৭০তম প্রজাতন্ত্র দিবসের উপলব্ধি

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

গত২৬শে জানুয়ারী  ভারতবর্ষের ৭০তম প্রজাতন্ত্র দিবস সারাদেশে মহাসমারোহে উদ্যাপিত হলো৷ কেন্দ্রীয় সরকারের দিল্লীর মূল অনুষ্ঠান , সমস্ত রাজ্যসরকারের নিজস্ব অনুষ্ঠানসহ দেশের সব জেলা, ব্লক, সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা, এমনকি পাড়ায় পাড়ায়  বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ক্লাব ইত্যাদি পর্যায়ে এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কুচকাওয়াজ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,নেতা-নেত্রীগণের ভাষণ, রক্তদান শিবির, দুঃস্থদের বস্ত্র বিতরণ ও বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক কাজকর্ম প্রভৃতির আয়োজন সূচারুরূপে সম্পন্ন হলো৷ নেতা-নেত্রীগণের বক্তব্যে বলা হলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রজাতান্ত্রিক তথা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা, সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকার ও দায়িত্বের কথা, দেশসেবার জন্যে নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের কথা ইত্যাদি ইত্যাদি৷ সবকিছু মিলিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে  রাষ্ট্রীয় মহোৎসবের পরিবেশে  অতিবাহিত হলো  একটি কর্মব্যস্ত ছুটির দিন৷

১৯৪৭সালের ১৫ই অগাষ্ট দেশভাগের কলঙ্ক ও রক্তস্নান সঙ্গে নিয়ে ভারতবর্ষ রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন দেশীয় নেতৃবৃন্দের সামনে প্রথম প্রশ্ণ ছিল-দেশকে কিভাবে, কোন পথে  এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে? তাই স্বাধীন ভারতবর্ষের সংবিধান রচনার প্রয়োজন অনুভূত হলো ও                                            ডঃ বি.আর.আম্বেদকরের নেতৃত্বে একটি কমিটির উপর  সংবিধান রচনার দায়িত্ব  অর্পিত  হলো৷ এরপর ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী থেকে  ডাঃ আম্বেদকরের নেতৃত্বে রচিত ভারতীয় সংবিধান চালু হলো ও  ভারতবর্ষকে একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হল৷ ভারতীয় সংবিধানের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশাল এই দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী, বহু ধর্মমতাবলম্বী, ঐতিহ্য সংসৃকতির বিভিন্নতা বিশিষ্ট দেশবাসীকে  সামাজিক ন্যায় ও সুবিচার  তথা সুশাসনের মাধ্যমে একটি সুন্দর, নিরাপদ, শোষণহীন রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রদান করা৷  এই উদ্দেশ্যে তৈরী হল আইনসভা (লোকসভা, রাজ্যসভা, বিধানসভা), বিচারসভা( সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট থেকে নিম্নস্তরীয় কোর্ট পর্যন্ত)  ও নির্বাচন কমিশন (যার দায়িত্ব হল ভারতীয় গণতন্ত্রে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা) প্রভৃতি৷ এছাড়াও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গণমাধ্যম ও  স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যারা নাগরিকদের অভাব অভিযোগ, চাওয়া পাওয়া,সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগ ইত্যাদি সম্পর্কে জনসাধারণ ও প্রশাসনকে অবহিত করার দায়িত্ব পালন করে ও  প্রয়োজনে নাগরিকদের সাহায্যার্থে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে৷

