ঐতিহাসিক সত্ - ত্রিপুরায় বাঙালীরাই ভূমিপুত্র

লেখক
এইচ.এন.মাহাত

ত্রিপুরা (শ্রীভূম) রাজ্যটি মূলতঃ বাঙলা ও বাঙালীদের মূল ভূখণ্ড৷ বাঙালীরাই এখানকার অধিবাসী বা ভূমিপুত্র৷ রাজ্যটি নদীমাতৃক হওয়ার পরেও সমতল ও পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে গঠিত৷ ঐতিহাসিকদের মতে প্রায় পাঁচশত বছর আগে মায়ানমার থেকে খাদ্যের অভাবে ত্রিপুরার জনজাতিরা বাঙলার এই পার্বত্য অঞ্চলে অস্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন শুরু করে৷ বাঙালী জাতির মহৎ গুন হলো সকলকে আপন করে ভালোবাসে কাছে টেনে নিতে পারে৷ তাই তাদেরকেও ভাইয়ের মত ভালোবেসে এখানে স্থান দিয়ে ছিলো৷ পরবর্ত্তীতে স্থানীয় বাঙালী রাজাকে পরাজিত করে ত্রিপুরার দখল নেয় জনজাতিরা৷ তৎকালীন আমলের জনজাতি রাজারা ত্রিপুরারকে উন্নত করতে বাঙালী ও জনজাতির মধ্যে মৈত্রীর মাধ্যমে একটি মহামিলনের ক্ষেত্রে পরিণত করেছিলো৷ জনজাতিদের ককবরক ভাষাটি মূলতঃ বার্র্মর একটি উপভাষা৷ ভারতে এই ভাষার কোনো প্রভাব ছিলো না৷ তৎকালীন রাজারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে উন্নত মনে করেই বাংলা ভাষাকে রাজভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিলো৷ পাশাপাশি বাঙালীর মেধা বুদ্ধি ও সৃজনশীলতা রাজাদেরকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করেছিলো৷ ফলস্বরূপ উচ্চ ও নিম্ন পর্যায়ের সকল কর্মচারী ও মন্ত্রীরা মূলত বাঙালী ছিলো৷ বাঙালী মন্ত্রীরা সকল সময় রাজাকে সুপরামর্শ দিতেন বলেই রাজা ও স্থানীয়দের মধ্যে কোন সমস্যা ছিলো না৷

স্বাধীনতার পরবর্তীতে জড়বাদী সিপিএম ত্রিপুরায় সরকার তৈরী করেই বাঙালী মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার জন্য একটা পর একটা বাঙালী বিদ্বেষী আইন তৈরী করে৷ জমি হস্তান্তর আইন থেকে এডিসির মত কয়েকটি আইন তৈরী করেছিলেন৷ এডিসি অঞ্চলের আইনটি ত্রিপুরার সার্বিকভাবে জনসাধারণের স্বার্থে তৈরী হয়নি৷ যেমন যেখানে ৭০ শতাংশ বাঙালীদের জন্য ৩০ শতাংশ জমি সংরক্ষণ আর ৩০ শতাংশ জনজাতিদের জন্য ৭০ শতাংশ জমি সংরক্ষিত করা হলো৷ এরফলে স্থানীয় জনজাতিরা উপকৃত হবে বলে সিপিএম প্রচার করলেও এডিসির জমি মূলত যে সকল জনজাতি ভাইরা বাঙালীদের সঙ্গে থেকে শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হয়েছে তারাই গরিব জনজাতি ভাইদের বেশী শোষণ করেছে৷ বাজারে কোন জিনিস বিক্রি করতে সেই জিনিসের বেশী ক্রেতা থাকলে পরখ করা যায়৷ এডিসি অঞ্চলে পুঁজি আছে৷ জনজাতিদের সংখ্যাটি ছিলো খুবই নগন্য তার ফলে গরিব জনজাতিরা শোষিত হয়েছে নিজের ভাইদের কাছেই৷ জমি কিনতে বা বিক্রয় করতে হলে সেই পূঁজিপতি ভাইয়ের কাছে তাদের নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে৷ দরিদ্র জনজাতিদের ক্ষোভকে সিপিএম বুদ্ধি করে বাঙালী বিদ্বেষী করে তোলে৷ এরই পরিণতি সিপিএমও টি.এনভির মত জনজাতিদের উগ্রপন্থী সংস্থা তৈরী করে ও তাদের নেতৃত্বে ৮০ সালের ৬ই জুন মান্দাই থেকে শুরু হয়েছিল বাঙালীদের উপর আক্রমণ ও গণহত্যার একটি লম্বা ইতিহাস৷

