আমার বাঙলা

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

স্মরণীয়, বাঙালীসত্তায়--- বাঙালীয়ানার স্বাতন্ত্র্য বা প্রাণধর্ম পরে আসলেও সঙ্কারয়নটা দু,এক বছরের বা দু এক যুগেরও নয়৷ এর শুরুটা আনুমানিক খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে৷ বোধ হয় প্রাকৃতিক নিয়মে এই মিশ্রণটা আজো চলছে৷ এই কারণে বাঙালী জনগোষ্ঠীতে অসংখ্য গোষ্ঠী ,উপগোষ্ঠী ও খণ্ড-গোষ্ঠীর সহ-অবস্থান৷ একটা তাত্ত্বিক ও তাথ্যিক বিচার এখানে ক্রিয়াশীল৷ সে আনুমানিক দশ লক্ষ বছর আগেকার কথা, ‘হলোসিন’ যুগের কথা৷ ততদিনে বাঙালীস্তানের রাঢ় অঞ্চল তথা গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের পূর্বাঞ্চল মানুষের বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠেছে এবং হাজার হাজার বছর ধরে রঢ়ের বুকে অষ্ট্রিকো- নিগ্রো-দ্রাবিড়য়েড বিমিশ্র মানুষের একটা আলাদা আইডেন্টিটিও এসে গেছে,নামকরণও হয়ে গেছে ‘কৈবর্ত’৷ কেননা এখানকার মানুষগুলো ছিল জলজীবী৷ কৈবর্ত (বর্ত)+ ক গু কেবর্ত ৷ কেবর্ত অণ গু কৈবর্ত বা কেবর্ত ৷ শব্দটির ভাবারূঢ়ার্থ হচ্ছে যে জলে থাকে, অর্থাৎ জলজীবী৷ আবার যোগারূঢ়ার্থে শব্দটির অর্থ বোঝায় মৎসজীবী, চলতি বাংলায় জেলে৷ কৈবর্ত শব্দের দ্বিতীয় অর্থ হ’ল নৌচালক৷ এই কথাটা মানে --- মাঝি ও দাঁড়ি দুই-ই হয়৷ আবার কৈবর্ত থেকে ‘কেওট’ শব্দের উৎপত্তি---(কৈবর্ত> কৈবট্ট> কেবট> কেওট)৷ আযাবর্তে এখনও নৌচালককে ‘কেওট ’ বলে৷ এজন্য বলা হয় ‘হেলে কৈবর্ত, আর ‘জেলে’ কৈবর্ত৷ অবশ্য ‘ হেলে-কৈবর্ত ‘ বলতে কেবল ‘ দাঁড়ি-মাঝি’ নয় , যারা হাল (লাঙ্গল) দিয়ে চাষ করে সেই হালিকদের বা কর্ষকদেরও বোঝায়৷ মোটকথা এককালে বাঙালার সমস্ত মানুষই কৈবর্ত ছিল, বাঙালী জনগোষ্ঠীর মূল জীনটা হচ্ছে কৈবর্তদের৷ এই কৈবর্তরাই কালক্রমে ছয়টি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যান৷ তাঁরা হলেন---কৈবর্ত, মাহাতো, সদগোপ, নমঃশূদ্র , চাকমা ও রাজবংশী৷ এই সঙ্গে আছে বিভিন্ন রেস’-এর প্রাধান্য ভিত্তিক অসংখ্য বাঙালী গোষ্ঠী---উপগোষ্ঠী- খণ্ডগোষ্ঠী---যাঁদেরকে এখন হীনার্থে আদিবাসী, উপজাতি , জনজাতি লেবেল সেঁটে দেয়া হয়েছে৷ এঁদের অধিকাংশই আজওশিক্ষায়-অর্থনীততে-সামাজিক মর্যাদায় বাঙালীস্তানের পিছিয়ে পড়া জনতা৷ এঁরা হলেন---কোচ, মেচ, রাজগুন, কোলিয়া, ত্রিপুরী, কাছাড়ী , বোড়ো, কিরাত ,হাজং ,হালং, দালু, বাগদী, দুলে শবর, পুলিন্দ, খেড়িয়া, সাঁওতাল, বাঊরি, হো, সিংমুণ্ডা, চূয়াড়, খাঙার মুড়া, খেলিয়া মুড়া, লোধা, বেদে-মাহাতো, কুশমেটমুড়া, কুর্মী,কুর্মীমাহাতো, মালপাহাড়ী ইত্যাদি ৷ সবাই বাঙালী, বাংলার সম্পদ৷

