আমার আচার্যদেব

লেখক
সুভাষপ্রকাশ পাল

কাকুর সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার পর একবৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে৷ একদিন হঠাৎ মীরবাজার কলেজ মেশে একটি কমবয়সী ছেলে এসে খবর দিল--- আমার যে কাকা সন্ন্যাসী হয়েছেন তিনি বিশেষ কাজে জগন্নাথ মন্দিরচকে অবস্থিত মেদিনীপুর আনন্দমার্গ স্কুলে এসেছেন৷ আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, আমি সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে আনন্দমার্গ স্কুলে রবানা হলাম৷ ইতিমধ্যে নানা প্রয়োজন আমি বেশ কয়েকবার ঐ স্কুল তথা আশ্রমে গিয়েছি ও ওখানকার আশ্রমের অধ্যক্ষ আচার্য বিজয়ানন্দ অবধূতের সঙ্গে পরিচয় পূর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ হয়েছে৷ আশ্রমে পৌঁছেই দেখি গেরুয়া বসন পরিহিত গোঁফ-দাড়ি, জটাজুট সমন্বিত এক নবীন সন্ন্যাসী হাসিমুখে গেটের সামনে যেন আমারই আগমনের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন৷ সত্যি কথা বলতে কি দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না যে উনিই আমার সেই রাশভারি কাকা যাকে তার ভাইপো-ভাইঝিরা বেশ সমীহ করে চলত৷ হঠাৎ কিছু না বলে যাওয়ার জন্য মনের মধ্যে একটু অভিমান ছিল৷ উনি তাঁর স্নেহ, আদর তথা মিষ্ট কথা দ্বারা সেই অভিমান দূর করে দিলেন৷ সবার খোঁজ খবর নিলেন৷ গত এক বছরের সন্ন্যাস জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করলেন৷ মনের জীবনের লক্ষ্য ও আদর্শ সম্পর্কে অনেক কথা বললেন৷ আরও বললেন--- লক্ষ লক্ষ পশুজন্মের পর আমরা মানুষের শরীর লাভ করি৷ সুদুর্লভ মনুষ্যজীবনকে হেলায় নষ্ট করা কোনো বুদ্ধিমান মানুষের উচিত কাজ নয়৷ ঈশ্বর সম্প্রাপ্তি জীবনের লক্ষ্য, অষ্টাঙ্গ যোগসাধনার মাধ্যমেই সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে৷ এজন্য সাধনা শেখার পরামর্শ দিলেন৷ সবিনয়ে জানলাম---আমি গিরি সম্প্রদায়ের একজন মহারাজের কাছে দীক্ষিত তাঁর নির্দেশমত যোগাভ্যাসও করি৷ তাঁর অনুমতি ছাড়া আমার অন্য কোন কিছু করা উচিত হবে না৷ তিনি চোখবন্ধ করে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেন, তারপর জানালেন--- আমি ধ্যানযোগে স্বামীজীর অনুমতি নিয়ে নিচ্ছি৷ কয়েক মিনিট ধ্যানমগ্ণ হলেন, তারপর আর কথা বাড়াইনি৷ মন্ত্রমুগ্দের মত বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁর কাছে আনন্দমার্গের যোগসাধনা শিখলাম৷ এতদিন যিনি ছিলেন আমার পিতৃব্য, সেই মুহূর্ত থেকে তিনি হয়ে গেলেন আমার আচার্যদেব৷

আমার পূর্ব আশ্রমের গুরু মহারাজ স্বামী অরূপানন্দ গিরির সঙ্গে এর পরে দেখা হয়েছে, তাঁকে আনন্দমার্গের সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হওয়া এবং তাঁর নিকট থেকে সাধনা শেখার কথা সবই জানালাম, সব কিছু শুণে তিনি একটুও রাগান্বিত হলেন না শুধু এটুকুই বললেন---ঈশ্বর -সম্প্রাপ্তির জন্য যে পথই অবলম্বন করনা কেন, তা একনিষ্ঠভাবে অভ্যাস করতে হবে, তবেই তার ফল পাবে৷ চন্দ্রকোণা রোডের অতি নিকটে জব চায় ওঁর প্রতিষ্ঠিত একটি আশ্রম আছে৷ কলেজ জীবনে বেশ কয়েকবার সেখান গিয়েছি এবং প্রয়োজনে রাত্রিবাসর করেছি৷ পাঁশকুড়া স্টেশনের উত্তর দিকে মেছগ্রামে স্বামীজি মহারাজ ‘বিশ্ববৈদিক যোগাশ্রম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন এবং সেখানে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত একটি আবাসিক বিদ্যালয়ও তৈরী করেছেন৷ ওখানেই বেশীর ভাগ সময় থাকেন, ওঁর সঙ্গে এখনও মাঝে মাঝে দেখা হয়৷ আমার প্রতি স্নেহ-ভালবাসার এতটুকুও ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়নি৷ মহান পুরুষেরা এরূপ প্রকৃতিরই হন৷

যে কথা বলছিলাম আমার আচার্যদেব আচার্য তপেশ্বরানন্দ অবধূতের সঙ্গে একটা নূতন জীবন তথা অধ্যায় শুরু হল, আচার্যদেব আনন্দমার্গ সংঘটনের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন৷ আমার চলার পথে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন৷ আমি কখনও আমার আচার্যের সঙ্গে দেখা করার জন্য গেলে বেশীক্ষণ কথা বলার সুযোগ পেতাম না, সারাদিন অপেক্ষায় থেকেছি, রাত্রিতে শয়নের পূর্বে কিছুটা কথা বলার সময় পেয়েছি৷ এদিকে বিজয়ানন্দদা, কেশবানন্দদা প্রমুখ দাদারা আমাকে তিলজলা বা অন্যকোন অনুষ্ঠানে দেখতে পেলেই মজা করে বলতেন--- কি সুভাষ! কাকুর সঙ্গে দেখা হল? শুণেছি বাবাও নাকি একবার রসিকতা করেছেন---হ্যাঁরে তপেশ্বরানন্দ! সুভাষ তোকে কী বলে ডাকে রে? মার্গের বিধি অনুসারে নিজ আচার্যকে সবাই দাদা বলেই সম্বোধন করেন৷ যদিও বাবা বলেছেন--- পূর্ব সম্পর্ক থাকলে মার্গীরা সেভাবেও সম্বোধন করতে পারে, আমি আমার আচার্যদেবকে ‘দাদা’ ও বলতাম না বা পূর্ব সম্পর্ক অনুসারে ‘কাকু’ ও বলতাম না৷ কোনও সম্বোধন না করেই আমার আচার্যের সঙ্গে নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে নিতাম৷ আমার সাধক জীবনে তিনি ছিলেন এক অপরিহার্য ব্যষ্টিসত্তা, তিনি ছিলেন আমার কাছে (?) ধর্মসমীক্ষার সময় বাবাও আচার্য দেবের পায়ে ধরে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন--- আমি যেন সারাজীবন আমার আচার্যের কথা মেনে চলি, একথার অর্থ সেই মুহুর্তে উপলব্ধি করতে না পারলেও পরবর্তী দিনগুলিতে চলার পথে ত্রিকালজ্ঞ গুরুর (বাবার) ঐ কথার অর্থ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি৷