দুর্নীতিতে সারা দেশ ছেয়ে গেছে৷ কেন্দ্রীয় সরকার থেকে রাজ্যের পঞ্চায়েৎ স্তর পর্যন্ত সর্বত্র দুর্নীতির রাজ্যপাট চলছে৷ বলা বাহুল্য, ক্ষমতার সঙ্গে দুর্নীতির যোগসাজসটা সর্বাধিক৷ কারণ, ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই দুর্নীতির রাজ্যপাট বিস্তারের সুবিধা৷ প্রশাসনিক ক্ষমতার সাহায্য পেলে দুর্নীতির আর ভয়–ডর কিসের? এই কারণে শাসকদলের সঙ্গে দুর্নীতির গাঁটবন্ধন বেশী করেই দেখা যায়৷ আর এক্ষেত্রে কালোকে শাদা বলে চালানো খুব সহজসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়৷ ফল ভুগতে হয় জনসাধারণকে৷ শোণা যায়, আফ্রিকায় এক ধরণের বাদুড় রয়েছে, যা গোরু–মোষ প্রভৃতির শরীরের ওপর বসে তার রক্ত শুষে নিতে থাকে ও ধীরে ধীরে এমনভাবে পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে যাতে করে ওই পশুটির খুবই আরাম লাগে৷ সে বুঝতেই পারে না যে তার রক্ত খেয়ে নিচ্ছে৷ তারপর বাদুড়টি যখন পেট ভরে রক্ত খেয়ে উড়ে যায়, তখন ওই পশুটির চলবার শক্তি থাকে না৷ এই বাদুড়গুলোকে বলা হয় রক্তচোষা বাদুড়৷ বাস্তবে এই ধরণের বাদুড় থাক বা না থাক, সমাজে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে কর্মীরা এক একটি রক্ত চোষা বাদুড়৷ আর, মজাটা হচ্ছে এই যে, সর্বত্র এদেরই রমরমা, এদের কদরও সবচেয়ে বেশী৷ কারণ শোষণ করা অর্থ সম্পদ যৎসামান্য দান ধ্যান করে এরা সম্মান আদায় করে’ নিতে পারে৷ তাই দলে, প্রশাসনে এদের দাপট লক্ষ্যনীয় হয়ে ওঠে৷
এই রাজ্যের বিপ্লবী পার্টি সিপিএমের রাজত্বকালে বর্ধমানের কোলিয়াড়ী বেল্টের কুখ্যাত কয়লা মাফিয়া কালে সিং–রা আলো ঝলমল মঞ্চে ওঠে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে জনকল্যাণ বাবদ লক্ষ টাকার চেক তুলে দিয়ে হাততালি পায়৷ গরীব মানুষদের নানান্ উপায়ে বঞ্চিত করে–দেশকে ঠকিয়ে পয়সা কামানেওয়ালা প্রমোটার–ঠিকাদাররা শাসকদলের মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়৷ এদের সঙ্গে যোগসাজসে পার্টির আর এক ধরণের মূল্যবান সম্পদ রয়েছে যারা মারপিট করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে৷
আর কিছু এগিয়ে আমরা দেখব শাসকদলের সঙ্গে দোস্তী জমে ওঠে দেশী–বিদেশী বড় বড় পুঁজিপতিদের তথা বহুজাতিক কোম্পানীদের৷ ধীরে ধীরে গোটা দলের মাথাটাই ওই কর্পোরেট মালিকরা কিনে নেয়৷ তখন তো দুর্নীতির রাজ্যপাট শুধু বলব না, দুর্নীতির সাম্রাজ্যবাদ কায়েম হয়৷
দেশের প্রতিটি তথ্যাভিজ্ঞ মানুষ, সমাজ সচেতন মানুষেরই এসব জানা কথা৷ তাই এটা প্রমাণ করার জন্যে বেশি ঝক্কি নেবার প্রয়োজনই নেই৷ কারণ তা অনাবশ্যক৷
কিন্তু আসল প্রশ্ণটা হচ্ছে, এই ভয়ঙ্কর রোগের মূল কারণটা কী? কোথায় সমস্যার উৎস? সমস্যার সমাধানের পথটাই বা কী? এটাই জানা খুবই দরকার৷ নাহলে শুধু সমস্যার গাওনা গেয়ে লাভটাই বা কী? খবরের কাগজে, সেমিনারে সভায় যতই এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তর্জন গর্জন করা হোক না কেন, তাতে দুর্নীতিপরায়ণরা এতটুকু চিন্তিত নয়৷ কারণ এতে এদের সাম্রাজ্যবাদী কর্মধারা যথারীতি চালিয়ে যেতে কোনো অসুবিধাই হয় না৷
এই দেশজোড়া দুর্নীতির শুধু দেশজোড়াই বা বলি কেন, জগৎ জোড়া দুর্নীতির উৎসস্থল খুঁজতে গেলে বোঝা যায়, ম্যালেরিয়ার মশার জন্মস্থান যেমন নোংরা জল, এই দুর্নীতির উৎস তেমনি ত্রুটিপূর্ণ ‘শিক্ষাক্ষেত্র’৷ এ শিক্ষা যেমন সুক্ল কলেজের শিক্ষা, তেমনি বেতার–দূরদর্শন তথা আজকের তথাকথিত সাহিত্য–শিল্প–সংসৃক্ শিক্ষা৷ শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিকরা যাঁদের নিয়ন্ত্রক৷