সবাইকে নিয়েই আমরা মানুষ জাতের, জাতে (এথিসিটিতে) বাঙালী৷ ‘সঙ্করণ-রসায়ন’টা চালতার -পেঁয়াজের ---বাঁধাকপির’ মত , শাঁস খুঁজে পাওয়া যায় না৷ প্রতিটি দল,পাঁপড়ি বা শল্কই মূল-চালতা, আসল-পেঁয়াজ বা প্রকৃত-বাঁধাকপি৷ তাই কে আদি কে নব্য , কে খাঁটি কে বাঙালীর মত---এ কথা অর্থহীন ৷ সংকর জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য মাফিক যেসব মানুষ বহুকাল ধরে বাঙালীস্তান মহাভূমিতে বসবাস করছেন, বাঙলার সামাজিক ঐতিহ্য, ভাষা-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন, মাতৃভূমি রূপে বাঙালিস্তানের সার্বিক কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন---বাঙলার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা আছে---তিনিই বাঙালী৷ এইযে বাঙালী ---বাঙালীস্তান মহাভূমির ভূমিপুত্র, এক স্বতন্ত্র বঙ্গ- জাতিসত্তার (এথিসিটির) তথা একটা বিশিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থানের---ভৌম পরিচয়ের ধারক ও বাহক৷ বঙ্গ-মহাসংস্থানের প্রকৃতি বা বাঙলীর মাতৃভূমি পরম মমতায় বাঙালীর দেহে-মনে-ললাটে কর্ণের কবজ --- কুণ্ডলের মত বাঙালীয়ানা-বাঙালীত্বের সীলমোহর দেগে দিয়েছে৷ তাই বাঙলার মানুষের দেহ-ভঙ্গিমা পৃথক হাব-ভাব, আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, যজন-যাজন, পৌরোহিত্য পৃথক বাঙলার লিপি, উচ্চারণরীতি, এমনকি চিন্তাধারাতেও পার্থক্য৷ বলাবাহুল্য, এই কারণে বাঙলার বাইরে-বিদেশে কারো মুখ দেখেই আমরা বলে থাকি---‘যেন বাঙালী বাঙালী মনে হচ্ছে!’

আমার বাঙলা ‘র’ ‘বাঙলা নামের উৎপত্তি ঃ---

‘বঙ্গ’ শব্দটিরই বিবর্তিত রূপ হচ্ছে ‘বাঙলা’৷ ‘বঙ্গ’, ‘বাঙ্গালা’, ‘পুণ্ড্র’ বা ‘গৌড়’নামগুলো ঐতিহাসিক দিক দিয়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ৷ এবং এর ইতিহাসও অতি প্রাচীন৷ বঙ্গ শব্দের অনেকগুলো অর্থ পাওয়া যায়---

১) ‘বঙ্গ’ শব্দটির একটি অর্থ হচ্ছে পাতলা বা মিহি ধাতু বা ওই পাতলা-মিহি ধাতু নির্মিত পদার্থ বিশেষ৷ সুদূর অতীতে বাঙলার কারিগরেরা ও স্বর্ণকারেরা খুব মিহি বা পাতলা অলঙ্করণ প্রস্তুত করতে পারতেন বলে তাঁদের প্রশংসায় বহির্বঙ্গের মানুষেরা আমাদের জন্মভূমির নাম দেন ‘বঙ্গ’৷

২) ‘বঙ্গ’----কথটির একটা মানে হয়---টিন বা রাঙতা৷ যে দেশে টিন বা রাঙতার প্রাচুর্য সেই দেশের নাম হয়ে গেল ‘বঙ্গ’৷

৩) বর্তমানে ‘বঙ্গ’ বলতে অখণ্ড বাঙলা বা সমগ্র বাঙলাকে নির্দেশ করে৷

৪) ‘বঙ্গ’ শব্দটি ভাঙলে পাওয়া যায় --- বং+ গ গু বঙ্গ ৷ ‘বং’ হচ্ছে আধ্যাত্মিক বীজমন্ত্র ৷ আর ‘গ’ হচ্ছে চলা ৷ তাহলে বঙ্গ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দাঁড়ায় ---যে দেশ আধ্যাত্মিকতাকে সঙ্গে করে নিয়ে পথ চলে সেই দেশের নাম ‘বঙ্গ’৷ আমার বাঙলাই আধ্যাত্মিকতার আদিপীঠভূমি৷ আর ভারতবর্ষকে তো বলাই হয় আধ্যাত্মিকতার দেশ তবে প্রাগৈতিহাসিক বাঙলাই তার প্রাণকেন্দ্র ৷ বাঙালীস্তান জুড়ে আধ্যাত্মিকতার ফলিত-রূপ (কাল্ট বা প্র্যক্টিক্যাল প্রসেস) রূপায়ন-কেন্দ্র তথা অনুশীলন স্থল বা চর্চা কেন্দ্র অর্থাৎ ‘তন্ত্রপীঠ’ আছে তা বোধ হয় গুনে শেষ করা যাবে না৷

৫) ‘বঙ্গ’ শব্দের আর এক অর্থ হয় কার্পাস তুলা৷ অতীতে বাঙলার বৃহত্তর দামোদর উপত্যকার কৃষ্ণ মৃত্তিকা অঞ্চলে (পিটকয়লাজাত কৃষ্ণমৃত্তিকা অঞ্চলে) উন্নত মানের কার্পাস উৎপন্ন হ’ত৷ এই কার্পাস দিয়ে বঙ্গবাসীরা উন্নত মানের বস্ত্র তৈরী করে দেশ-বিদেশে রপ্তানি করে বস্ত্র শিল্পে খ্যাতি অর্জন করে ছিল৷ সেকালের বাঙালীদের সাধারণ পেশাই ছিল (সমকালীন মানুষের জীবনযাত্রার ধরণ-ধারণ-মুখী চাহিদা অনুযায়ী) চাষ করা, মাছ ধরা, আর তাঁত বোনা৷

