অজীর্ণ রোগের ফলে অনেক প্রাণঘাতক রোগের সৃষ্টি হতে পারে৷ তাই আহারের বিধিনিষেধ কঠোর ভাবে মেনে চলা উচিত৷ পুরনো চালের ভাত (যেমন পোরের ভাত) এ রোগে পথ্য৷ ঘোল অজীর্ণ রোগীর পক্ষে বিশেষ হিতকারী৷ নুনে জরিয়ে জামেরী নেবু অজীর্ণ রোগে একটি ভাল ব্যবস্থা৷ শোভাঞ্জন বা শোজনে পাতার ঝোল প্রতিদিন ভাতের সঙ্গে প্রথম পাতে খেলে কয়েকদিনের মধ্যেই অজীর্ণ রোগে ভাল ফল পাওয়া যায়৷ বেলপাতা, কালমেঘ পাতা, সোমরাজ পাতা, আদা, যোয়ান একত্রে পিষে, তা দিয়ে ছোট ছোট বড়ি তৈরী করে সেগুলি শুকিয়ে নিতে হবে৷ প্রতিদিন দুপুর ও রাতের খাবারের পর একটা করে সেই বড়ি খেতে হবে৷ অজীর্ণ রোগে এই ঔষধও কাজ দেয়৷
অম্লরোগীর ক্ষুধার সময় খাদ্য গ্রহণ না করে পাচক পিত্তকে কখনই সঞ্চিত হবার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়৷ কেননা সেক্ষেত্রে রক্তের অম্লভাগ অত্যধিক বেড়ে গিয়ে বাতরোগ বা অম্লশূল দেখা দিতে পারে৷ প্রাত্যহিক আহারের পরে, মুখশুদ্ধি হিসেবে মৌরীর সঙ্গে নারকোল কুরো বা একই ঔষধ দিনে তিন/চার বার খেলে অম্লরোগে খুব ভাল ফল পাওয়া যায়৷ অজীর্ণ ও অম্লরোগের জন্যে আরো কিছু দ্রব্যগুণ, ব্যবস্থা যথাস্থানে বলা হবে৷
গোলমরিচ
গোলমরিচকে প্রাচীনকালে কথ্য সংস্কৃতে বলা হত ‘‘কটূবীজম’’৷ গোলমরিচের আদিবাস দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া৷ উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া গোলমরিচের অতি প্রিয়৷ হাওয়াতে–মাটিতে–জলে একটু নোনতা ভাব থাকলে তো সোণায় সোহাগা৷ মোটামুটি বিচারে ধরে নেওয়া যেতে পারে নারকোল, পান, চৈ, গোলমরিচ কতকটা একই ধরনের আবহাওয়া চায়৷ এই জন্যে আমরা দেখতে পাই অনেক ক্ষেত্রে লোকে গোলমরিচের লতা নারকোল গাছের ওপর তুলে দেয়৷ গোলমরিচ ভারত তথা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি অন্যতম ফসল ও যথেষ্ট গুণযুক্ত একটি মশলা৷ গোলমরিচ একটি সংরক্ষণযোগ্য বীজ (শুকিয়ে রাখা যায় দীর্ঘদিন)৷ দক্ষিণ বাংলা, পূর্ব বাংলা ও উত্তর বাংলার আবহাওয়া নারকোল, চৈ ও গোলমরিচ–তিনেরই উপযোগী৷ পূর্ব রাঢ়েও এরা জন্মাতে পারে৷ তবে পশ্চিম রাঢ়ের মিষ্টি মাটি, মিষ্টি জল ও শুকনো আক্ষহাওয়া এদের পক্ষে উপযোগী নয়৷
রান্নায় গোলমরিচের ব্যবহার ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে৷ দেশে লঙ্কার আমদানীর পর গোলমরিচের ব্যবহার কিছুটা কমলেও খুব বেশী কমেনি৷ তার কারণ লঙ্কার স্বাদ ও গোলমরিচের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী৷ গুণগত বিচারে লঙ্কার চেয়ে গোলমরিচের গুরুত্ব অনেক বেশী৷ ভারতে সাধারণতঃ কালো অথবা খয়েরী রঙের গোলমরিচ পাওয়া যায়৷ তবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় অল্প মাত্রায় শাদা গোলমরিচও লভ্য৷
গোলমরিচ হজমে সাহায্যকারী, আলস্য ও বিষাদ বায়ু রোগে উপকারী ঃ
গোলমরিচ মুখে লালা আনে..... ক্ষুধার উদ্রেক করে..... পরিপাকে সাহায্য করে৷ গোলমরিচ স্নায়ু তন্তুতে সজীবতা এনে দেয়৷ আলস্য (lethergic nature) ও বিষাদ বায়ু রোগে (melancholia) গোলমরিচ একটি ঔষধ৷ বিভিন্ন অনুপানের সঙ্গে মিলিয়ে গোলমরিচ অনেক রোগের নিরাময়ে সাহায্য করে৷ যেমন–বসন্ত রোগে কন্টিকারীর মূলের সঙ্গে বয়ঃব্রণে দুধের সরের সঙ্গে ছুলি রোগে তাজা তালের রসের সঙ্গে৷ এদের ব্যবহার–বিধি যথাস্থানে বর্ণিত হয়েছে৷
কুল