বর্তমানে ভারতবর্ষের জনসংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি আর এই ৭০ বছরে বিপুল সংখ্যক দেশবাসীর বহুবিধ প্রয়োজন পূর্তির উদ্দেশ্যে  ভারতীয় সংবিধানে  বিভিন্ন সময়ে  বহু ধারার  সংশোধন, পরিবর্তন, সংযোজন  করা হয়েছে৷ কিন্তু এই ৭০ বছরেও ভারতবর্ষের সব মানুষের জন্যে অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-বাসস্থান-শিক্ষার সুযোগ সুবিধা পূর্ণমাত্রায় প্রদান সম্ভব হয়নি৷ এখনো দেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ পেটে খিদে নিয়ে ঘুমোতে যায়,  বহু মানুষ দুবেলা খাবার পায় না৷  কর্মসংস্থানের নিশ্চিততা না থাকায়  লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিনযাপন করতে বাধ্য হয়৷ বিশাল দেশের বেশিরভাগ অংশই গ্রামাঞ্চল যেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার পরিকাঠামো ঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি৷  তাই অনাহার, অর্ধাহার ও অপুষ্টির সঙ্গে রোগভোগ ও অশিক্ষার অন্ধকার সাধারণ ব্যাপার৷ এমন কি শহরাঞ্চলেও হাজার হাজার মানুষ রেল প্ল্যাটফর্মের কোণে, ব্রিজের তলায়, রেললাইন ও রাজপথের ধারে ঝুপড়িতে বা খোলা আকাশের নিচে শীত,গ্রীষ্ম, বর্র্ষয় বাস করতে বাধ্য হয়৷ এইসব মানুষেরা নূন্যতম নাগরিক পরিষেবা থেকে বঞ্চিত---যদিও তারা এই দেশেরই নাগরিক৷ দেশের নির্বাচনে তাদেরও অংশগ্রহণ করা, বোট দান করা নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে৷ প্রকৃত শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে  নাগরিক চেতনা ও রাজনৈতিক সচেতনতা জাগ্রত না হলে তাদের পক্ষে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন করা সম্ভব নয়৷  শুধু তাই নয়, এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে অর্থশক্তি ও পেশি শক্তির সাহায্যে দুর্নীতি পরায়ণ প্রার্থীরা তাদের ভুল পথে চালিত করে ও  ছাপ্পাবোট,বৈজ্ঞানিক রিগিং,ভূয়ো বোটার,ইত্যাদির মাধ্যমে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করে৷ এক্ষেত্রে  গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যই ব্যহত হয় ও দেশের নাগরিকগণ রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি ও ধান্দাবাজির শিকার হন৷ ফলে গণতন্ত্রের মূলনীতি ‘‘জনগণের জন্যে, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার’’ এই তত্ত্বটি খারিজ হয়ে গিয়ে গণতন্ত্র একটি প্রহসনে পরিণত হয়৷ ভারতবাসী রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না পাওয়ার কারণে  সাধারণ মানুষ  পুঁজিপতি ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের  দ্বারা ক্রমাগত  শোষিত, বঞ্চিত, প্রতারিত হচ্ছেন৷ দেশের অর্থনীতির মূল চাবিকাঠিটি  থাকে ধনী পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের হাতে৷ নির্বাচনী ব্যয়ভার নির্বাহের জন্যে রাজনৈতিক দলগুলি এইসব সম্পদশালীদের উপর নির্ভর করে ও নির্বাচনের পর তাদের সুবিধার্থেই দেশের অর্থনীতিকে  পরিচালিত করে৷

প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান দেশের সমস্ত নাগরিককে মাতৃভাষার ব্যবহার ও উন্নতিসাধন, ধর্র্মচরণ ও মত প্রকাশের সমান অধিকার প্রদান করে৷ বহু ভাষা ব্যবহারকারী, বিভিন্ন ধর্মমতের জনগোষ্ঠীর বাস এই বিশাল দেশ ভারতবর্ষে৷ প্রতিটি মানুষ তার মাতৃভাষাকে মাতৃজ্ঞানে সম্মান করে ও ভালবাসে৷ সেই  কারণে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে সব ভাষার উন্নতির চেষ্টা না হলে বা কোন ভাষা অবদমিত হলে, সেইসব ভাষার জনগোষ্ঠীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে৷ কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসাবে প্রচার করে’ বিভিন্ন প্রদেশের ভাষাকে অবদমন করার এক আগ্রাসনমূলক অপচেষ্টা চলছে৷ এরফলে আঞ্চলিক ভাষাগুলি দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর সেই ভাষাভাষী মানুষের মনে ক্ষোভ বিক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে৷ এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব সদর্থক না হওয়ায় সারাদেশে হিন্দি আগ্রাসন বেড়েই চলেছে, যার পরিণামে  বিভিন্ন প্রদেশে বিদ্রোহের আগুন একসময়ে ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে ও গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিও দেখা দিতে পারে৷

