্রিত তরুণ প্রভাতরঞ্জন গিয়েছিলেন বাঁকুড়া জেলায় পাত্রসায়ের ব্লকের বেতুল গ্রামে৷ বিয়েটা ছিল বন্ধুর বাড়ী থেকে আট দশ মাইল দুরে৷

বন্ধুর সঙ্গে প্রভাতরঞ্জন বরযাত্রী হয়ে রওনা দিয়ে পৌঁছলেন বিয়ে বাড়ীতে৷ বিয়ের লগ্ণ ছিল মধ্যরাতে৷ বিয়েবাড়ীর হই হট্টগোলের মধ্যে থেকে নির্জনতার খোঁজে প্রভাতরঞ্জন টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বেড়াতে মেঠো পথ ধরে, প্রায় মাইল তিনেক যাওয়ার পর একটি প্রকাণ্ড ডাঙ্গার দেখা পেলেন যার ত্রিসীমানায় কোন জনবসতির চিহ্ণ নেই৷ ডাঙ্গাটার মাঝে মাঝে রয়েছে ছোট ছোট ঝোপঝাড়৷ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে দু’একটি শেয়াল৷ বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে কয়েকটা আমলকী, শেওড়া, মহুয়া ও পলাশ গাছ৷ বেড়াবার নেশা ছাড়া সচরাচর এমন নির্জন জায়গায় কেউ আসে না৷ ডাঙ্গাটাতে গোরুর ও মানুষের খুলি ইতস্তত ভাবে ছড়িয়ে আছে৷ প্রভাতরঞ্জন বুঝলেন এটি একটি যুগপৎ ভাগাড়ও শ্মশান৷ মাঝে মাঝে শ্মশান পেঁচার আওয়াজ---ভুতুম পেঁচায় হুম হুম শব্দ৷ গা ছমছমে জমাট অন্ধকার, বিভীষিকাময় পরিবেশে নির্লিপ্ত প্রভাতরঞ্জন বিভীষিকার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য একটু পরিস্কার জায়গায় দেখে বসে পড়ল৷ কিছুক্ষণ পর প্রভাতরঞ্জনের মনে হল দূর থেকে একটি ছায়ামূর্ত্তি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে৷ সে জিজ্ঞেস করল কে তুমি? ছায়মূর্ত্তি একটু থেমে উত্তর না দিয়ে গান গাইতে গাইতে আবার চলতে শুরু করল

‘‘সাঙ্গ হল জীবনখেলা/ ভাঙ্গলরে ভাই ভবের মেলা

ভবের মানুষ চল রে ফিরে চল’’৷ বেশ সুরেলা কন্ঠ৷ প্রভাতরঞ্জন সরকার ছায়ামূর্ত্তিকে তার নাম জিজ্ঞেস করলে সে সামনে এসে বললে ঃ

‘‘বাবু পথেই আমার ঘর’’ /‘‘পথিক আমি পথেই বাসা আমার যেমন যাওয়া তেমনি আসা’’ ---অবশেষে জানা গেল তার নাম কমলাকান্ত মহাপাত্র৷ বাড়ী চান্ডিল থানায়৷ প্রভাতরঞ্জনের অনুরোধে কমলাকান্ত তার সুরেলা কন্ঠে পাঁচ/ছয়টি গান গাইল৷ তার গানে কি যেন একটা যাদু আছে৷ যা শ্মশানের অন্ধকারে স্বর্গের মাধুরীকে টেনে আনতে পারে৷ কমলাকান্তের প্রশ্ণে প্রভাতরঞ্জন কোন গ্রামের বিয়ে বাড়ীতে বরযাত্রী হয়ে এসেছে বলতে সে দেহাতি ভাষায় বললে অনেক দূর থেকে আসছেন, ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন একটু শুয়ে পড়েন৷ বিশ্রাম নেন৷ আমি আপনার পা টা একটু টিপ্যে দিই আরও তো হেঁটে যেতে হবেক৷’’

প্রভাতরঞ্জন বললেন--- ‘‘যতই ক্লান্ত হইনা কেন একজন বয়স্ক লোক আমার পা টিপে দেবে এটা আমি উচিত মনে করিনা৷ কমলাকান্তের একান্ত পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত প্রভাতরঞ্জন তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন৷ শেষ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে তীব্র পায়ের যন্ত্রণায় প্রভাতরঞ্জন উঠে দেখেন কমলাকান্ত দুহাতে তার পা চেপে ধরে আছে, যেখানটিতে তারা কোলে মাথা রেখে শুয়েছিলেন সেখানে তিনটি নর করোটি রাখা আছে৷ প্রভাতরঞ্জন ডাকলেন কমলাকান্ত ও কমলাকান্ত, ঘুমোচ্ছ না কি? তোমাকে যে বললুম বয়স্ক লোক আমার সেবা করুক এ আমি চাই না৷ তবু তুমি আমার কথা শুনলে না!! কমলাকান্তর তবু সাড়া নেই৷ কমলাকান্ত এত জোরে তার পা চেপে ধরেছে যে স্বাভাবিক রক্তচলাচল ক্রিয়া ব্যাহত হবার ফলে যন্ত্রণায় প্রভাতরঞ্জনের ঘুম ভেঙ্গে যায়৷ এত ডেকেও সাড়া না দেবার ফলে প্রভাতরঞ্জন কমলাকান্তের পায়ে সামান্য ধাক্কা দেওয়া মাত্রই তার শরীরে উল্টে পড়ল৷ তার শরীরে  প্রাণের কোন স্পন্দন নেই৷ সর্বাঙ্গ হিমশীতল.... কমলাকান্ত এ জগতে নেই৷ পথেই  যার বাসা বিশ্ব পথে সে আর কোথাও গেছে৷ সে চলেছে... চলেই চলেছে--- ভবের মানুষ হয়তো বা পথ ছেড়ে কোন অজানা ঘরের পানে চলেছে৷ উপর্যুক্ত ঘটনার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা বুদ্ধিমান পাঠকের কাছে সহজেই অনুমেয়৷ পদার্থ বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন চুম্বকের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে লৌহখণ্ড আবিষ্ট চুম্বকে পরিণত হয়৷ কবির কল্পনায় স্পর্শমণিও লোহাকে সোনায় পরিণত করে৷ সদ্‌গুরুর সুদুর্লভ সান্নিধ্যেও মুমুক্ষু মানুষ মুক্তি মোক্ষ লাভ করেন৷ আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা পরক্ষীত সত্য৷