ত্রিপুরা স্বশাসিত জেলা পরিষদ কোন একটি ডিষ্ট্রিক বা জেলা নয়৷  সারা ত্রিপুরার মাটিকে খাবলা খাবলা করে তৈরী করেছে এডিসির ম্যাপটি৷ এর পিছনে সিপিএমের অভিসন্ধি ছিলো বাঙালীকে আঁতে ও ভাঁতে মারবার চক্রান্ত৷ সেই চক্রান্তে লক্ষ লক্ষ বাঙালী গৃহহীন হয়ে  পিতৃহারা, ভাতৃহারা হয়ে উদ্বাস্তুর মতো এখনো বিভিন্ন অঞ্চলে অস্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে আছে সরকারের কোন সহায়তা ছাড়াই৷

আজ এডিসি ৪০ বছর ধরে তৈরী হওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের  জনজাতিরা শিক্ষা, খাদ্য, পোষাক, পানীয় জল কর্মসংস্থানের অভাবে দারিদ্রতা ও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে৷ এডিসিতে  বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের কোটি কোটি টাকা লেনদেন করেছে, সেখানে তো বাঙালীর কোন অধিকার ছিলো না, তবে কেন আজও হাজারো সমস্যা জনজাতিদের৷ সমীক্ষায় বলছে যে সকল জনজাতি ভাইরা বাঙালীদের সঙ্গে বসবাস করছে তারই শিক্ষার আলো পেয়েছে ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বীতা অর্জন করেছে৷ সিপিএমের এডিসি ত্রিপুরায় হিংসার বীজটি ভালোভাবে বপন করলেও কোন প্রকারের উন্নত ত্রিপুরা গড়তে পারে নি৷ এবার এডিসির নব্য নেতা এডিসির সংসদে আইন পাস করেছে তিপ্রাল্যাণ্ড চাই ও ত্রিপুরার উন্নয়নে যে বাঙালীদের সবচেয়ে বেশী অবদান ও যাদের করের টাকায় রাজ্যটি চলে সেই বাঙালীকে ত্রিপুরা মুক্ত করতে হবে৷ ত্রিপুরার এডিসি অঞ্চলে বাঙালীর জমি থাকলেও তাদেরকে কোনো প্রকারের ক্রয় করার অধিকার দেওয়া হয়নি৷

সিপিএমের নেতারা জনজাতিদের ভোট ব্যাংক তৈরী করতে বলে বেড়িয়েছে বাঙালীরা বাংলাদেশ থেকে এসেছে৷ ফলে জনজাতিরা সংখ্যা লঘুতে পরিণত হয়েছে৷ অথচ আদম সুমারীর দলিল বলছে ব্রিটিশ ভারতের ও স্বাধীনতার পরেও এপারের ত্রিপুরাতে বাঙালীরাই ভূমিপুত্র ও গরিষ্ঠ ছিল৷ পাপ যেমন বাপকেও ছাড়ে না, তেমনি বাঙালী হয়েও সিপিএমের নেতারা বলতেন তারা নাকি কমিউনিষ্ট, বাঙালী নয়৷ ফলশ্রুতি বর্তমান এডিসির নির্বাচনে সিপিএম বাঙালী বিদ্বেষী হওয়ায় জনজাতিদের ভোট থেকে ধুয়ে মুছে পরিস্কার হয়ে গেছে৷

আদর্শহীন ভ্রষ্টাচারী রাজনীতির বিষময় ফল আজ কংগ্রেস সিপিএমকে ভোগ করতে হচ্ছে৷ আজ যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তাদেরও একদিন এই দশাই হবে৷ কিন্তু ত্রিপুরার জনগণ রাজার পাপে প্রজার দুর্দশা!

সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক চেতনার অভাব ও কপটাচারী নেতাদের প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে জনগণ আজ এদল কাল সে দল করে বেড়াচ্ছে৷ দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে ‘আমরা বাঙালী’ চিৎকার করে আসলেও জনগণ কর্ণপাত করেনি৷ মাটির পরিচয়ে ত্রিপুরার বাঙালী ও জনজাতি সবাই বাঙালী৷ ‘আমরা বাঙালী’ নিছক একটা রাজনৈতিক দল নয়৷ সুদূঢ় আদর্শ, মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান৷ যার মূল লক্ষ্য নব্যমানবতাবাদ ও আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্বের মাধ্যমে বলিষ্ঠ ও বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই ত্রিপুরার প্রতিটি মানুষের সার্বিক কল্যাণ৷