দেশের নেতা-নেত্রীদের ভাষণে নৈতিকতা, দেশসেবা ও আত্মত্যাগের কথা শোণা যায়৷ স্বাধীনতার পূর্বে ও স্বাধীনতার পরের কয়েক বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে  দেশসেবা, আত্মত্যাগ ও নৈতিকতা, দেশবাসীর প্রতি ভালবাসা ও স্বদেশ প্রেমের পরিচয় পাওয়া যেত৷ সময় যত এগিয়ে চলেছে তার সঙ্গে সঙ্গে নেতানেত্রীদের মনেও এসেছে পরিবর্তন৷ রাজনৈতিক স্বার্থ ও দলীয় রাজনীতির অঙ্কই বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে৷ শুধুমাত্র নির্বাচনী প্রচার ও স্বার্থসিদ্ধির সম্ভাবনা থাকলেই দেশসেবার বুলি তাদের মুখে শোণা যায়---তখন তারা সর্বশ্রেষ্ঠ দেশসেবক, করজোড়ে দণ্ডায়মান জনদরদী মানুষ, আর স্বার্থপূর্তি হয়ে গেলেই তাঁরা অন্যমূর্তি ধারণ করেন ও জনগণকে আর চিনতে পারেন না৷ তখন দল, গোষ্ঠী বা ব্যষ্টিগত লাভ ক্ষতির হিসাবটিই ধ্যান ও জ্ঞান৷ এক্ষেত্রে নৈতিকতার কোন ধারই তারা ধারেন না, এমনকি দল ও ব্যষ্টিগত স্বার্থের জন্যে তাঁরা বহুলোকের ক্ষতিতেও পিছপা হন না৷

ভারতবর্ষের সংবিধান প্রতিটি ভারতবাসীকে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার প্রদান করেছে৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, শাসকগোষ্ঠীর অপশাসনের প্রতিবাদে বা অনৈতিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে সরব হলেই প্রতিবাদীকে বিভিন্নভাবে হেনস্থা করা হয়, এমনকি দেশদ্রোহী হিসেবেও চিহ্ণিতকরণের প্রচেষ্টা চলে---যেন দেশ বা জাতি সম্পর্কে শুধুমাত্র শাসকগোষ্ঠীর প্রতিভূরাই শুভচিন্তার ইজারা নিয়েছেন,অন্যকারোর এই অধিকার বা সামর্থ নেই৷  এই ভাবনারই প্রতিফলন দেখা যায় বিভিন্ন সরকারী এজেন্সী ও সংস্থার মাধ্যমে মুক্তচিন্তার ধারাকে প্রতিহত করার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যার সঙ্গে যুক্ত থাকেন মূলতঃ শাসকগোষ্টীর সদস্যগণ৷

এছাড়া শিল্প-সংসৃকতি-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও নিজেদের পছন্দসই বিষয়বস্তু বা শিল্প ভাবনা না থাকলে  কোনো একটা হুজুগ তুলে  গণ্ডগোল পাকানোর ব্যবস্থা করা হয়, ও সন্ত্রাসের আবহ সৃষ্টি করা হয়৷ বিভিন্ন গণমাধ্যম, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও স্বাধীনচেতা ব্যষ্টিবর্গ, যাঁরা শাসকদের মতের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেন তাঁদের ওপর নজর দারী ও খবরদারী করার প্রবণতাও পরিলক্ষিত হয় প্রতিনিয়ত৷  সুস্থ গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা কখনোই কাম্য নয়৷

ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের ও ধর্র্মচরণের সঙ্গে যুক্ত৷ তাঁদের ঐতিহ্য ও সংসৃকতি অনুযায়ী আইনানুগ ও সংবিধান সম্মতভাবে খাদ্যাভ্যাস,পোশাক পরিচ্ছদের ব্যবহার ও ধর্মাচরণের অধিকার রয়েছে৷ কিন্তু বিগত কয়েকবছর ধরে দেখা যাচ্ছে গোরক্ষা, গোহত্যা, গোমাংস ভক্ষণ, বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতি, পোশাক পরিধেয় ইত্যাদি নিয়ে দেশের বহু স্থানে স্বঘোষিত নীতিপুলিশদের দাপাদাপি, দাঙ্গা, হাঙ্গামা ও হিংসাশ্রয়ী জনতার সন্ত্রাস৷ এইসব সন্ত্রাসের ঘটনায় বহু নিরীহ মানুষের নিহত ও আহত হওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমগুলির শিরোনামে এসেছে৷ এছাডা তথাকথিত ধর্মবিষয়ক  অসহিষ্ণুতা, অবিশ্বাস, বিদ্বেষ, মন্দির মসজিদ বিবাদ ইত্যাদি ঘটনাক্রম দেশের মানুষের মধ্যে বিভাজন ও শত্রুতার পরিমণ্ডল রচনা করেছে৷ দেশবাসীর মধ্যে এই বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার ক্ষেত্রে শাসক বিরোধী সব দলই সক্রিয়৷ এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংরক্ষণের রাজনীতি৷ সংবিধান প্রণেতারা  সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ‘সামাজিক বৈষম্য’কেই  অগ্রাধিকারের ভিত্তি হিসাবে  গ্রহণ করেছিলেন ও  বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীকে টেনে তুলে সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে আসার জন্যে  স্বল্পকালীন সংরক্ষণের সংস্থান রেখেছিলেন৷  কিন্তু এই ৭০ বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নদল  প্রশাসনে এসেছেন ও তাঁরা শিক্ষা, চাকুরী, পদোন্নতিতে এই সংরক্ষণের কাল ও মাত্রাকে ক্রমশ বাড়িয়ে গেছেন তাঁদের বোটব্যাঙ্ককে সুরক্ষিত ও প্রসারিত করার লক্ষ্যে৷ অতিসম্প্রতি ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে উচ্চবর্ণের গরিবদের জন্যে (যাদের পরিবারের চাষ ও অন্য পেশা থেকে প্রাপ্ত আয় ৮লক্ষ টাকার কম ও অন্যান্য যোগ্যতা মান অনুযায়ী) সরকারী চাকরী ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১০শতাংশ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সংসদে বিল  পাশ হয়ে গেছে৷ বর্তমানে তফশিলি জাতি ১৫শতাংশ, তফশিলি জনজাতি ৭.৫ শতাংশ ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী (ওবিসি) ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের সুবিধা ভোগ করেন৷ তার সঙ্গে এই ১০ শতাংশ যুক্ত হলে মোট আসন সংরক্ষিত হবে ৫৯.৫ শতাংশ৷ কিন্তু সংরক্ষণের বিষয়ে ১৯৯২ সালে ইন্দ্রা সাহানে মামলায় সুপ্রিমকোর্টের একটি রায় অনুযায়ী সংরক্ষণের মাত্রা কোনভাবেই ৫০ শতাংশের বেশি করা যাবে না৷ সুপ্রিমকোর্টের এই রায়কে ভিত্তি করে ইতোমধ্যে সুপ্রিমকোর্টেই কয়েকটি মামলা করা হয়েছে৷ সুপ্রিমকোর্ট এই বিষয়ে কেন্দ্রের বক্তব্য জানার জন্যে নোটিশও পাঠিয়েছে৷