৬) আবার ‘বঙ্গ’ মানে হচ্ছে---‘বঙ্গা বগদ’দের বাসভূমি৷ অর্থাৎ বাগদি ইত্যাদি অনার্য জাতিদের বাসভূমি৷ সম্ভবত নামটা দিয়েছিল আর্যরা৷

বঙ্গ শব্দের অর্থ ও নানা সূত্রে পরিষ্কার যে ‘বঙ্গ’ শব্দটি অতি প্রাচীন৷ পৃথিবীর কয়েকটি প্রধান ভাষাতে ও সভ্যতার হতিহাসে পাওয়া এই ‘বঙ্গ’ শব্দটি থেকেই ‘আমার বাঙলার’ও আর তার মানুষের ও তার ভাষার নামকরণ হয়েছে ---লাতিনে বলা হয়--- ‘বঞ্জাল’৷ পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো চীন ভাষায় হয়ে যায়---‘বাঞ্জালা’৷

তুর্কী ভাষায় বলা হয়েছে---‘বাঙ্গালা’৷ ফার্সীতে ---উর্দুতে---‘বাঙ্গাল’৷ ইংরাজিতে---বেনাল৷

অনেকে বোঝবার চেষ্টা করলেও ‘বঙ্গাল’ শব্দটি বঙ্গাল (ফারসী প্রত্যয়) করে আসেনি৷ কেননা ১২০০ বছর আগেকার কবিতাতেই ‘বঙ্গাল’ কথাটি আছে৷ তাই বিশ্বে নামগত বিচারে আমাদের মাতৃভুমির পরিচিতি অতি প্রাচীন৷ এর থেকে এও পরিষ্কার যে বাঙলার সভ্যতা ও সংস্কৃতি এককালে অনেক দূর ছড়িয়ে পড়েছিল৷ নইলে পৃথিবীর অধিকাংশ প্রধান ভাষাতেই এর নামকরণ হ’ল কী ভাবে?

পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার দেশ চীন৷ সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাঙলাকে চীন বলে আসছে ‘বাঞ্জালা’৷ আবার লাতিন বিশেষণে ‘বঞ্জাল’হয়ে যায় ‘বাঞ্জালাইটিস’৷ এর মানে দাঁড়ায় বাঙলায় জাত বা বাঙলা সম্বন্ধীয়৷ লক্ষ্যনীয়, যে বড় আকারের চাঁপা ফুলকে বাংলায় বলা হয় ‘জুহুরি’ চাঁপা, লাতিনে তাকেই বলা হয়---‘ম্যাগনোলিয়া পামেলা বাঞ্জালাইটিস’৷

রোমান ঐতিহাসিক প্লিনির রচানায় ‘বঙ্গ’-এর উল্লেখ রয়েছে (সমুদ্র বন্দর পরস্থলীর সূত্রে) পুরাতন অনেক পত্রে এখনো ‘বাঙ্গালা’ শব্দ পাওয়া যায়৷ অজস্র কবি এই বাঙলা দেশের জন্যই কবিতা লিখেছেন৷

সংস্কৃত ভাষায় বাঙলা হল ‘বঙ্গদেশ বা ‘গৌড়দেশ’৷ বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্র গ্রন্থে ‘বঙ্গ’ শব্দটির উল্লেখ আছে --- ক) শিবোপদেশ--- শক্তি সঙ্গম অব্দ শিবপ্রোক্ত বঙ্গদেশ৷ খ) মহাভারতে ভীষ্ম পর্বে নবম অধ্যায়ে ৪৬তম শ্লোকে আছে অঙ্গা, বঙ্গা ইত্যাদি৷ গ) ঐতরেয় আরণ্যকে, ঐতরেয় ব্রাহ্মণে, শতপথ ব্রাহ্মণে মেলে বঙ্গের উল্লেখ৷ ঘ) রামায়ণে বঙ্গের পরিচয় আছে৷ ঙ) মনুসংহিতায় পৌণ্ড্র গোষ্ঠীর (বাঙলায় বসবাসকারী ভূমিপুত্র) উল্লেখ রয়েছে৷ চ) মহর্ষি কাত্যায়নের মহাভাষ্যে ‘বঙ্গ’ ---এর উল্লেখ আছে৷

ছ) বৌধায়ন ধর্মশাস্ত্রে, পুরাণে, আচারাঙ্গ সূত্রে (সুহ্মের), মহাবর্গে (বঙ্গের), দিব্যাবধানে (পুণ্ডের), ললিত বিস্তারে ও মহাবস্তুতে বঙ্গের উল্লেখ আছে৷ (চলবে)