আধ্যাত্মিকতা ও বিজ্ঞান

লেখক
দেবজিৎ ব্রহ্মচারী

একটি ছোট বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা বর্তমানে সমাজ সচেতন বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷ তাঁরা দেখতে পান, পরীক্ষাগারে একটি জলভর্তি জারের ভেতর একটি ব্যাঙ রেখে ধীরে ধীরে জারটিকে অধিক তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করায় জারটিতে থাকা জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি হতে থাকল৷ কিন্তু ব্যাঙটি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় নি৷ শেষে ফুটন্ত অবস্থায় আসার আগে ব্যাঙটি মারা যায়৷ আরেকটি পরীক্ষায়, যখন আর একটি ব্যাঙকে গরম জলের জারে ফেলে দেওয়া হল, সেটি তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে জারটির ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়৷ প্রথম পরীক্ষায় ব্যবহৃত ব্যাঙটি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত বিপজ্জনক পরিবেশ থেকে নিজেকে মুক্ত না করতে পারায় মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয়৷

আজকের মানব সমাজ একই রকম জটিল সমস্যার সম্মুখীন৷ সে নিজের অস্তিত্বকে ধীরে ধীরে ধবংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ৷ দিশাহীন মানুষ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই পৃথিবীকে বিনাশের দিকে ধাবিত করছে৷ আধ্যাত্মিক প্রাণপুরুষ মুনি-ঋষিদের হাত ধরে যে বিজ্ঞান-গবেষণা মানব সমাজকে উন্নতির দিশা দেখিয়েছিল তা আজ জড়বাদী স্বার্থান্বেষী ব্যষ্টিদের দৌলতে ধবংসাত্মক কাজে রত৷ বিজ্ঞান আজ অভিশাপ নামে আখ্যায়িত হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তাতে কিন্তু বিজ্ঞানের কোনো দোষ নেই৷ আধ্যাত্মিকতার অভাবে মানব সমাজ আজ অনেক পিছিয়ে পড়েছে৷ আর সভ্যতা পিছিয়ে পড়ায় মানুষ বিজ্ঞানকে যথার্থ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে৷ এই ভৌতিক বিজ্ঞান মানুষকে ক্রমশঃ জড়াভিমুখী করে চলছে৷ তাই মানুষ আজ অত্যধিক স্বার্থপরতা, ভয়, হিংসা ও কলহে হতাশাগ্রস্ত৷ এই রোগগ্রস্ত অসুস্থ মানুষের দ্বারা সুস্থ মানব সমাজ গড়ে উঠতে পারে না৷

