অগ্ণিযুগের অগ্ণিস্ফুলিঙ্গ মাস্টারদা

লেখক
কণিকা দেবনাথ

‘‘আমার শেষ বাণী---আদর্শ ও একতা৷ ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার ওপর ঝুলছে৷ মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে৷ মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলেছে৷ এই তো আমার সাধনার সময়৷ এই তো আমার মৃত্যুকে বন্ধুর মতো আলিঙ্গন করার সময়, হারানো দিনগুলোকে নতুন করে স্মরণ করার সময়৷

আমার ভাইবোনগণ, তোমাদের সবার উদ্দেশে বলছি--- আমার এই বৈচিত্র্যহীন জীবনের একঘেয়েমিকে তোমরা ভেঙে দাও, আমাকে উৎসাহ দাও৷ এই আনন্দময়, পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্যে কি রেখে গেলাম? শুধু একটিমাত্র জিনিস, তা হল আমার স্বপ্ণ৷ সোনালী স্বপ্ণ৷ স্বাধীন ভারতের স্বপ্ণ৷ এক শুভ মুহূর্তে আমি প্রথম স্বপ্ণ দেখেছিলাম৷ উৎসাহ ভরে সারাজীবন তার পেছনে উন্মত্তের মতো ছুটেছিলাম৷ জানি না,এই স্বপ্ণকে আমি কতটুকু সফল করতে পেরেছি৷

আমার মৃত্যুর শীতল স্পর্শ যদি তোমাদের মনকে এতটুকু স্পর্শ করে, তবে আমার এই সাধনাকে তোমরা তোমাদের অনুগামীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিও---যেমন আমি তোমাদের দিয়েছিলাম৷ বন্ধুগণ, এগিয়ে চলো৷ কখনো পিছিয়ে যেও না৷ দাসত্বের দিন চলে যাচ্ছে৷ স্বাধীনতার লগ্ণ আসন্ন৷ ওঠো, জাগো৷ জয় আমাদের সুনিশ্চিত৷

১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিলের চট্টগ্রাম-বিদ্রোহের কথা কোনদিনও ভুলো না৷ জালালাবাদ, জুলধা, চন্দননগর ও ধলঘাট-এর সংগ্রামের কথা সব সময়েই মনে রেখো৷ যে সব বীর সৈনিক স্বাধীনতা-সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম মনের গভীরে রক্তাক্ষরে লিখে রেখো৷

আমার একান্ত অনুরোধ, এই সংগঠনকে তোমরা কোনদিনই ভেঙে দিও না৷ জেলের বাইরে এবং ভেতরে সবার জন্য আমার আশীর্বাদ ও ভালবাসা রইল বিদায়৷’’

অগ্ণিযুগের অগ্ণিস্ফূলিঙ্গ বিপ্লবী মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে শেষ চিঠি চট্টগ্রাম জেলে বসে ফাঁসির আগের দিন ১৯৩৪ সালের ১১ই জানুয়ারী৷

১৮৯৪খ্রীঃ ২২শে মার্চ অবিভক্ত বাঙলার চট্টগ্রাম জেলার নোয়াপাড়া গ্রামে মাস্টারদা সূর্যসেনের জন্ম৷  পিতার নাম রাজমণি সেন ও মাতা শশীবালা সেন৷  গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে চট্টগ্রাম শহরের ন্যাশনাল হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্ত্তি হয়৷ সেখান থেকে আই.এ পাশ করে সূর্য সেন চলে যান মুর্শিদাবাদের বহরমপুুরে সেখান থেকে বি.এ পাশ করে ফিরে যান জন্ম ভিটে চট্টগ্রামে৷

ছাত্রাবস্থা থেকেই যুদ্ধ ও বিভিন্ন বৈপ্লবিক ঘটনা সূর্যসেনের মনে আলোড়ণ তুলতো, বিশেষ করে বাঘা-যতীনের বুড়ি বালামের যুদ্ধ, ক্ষুদিরামের ফাঁসি ও তৎকালীন বৈপ্লবিক ঘটনাবলী তাঁর মনে গভীর দাগ কেটে ছিল৷ সেই সময়ের বৈপ্লবিক সংঘটন যুগান্তরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহরমপুর কলেজের অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী৷  সূর্য সেনের মধ্যে তিনি দেখেছিলেন বৈপ্লবিক ভাবনার স্ফূলিঙ্গ৷ তাই দুজনেই্‌   দুজনকে চিনে নিয়েছিলেন৷

বহরমপুর কলেজ থেকে বি.এ পাশ করে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন সূর্য সেন৷ পরিবারের অভিভাবকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সরকারী চাকরী না করে শিক্ষকতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷ অঙ্কের শিক্ষক রূপে যোগ দিয়েছিলেন উমাতারা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়৷ অচিরেই ছাত্রদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন৷ ছাত্ররাও তাঁকে মাস্টার নামে ডাকতে শুরু করেছিল৷ শিক্ষকতার ফাঁকেই পছন্দমত ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন বিপ্লবী সংঘটন৷

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, জালালাবাদের যুদ্ধ এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও সুপরিকল্পিত বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের দলিল৷ কিন্তু সে ঘটনা আজকের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয় না৷ কারণ বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ ও স্বপ্ণকে  ধুলিসাৎ করে ব্রিটিশের কাছ থেকে ক্ষমতা ভিক্ষে করে নিয়েছিলেন তৎকালীন দেশপ্রেমের মুখোশধারী নেতারা৷ তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাস আজও  অজ্ঞাত রয়ে গেছে৷ যেমন অজ্ঞাত রয়ে গেছে সুভাষচন্দ্রের অন্তিম পরিণাম৷ এ অজ্ঞাত ইতিহাস প্রকাশিত হলে তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের মুখোশ খুলে যাবে অনেক  রাজনৈতিক দলের  অস্তিত্ব বিপন্ন হবে৷

ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বেশিদিন থাকতে পারেননি ‘মাস্টারদা’৷ আত্মগোপন করে থাকার সময় এক দেশীয় প্রতিবেশীর বিশ্বাস ঘাতকতায় ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন মাস্টারদা, ১৯৩৩ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী৷ বিপ্লবীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি ওই বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেন৷ মাস্টারদার ফাঁসির তিনদিন আগে ওই বিশ্বাসঘাতককে বিপ্লবীরা হত্যা করেন৷ ১৯৩৪ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী মাস্টারদার ফাঁসি হয় চট্টগ্রাম জেলে৷

‘মাস্টারদা’র নস্বর দেহ আজ আর নেই৷ কিন্তু তাঁর আত্মত্যাগ, আদর্শ ও স্বপ্ণ আজও প্রজ্জ্বলিত আছে  খণ্ডিত বাঙলার  এপারে ওপারে৷ যে স্বাধীনতার স্বপ্ণ দেখে মাস্টারদা স্বেচ্ছায় জীবন ত্যাগ করেছিলেন,      দুঃখকে বরণ করে নিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ণ একদিন সার্থক হবেই৷ কারণ আদর্শ ও স্বপ্ণের মৃত্যু নেই৷