এমতাবস্থায় প্রশ্ণ হল এই যে রাজনৈতিক অভিসন্ধিসঞ্জাত এই ধরণের সংরক্ষণের সিদ্ধান্তে একশ্রেণীর মানুষকে কিছু সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে, শাসকদলের অনুগামী করার প্রচেষ্টা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়৷ এরদ্বারা দেশের কোন উপকার তো হয়ই না, বরং দেশবাসীদের মধ্যে বিভাজন ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়৷ সমাজের একটা অংশ সর্বদা সুবিধা পেতে থাকলে অপর অংশ মেধা ও সামর্থ থাকা সত্ত্বেও  বঞ্চিত হতে বাধ্য হয়৷ এরফলে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে উন্নত মেধার অভাব দেখা দেয়৷ এরপরিণামে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রার মধ্যে  হতাশাজনিত ক্ষোভ ও গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা ভবিষ্যতে বিশাল দাবানলের আকার পরিগ্রহ করতে পারে৷ তাই রাষ্ট্রযন্ত্রকে সদ্ব্যবহার করে  প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও মনুষ্যমেধা সম্পদের সম্পূর্ণ উপযোগ নিতে হবে যাতে কেউ বঞ্চিত না হয়৷ সুপরিকল্পিত নীতি নির্ধারণের দ্বারা সমস্ত মানুষের কাছে অন্ন,বস্ত্র,বাসস্থান,চিকিৎসা,শিক্ষার সংস্থান পৌঁছে দিতে হবে৷ কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থে দেশের অর্থনীতিকে পরিচালিত করে পুঁজিপতি, শিল্পপতিদের সম্পদ বৃদ্ধি করলে চলবে না---সেই সম্পদ যাতে দেশবাসীর প্রকৃত উন্নয়নে ব্যয়িত হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে৷ জনগণের করের টাকা কতিপয় সুবিধাভোগীদের স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়া সুস্থ রাষ্ট্রচিন্তার পরিচায়ক নয---ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তো কখনই নয়৷ শুধু তাই নয়, ব্যাঙ্কশিল্পের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বৃহৎশিল্পগোষ্ঠীরা আত্মসাৎ করে ব্যাঙ্কগুলিকে দুর্বল করে দিচ্ছে আর সরকার সেইসব দুর্বল ব্যাঙ্ককে জনসাধারণের প্রদত্ত করের টাকা যোগান দিতে গিয়ে উন্নয়নের গতিকে শ্লথ করে দিচ্ছেন ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তথা উপযুক্ত ঋণগ্রহীতাগণ ব্যাঙ্কঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন৷ বিজয় মাল্য, নীরব মোদি, মেহুল চোক্সী প্রমুখদের মতো বহু শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী ব্যাঙ্কের হাজার হাজার কোটি টাকা  প্রতারণা করে বিদেশে পালিয়ে গেছে৷ এইসব প্রতারক ও ঋণখেলাপীদের বিরুদ্ধে  কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে৷ যাতে উদ্ধার করা অর্থ দেশের মানুষের উন্নয়নে লাগানো যায়৷ শুধুমাত্র নোটবন্দির মতো সর্বনাশা পদক্ষেপ, বছরে দু’কোটি চাকুরী,কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেকের এ্যাকাউন্টে ১৫লক্ষ টাকা জমা বা সর্বশেষ সংরক্ষণের চটকদারি ঘোষণা ও মানুষকে প্রলোভনের ফাঁদে জড়ানোর অপচেষ্টা না করে উপযুক্ত পরিকল্পনা ও তার সদর্থক রূপায়ণ করতে হবে৷ দলীয় বোটব্যাঙ্কের রাজনীতি, পুঁজিপতিদের কোষাগার পূর্ণকরার আত্মঘাতী প্রয়াস ও সাধারণ মানুষের সর্বনাশের পথ পরিহার করে সংবিধান প্রদত্ত অধিকার ও সুবিধা সকলকে উপভোগ করার স্বাধীনতা ও সুযোগ করে দেওয়াই দেশনেতৃত্বের কর্তব্য হওয়া একান্ত প্রয়োজন৷