তাই পরীক্ষাগারে সেই ব্যাঙের মত মৃত্যু পথগামী মানব জাতিকে উদ্ধার করার জন্যে ধর্মগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী তথা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর যুগোপযোগী দর্শনে যেমন বিশ্বৈকতাবাদের পাশাপাশি মানবজীবনের পরম লক্ষ্য সম্পর্কে পথ নির্দেশনা দিয়েছেন, তেমনি তাঁর এই মহান আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ নামে বিশ্ব সংঘটন ও তার সঙ্গে সঙ্গে সুদক্ষ কর্মী বাহিনীও তৈরী করেছেন যাঁদের জীবনের আদর্শ হ’ল--- ‘‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায়চ’’ অর্থাৎ ব্যষ্টিগত জীবনে আত্মমুক্তি ও জগতের সর্বাত্মক কল্যাণ সাধন৷ তাঁদের তিনি নাম দিলেন--- সদবিপ্র৷ যে লজ্জা , ভয়, ঘৃণা, শঙ্কা প্রভৃতি মোহমায়ার বন্ধনে আবদ্ধ সে কি কখনো বৃহত্তর মানব জাতির কল্যাণ সাধন করতে পারে? না, তা পারে না৷ তাই যে আধ্যাত্মিক মুক্ত-পুরুষ , যে মানসিকভাবে বলবান ও শারীরিক দিক থেকে সুস্থ সেই সদবিপ্রই জগতের প্রকৃত সেবা করতে পারে৷ তাই তিনি জীবকে ষড়রিপু-অষ্টপাশের বন্ধন থেকে মুক্ত করতে ও মানব জীবনের চরম লক্ষ্যে পৌছাবার উদ্দেশ্যে রাজাধিরাজ যোগসাধনা নামে এক অভিনব যোগসাধনা নতুনভাবে প্রবর্তন করেন৷ যার একমাত্র উদ্দেশ্য মনকে সূচ্যগ্র করে অনন্ত তথা ব্রহ্মত্বে মিলিয়ে দেওয়া--- আত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে এক করে দেওয়া৷ এখানে যোগ মানে একীভূত হওয়া অর্থাৎUnification ৷ আমরা জানি একীভূত হতে গেলে দুটিকে একইরকম গুণসম্পন্ন হতে হবে৷ যেমন--- দুধ ও জল--- দুটিই তরল (কিন্তু তেল নয়, কারণ তেলের ঘনত্ব জল থেকে কম)৷ দুধ ও জল একসঙ্গে মেশালে এক হয়ে যায়--- তাকে পুনঃরায় আলাদা করা যায় না৷ এই ক্ষেত্রে Unification কথাটি অর্থবহ৷ ব্রহ্ম শব্দের অর্থ হচ্ছে, বৃহত্বাদ্ ব্রহ্ম--- বৃহণত্বাদ্ ব্রহ্ম৷ যিনি নিজে অনন্ত ও অন্যকে ও অনন্ত তৈরী করেন৷ অন্যদিকে বেদে মানবজাতিকে অমৃত স্বরূপ অনন্ত ভূমা চৈতন্যের পু বলে সম্বোধন করা হয়েছে --- ‘‘শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুাঃ’’৷ মানুষের চাহিদা ও ক্ষুধাও অনন্ত আর সেই অনন্ত ক্ষুধা অনন্তই মেটাতে পারে৷ তাই মানুষের মন যখন সীমিত ক্ষণস্থায়ী জাগতিক ভোগের দিকে ছোটে--- তা হয়তো বা তাকে ক্ষণস্থায়ী সীমিত সুখ দিতে পারে৷ কিন্তু তার পরিণতি কেবল দুঃখই হয়ে থাকে৷ আপেক্ষিক দোষগ্রস্ত জগৎ দেশ-কাল-বন্ধনের আবদ্ধ৷ তাই বিশেষ দেশে , বিশেষ কালে ও বিশেষ পাত্রে যা প্রযোজ্য, অন্য ক্ষেত্রে তা নাও হতে পারে৷ যেমন--- একজন শিক্ষার্থী পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডে ২০০৮ সালে যে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল, যদি তাকে ২০১৮ সালে আবার একই পরীক্ষা দিতে বলা হয়, সে হয়তো আশান্বিত ফল দিতে অসমর্থ হবে৷ অর্থাৎ স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সবকিছুই পরিবর্তনশীল৷ তাই জাগতিক আভোগ মানুষকে স্থায়ী সুখ বা শান্তি দিতে পারে না৷ কিন্তু তবুও এই জগৎকে অবহেলাও করা যায় না৷ কারণ এই জগৎ থেকে আমরা অন্ন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান প্রভৃতি পেয়ে থাকে৷ তাই এই পরিবর্তনশীল জগতের সৃষ্টিকর্তা-পালনকর্র্ত- বিনাশকর্র্ত, যিনি অনন্ত অপরিণামী সত্তা তাকে নিজের চরমলক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করলে ব্যষ্টিগত ও সামূহিক উভয় জীবনে তার উন্নতি সাধন অবশ্যম্ভাবী৷ পরমপুরুষ হলেন বিষয়ী ও ঘূর্ণ্যমান পরিবর্তনশীল এই সৃষ্ট জগৎ হল বিষয়৷ তাই বলা হয়ে থাকে মানুষকে ---Subjevtive approach ওobjective adjustment --- বিষয়ীকে লক্ষ্য হিসেবে রেখে বিষয়ের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলতে হবে৷