জন্তু জানোয়াররা জন্মের পর থেকে জন্তু–জানোয়ারের সমস্ত গুণ বা বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকে৷ কিন্তু, মানুষ জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই যথার্থ মানুষ হয় না, তাকে সুশিক্ষার মাধ্যমে মানুষ করে তুলতে হয়৷ নাহলে মনুষ্যত্বের গুণগুলি তার মধ্যে ফুটে উঠে না৷ মনুষ্যেতর জীবরে মত আচরণেই সে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে৷ এটাই স্বাভাবিক৷ এটাই কঠোর সত্য৷ আজ সমাজের সর্বত্র যে ভোগসর্বস্বতা, নীতিবোধ বর্জিত ভাবে যে আপাতঃ আত্মসুখের লালসা তার মূল কারণ এই শিক্ষার ত্রুটি, আর তার ফলশ্রুতি সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি আর পাশবিক আচরণ৷ বর্তমানে আর এক শ্রেণীর শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা এসবের সমালোচনা করে হয়তো আত্মতুষ্টি লাভ করছেন, কিন্তু বুদ্ধিজীবীরাই তো এর জন্যে দায়ী৷ আজকের শিক্ষাবিদ্, শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, গায়ক–গায়িকা, অভিনেতা–ভিনেত্রীরা মানুষকে কী শেখাচ্ছেন? সমাজে তাঁদেরই তো প্রভাব অত্যন্ত বেশি৷ মানুষের যথার্থ আদর্শবোধের বীজ তাঁরা বপন করতে পারছেন কী? কঠোর সত্য কথা এই যে–তাঁরা তা পারছেন না৷ ৯৯শতাংশ ক্ষেত্রে সে চেষ্টাই তারা করেন না৷ তাঁদের গভীর দায়িত্বজ্ঞানহীন সৃষ্টি, রচনা বা কর্মধারাই যে সমাজে মারাত্মক কালব্যাধির সৃষ্টি করছে, তা তাঁরা হয়তো তলিয়ে ভাবছেন৬ না৷
বর্তমানে, সমাজের নিয়ামক হ’ল রাজনীতি৷ রাজনৈতিক দলগুলি মুখ্যতঃ শিক্ষা সংসৃক্তির মাধ্যমগুলি নিয়ন্ত্রণ করছেন৷ সেই রাজনৈতিক দলগুলি দেশের মানুষের মনে নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ ঘটাতে কতটা চেষ্টা করেন? ভোগবাদ তথা বস্তুতান্ত্রিকতা, যদি জীবনের দৃষ্টিভঙ্গী হয়, এই মানসিকতার বীজ থেকে যে গাছ হবে, তা বিষবৃক্ষ হতে বাধ্য, তা মনুষ্যত্বের বিকাশের পক্ষে–সুনীতি তথা মূল্যবোধের বিকাশের পক্ষে যে চরম অন্তরায় তা মানব মনস্তত্ব নিয়ে একটু গভীর বিশ্লেষণ করলেই সহজে বোঝা যাবে৷ ইতিহাসের শিক্ষাও তাই৷
রাজনৈতিক দলগুলি দেশ গড়ার বড় বড় শ্লোগান দেয়, কিন্তু দেশ গড়তে গেলে যে সর্বাগ্রে ‘মানুষ’ গড়তে হবে, প্রকৃত মানুষ–‘মনুষ্যত্ব’ সম্পন্ন মানুষই যে দেশগড়ার মূল উপাদান, এই সহজ সত্য কথাটা তাদের কোনোদিন বলতে শোনা যায় না৷ এনিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই৷ তাইতো প্রায় সব বড় বড় রাজনৈতিক দলে সৎ নীতিবাদী কর্মী বা ক্যাডারের দারুণ অভাব৷ আজকের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলির এটাই মুখ্য ত্রুটি৷ আর এই ত্রুটির জন্যে এই সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি নিয়ে মানুষ যতই মাতামাতি করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত আদর্শ সমাজ রচনায় ওই রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্ব চরমভাবে ব্যর্থ হয়৷ তাঁরা মানুষের মনে কখনও কখনও আশার আলো জ্বালালেও, শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয় না৷ এ যেন,–‘ক্ষণপ্রভা প্রভা দানে বাড়ায় মাত্র আঁধার পথিকে ধাঁধিতে’৷
হ্যাঁ, এই কথাটাই বিশেষ করে বলা হয়েছে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রাউট দর্শনে৷ নব্যমানবতাবাদ ভিত্তিক প্রাউট তাই সর্বাগ্রে মানুষ গড়ার কথা বলে৷ আর, কী করে সত্যিকারের মানুষ গড়তে হবে, সেই উপায়ও প্রাউট–প্রবক্তা দিয়েছেন৷ প্রধানতঃ প্রাউটের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই৷
তাই, দেশের ব্যাপক দুর্নীতি ও অনাচার–ব্যভিচার দেখে কেবল মাথা কুটলে চলবে না, বত্তৃণতার তুবড়ি ফাটালে চলবে না, রোগ নিরাময়ের প্রকৃত পথটাকেই জানতে হবে আর সেই পথে চলেই কাঙিক্ষত সমাজ গড়ে তুলবার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে৷ সেটাই হবে কাজের কাজ৷
এটা ঠিক যে, কঠোর শাসনব্যবস্থাও চাই, তবে সে শাসন ব্যবস্থা যাঁরা পরিচালনা করবেন, শাসনদণ্ডকে যারা প্রয়োগ করবেন, তাঁদের আরও কঠোরভাবে নীতিবাদে–মানবিক মূল্যবোধে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে৷ নাহলে রক্ষকই ভক্ষক হয়ে যাবে৷ যা আজকে চলছে৷
- Log in to post comments