সংবিধান চালু হবার ৭০ বছরেও সকল দেশবাসীকে সংবিধান প্রদত্ত  সমস্ত সুযোগ, অধিকার ও  নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্তি র ব্যবস্থা না করতে পারার মূল কারণ হচ্ছে সত্যিকারের দেশসেবক ও দেশপ্রেমিক মানুষের অভাব৷ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে যারা রাজনীতিতে আসেন তাঁরা দেশসেবার নামে ব্যবসা করেন৷ সংবিধান যত ভাল হোক না কেন, তাকে প্রয়োগ করবে মানুষ৷ মানুষ যদি সৎ, নীতিবাদী, জনদরদী, দেশপ্রেমিক না হয় তবে তার পক্ষে  সংবিধানকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়, কারণ লোভের বসে তার বিপথগামী হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ ছুরি-কাঁচির সাহায্যে একজন ডাক্তার মানুষকে বাঁচায়, অথচ একজন ডাকাত মানুষকে মেরে ফেলে,সর্বস্ব কেড়ে নেয়৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজে প্রভূত উন্নতি করা যায় কিন্তু অপরপক্ষে মারণাস্ত্র তৈরী করে মূহূর্তের মধ্যে  অসংখ্য মানুষকে নিধনও করা যায়৷ তাই প্রকৃত সৎ, ধার্মিক,নীতিবাদী মানুষ তৈরী করাই প্রথম কর্তব্য৷ তারপর পৃথিবীর সমস্ত সম্পদকে সর্বাধিক উপযোগের মাধ্যমে সব মানুষের কল্যাণে  নিয়জিত করাই আশু প্রয়োজন৷  এতদিন বৈশ্যতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ধনী হয়েছে আরও বিত্তবান আর দরিদ্র হয়েছে দীন-ভিখারী৷ জড়বাদী কম্যুনিজমের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ  মানুষকে নামিয়ে এনেছে পশুত্বের পর্যায়ে৷ তাই মানবসমাজের প্রকৃত কোনো উন্নতিই হয়নি৷ ইট, কাঠ,ইস্পাতে তৈরী ইমারত আর কলকারখানা উন্নতির লক্ষণ নয়৷ প্রকৃত উন্নতি হয় প্রতিটি মানুষের জাগতিক, মানসিক ও আত্মিক ত্রিবিধ উন্নতির মাধ্যমেই৷ আর এই উন্নত মানবমেধাকে জগতের কল্যাণে ব্যবহার করাই প্রকৃত সমাজ নির্র্মণের মূলমন্ত্র৷ এই উদ্দেশ্যে মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তন করেছেন সামাজিক-অর্থনৈতিক তত্ত্ব ‘প্রাউট’ বা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব৷ প্রাউটের ভিত্তি হলো আধ্যাত্মিকতা৷ আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন  না করলে নৈতিকতা ও মানবপ্রেম পরিপুষ্ট হতে পারে না৷  প্রাউটের অর্থনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ তথা আঞ্চলিক কৃষিজ,বনজ, খনিজ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদকে  কাজে লাগিয়ে ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনার সাহায্যে আঞ্চলিক অর্থনীতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা, যার ফলে স্থানীয় জনগণের ১০০ শতাংশ কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করা সম্ভব৷ উৎপাদন ও বন্টনের মাধ্যম হিসেবে সমবায় পদ্ধতির কার্যকর প্রয়োগ ও সমাজের প্রতিটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে কৃষি ওশিল্পে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদের উন্নতি ও সদব্যবহার করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ক্রমোন্নতির উপায় উদ্ভাবন করাই প্রাউট অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য৷ প্রাউটের আদর্শে রচিত সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন  আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত, নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত আপোসহীন বলিষ্ঠ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যষ্টিগণ, যাঁদের এককথায় বলা হয় ‘সদবিপ্র’৷ প্রাউট দর্শনের প্রয়োগে ও সদবিপ্র গোষ্ঠীর পরিচালনায় যে সমাজ গড়ে উঠবে সেখানে কোন শোষণের অবকাশ থাকবে না, জাত-পাত, ধর্মমত, বর্ণ-গোষ্ঠীগত ভেদাভেদকে কোনভাবেই উৎসাহিত করা হবে না, প্রত্যেকটি মানুষ পাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ ও নূ্যনতম প্রয়োজন মেটানোর নিশ্চিততা৷ এই সমাজ ব্যবস্থায় কোন সংরক্ষণের আবশ্যকতা থাকবে না৷ প্রাউট দর্শনের প্রতিষ্ঠার ফলে পুঁজিবাদী ও জড়বাদী দর্শনের সমস্ত ক্ষত নিরাময় সম্ভব হবে ও শোষণহীন সমাজ গড়ে উঠবে৷ তাই প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে  যথাসত্বর প্রাউট দর্শণের প্রতিষ্ঠাকল্পে এগিয়ে এসে  মানবসমাজ কে সমস্ত সংকীর্ণতার বন্ধন থেকে  মুক্ত করার কর্মযজ্ঞে যোগদান ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেই হবে৷