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনষ্টাইন তাঁর থিওরেতে প্রমাণ করেন, এ জগতে সবকিছু আপেক্ষিক (চরম সত্য নয়)৷ আজ থেকে ৭০০০ বছর আগে ঈশোপনিষদে মানুষের কর্তব্য সম্পর্কে পথ নির্দেশনা দেওয়া আছে---

‘‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বং

যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা

মা গৃধঃ কস্যসিদ্ধনম্৷’’

‘‘এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে যা কিছু আছে--- সবই অনিত্য৷ কিন্তু সবেতেই ঈশ্বর পরিব্যাপ্ত--- সবকিছুতেই তিনি আচ্ছাদিত, তাই এই বিশ্ব সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া উচিত নয়৷ ত্যাগের দ্বারা তুমি আত্মাকে জানার জন্য ব্রতী হও৷’’

শ্রীমদ্ ভাগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন---

‘‘ দৈবী হ্যেষা গুণময়ী

মম মায়া দুরত্যয়া৷

মামেব যে প্রপদন্তে

মায়া মেতাং তরন্তি তে৷৷’’

এই সংসার মায়া আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে , মানুষ নিজের প্রচেষ্টায় তার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না , একমাত্র পরমপুরুষের শরণাপন্ন হয়ে এই মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়৷

মায়া পরম সত্য নয়, আপেক্ষিক সত্য৷ সাধনা, সেবা ও ত্যাগের মাধ্যমে মানুষ পরমপুরুষের যত বেশি শরণাপন্ন হয়, তারSubjevtive approach হয় তত বেশী, সে তত বেশী objective adjustment অর্থাৎ জগতের সঙ্গে যথাযথভাবে সামঞ্জস্য বজায় করতে সক্ষম হয়৷

যে পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করার জন্যে একান্ত আগ্রহী, সে তার বিভিন্ন ধরণের লোভ-মোহ ত্যাগ করে পড়াশুনায় নিজের মন বসাতে পারে৷ কিন্তু যদি কোনো দৃঢ় লক্ষ্য না থাকে তাহলে এই পড়াশুনাটাই তার ভার বলে মনে হয়৷ যার লক্ষ্য যত সুস্পষ্ট স্থির, লক্ষ্যে পৌঁছাতে সদা সচেষ্ট , সে তত বেশী তার ভোগাকাঙ্ক্ষাকে সংযত করতে পারে ও অভীষ্ট লাভে যত্নশীল হতে পারে৷ মানুষ যেমন কর্ম করে প্রতিকর্ম তেমনই হয়৷ এটা বিধির বিধান৷

তাই মানুষ যদি তাঁর জীবনের পরমলক্ষ্যকে সামনে রেখে জগৎকে ব্রহ্মের বিকাশ হিসেবে ভেবে জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জগতের প্রতি যথাযথ কর্তব্য সম্পাদন করে চলে, তাহলে সে হয়ে উঠবে যথার্থ কর্মযোগী৷ তারাই শিবজ্ঞানে জীব সেবা করতে পারবে৷ জগতের যথার্থ কল্যাণ সেই সমস্ত নিঃস্বার্থ ত্যাগীদের দ্বারাই সম্ভব৷

আত্মমুক্তি অর্থাৎ পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্যে যেমন আধ্যাত্মিক সাধনা প্রয়োজন তেমনি জগতের কল্যাণ সাধনের জন্যে ভৌত বিজ্ঞানও সমভাবে প্রয়োজন৷ তাছাড়া বিজ্ঞান মানসিকতা মানুষকে অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত রাখে৷ তাই সমাজের অগ্রগতির জন্যে আধ্যাত্মিকতা ও বিজ্ঞানের সমন্বয় প্রয়োজন৷