পরিচয় ও প্রজাতি ঃ কুল পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই জন্মায়৷ বেশ গরম জলবায়ু থেকে শুরু করে খুব ঠাণ্ডা দেশেও কুল জন্মাতে দেখা যায়৷ খুব বৃহৎ আকারে (টেনিস বলের চেয়েও বড়) থেকে শুরু করে অতি ক্ষুদ্র (মটরের আকারের) কুলও আছে৷ আবার অত্যন্ত মিষ্ট, মাঝারী মিষ্ট ও অত্যন্ত টক–সব রকম স্বাদেরই কুল আছে৷ হিমালয়ে তুষারাচ্ছন্ন এলাকাতেও কুল গাছ জন্মায় ও বরফ চলে যাবার পর ফল দেয়৷ তবে যেখানে আবহাওয়া উষ্ণ, বৃষ্টিপাত কম ও মৃত্তিকা বালুকা মিশ্রিত, সেখানে কুলের আকার সবচেয়ে বড় হয়ে থাকে৷ তাই ভারতের গুজরাত, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের আগ্রা সন্নিহিত অঞ্চলেও উত্তম মানের বৃহদাকার কুল পাওয়া যায়৷ এলাহাবাদ ও কাশীর কুলও মন্দ নয়৷ বাংলা অতি বৃষ্টিপাতযুক্ত এলাকা৷ তাই বাংলায় কুলের ফলন অধিক হলেও কুলের মান উন্নত ধরনের হয় না৷
মোটামুটি বিচারে ভারতীয় (ইন্ডিকা) প্রজাতির কুল চার প্রকারের হয়ে থাকে৷ এক ঃ বৃহৎ লম্বা আকারের মিষ্টি কুল বাংলায় যাকে কাশীর কুল বা নারকুলে কুল বলা হয়৷ দুই ঃ বড় আকারের গোল টক কুল বাংলায় যাকে টক কুল বলা হয়৷ তিন ঃ ছোট আকারের গোল বেশ টক কুল বাংলায় যাকে দেশী কুল বলা হয়৷ চার ঃ বন্য আবহাওয়ায় আপনিই নদীর ধারে বনে জঙ্গলে জন্মায় যাকে বুনো কুল বা জংলী কুল বা শিয়া কুল বলে৷
খাদ্য হিসেবে যদিও মিষ্টি কুলকেই লোকে বেশী পছন্দ করে, তবে গুণগত বিচারে মিষ্টি কুলের চেয়ে টক কুলের মান বেশী৷ আর তাজা কুলের চেয়ে শুকনো কুলের গুণ বেশী৷ কুল পাকবার স্বাভাবিক সময় বসন্ত ঋতু৷ ওই সময় দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় অন্য কোন সহজলভ্য ফল না থাকায় কুলের একটি সাময়িক কদর আছে৷ কুলের সংস্কৃত নাম ‘বদরী’ বা ‘বদরিকা’৷ এই ‘বদরী’ থেকেই উত্তর ভারতে ‘ক্ষয়ের’, ‘ক্ষেড়ো’, ‘ক্ষেড়’ প্রভৃতি শব্দ এসেছে৷ বাংলার গ্রামাঞ্চলে কোথাও কোথাও প্রচলিত ‘বড়ই’ শব্দটিও এই বদরী–জাত তদ্ভব শব্দ৷ বাংলা ও অসমে কোথাও কোথাও প্রচলিত ‘বোগড়ী’ শব্দটিও বদরী থেকেই এসেছে৷
কুলের গুণাগুণ–হজম শক্তির সহায়ক কুল ঃ শুকনো/গরম দেশে–ডেকান প্লেটো (দাক্ষিণাত্যের মালভূমি), গণ্ডোয়ানা* ও পশ্চিম রাঢ়ে–যেখানে শীতের পর তাড়াতাড়ি গরম পড়ে যায়–সে সকল স্থানে কুলের অম্বল স্বাস্থ্যরক্ষার সহায়ক৷ কুল হজমশক্তির সহায়ক (তাজা কুলের চেয়ে শুকনো কুলের এই গুণ বেশী) কুল (বিশেষ করে কুলের অচার) লালা নিঃসারক, তাই আহারে রুচিবর্দ্ধক৷ অল্প মাত্রায় কুল অগ্ণ্যাশয়ের বন্ধু৷
অন্যান্য রোগে কুল ঃ কুল আঁটির ভেতরকার শাঁস ডায়াবিটিস রোগের ঔষধ৷ (কুলের পাতা দিয়ে লাট খাওয়া হাম–বসন্ত রোগের এক রকমের ঔষধ তৈরী হয়)৷
‘‘মঙ্গলবারে আ–ফলা কুল গাছের শিকড় কোমরে বেঁধে কোষ পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখলে কোষবৃদ্ধি বা হাইড্রোসিল রোগ দূরীভূত হয়৷’’
কুল গাছের অন্যান্য ব্যবহার ঃ কুলের কাঠ খেলাধূলার সাজসরঞ্জাম প্রস্তুতের উপযোগী৷ আত্তীস বাজী প্রস্তুতেও কুল কাঠের ব্যবহার রয়েছে৷
কুল গাছে এক ধরনের তসরকীটও প্রতিপালিত হয়৷ কুল গাছে লাক্ষাকীট প্রতিপালিত হতে দেখেছি বাংলার মানভূমে ও মুর্শিদাবাদে৷ তাইল্যান্ডেও তা অল্পবিস্তর দেখেছি৷
(‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’–শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার)