আমার বাঙলা

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর, খনিজ সম্পদ---প্রাকৃতিক সম্পদের একটা বড় ক্ষেত্র হচ্ছে খনিজ সম্পদ৷ খনিজ সম্পদে বৃহৎবঙ্গ বাঙালীস্তান বিপুলা, ঐশ্বর্যশালিনী---লোহা তামা, ম্যাঙ্গানিজ, জিপসাম,সীসা, ক্রোমাইট, ডলোমাইট, বক্সাইট, সোনা, রূপা, কয়লা, গ্রাফাইট, পেট্রোলিয়ম, গ্ল্যাস-স্যাণ্ড, লবণ , পটাসিয়ম , জিঙ্ক, ম্যাগ্ণেসাইট, জিরকণ, সিলিমাইট, ইউরেনিয়ম, থোরিয়ম, কায়োনাইট, চীনামাটি, এ্যাস্বেটস, ব্যারাইটা মাইকা, উলফ্রাম, কোয়ার্টজ , সোপষ্টোন , ফায়ার ক্লে, চুনাপাথর, কেওলিন সবই রয়েছে বৃহৎ বঙ্গে৷ বলাবাহুল্য, বঙ্গ-মহাভূমির মত একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে এতো খনিজের বিপুল ভাণ্ডার ভারতের অন্যান্য রাজ্য কেন, সারা বিশ্বেই কমই আছে৷

* বনজ সম্পদ--- এককালে বাঙালীস্তানে বহু প্রকার বৃক্ষের বিস্তৃত অরণ্যানী বিরাজ করত ৷ এই অরণ্য সম্পদের এক বিরাট ভাণ্ডারকে (বিশেষ করে রাঢ়-এর) পরিকল্পনা মাফিক ধবংস করে দেয়া হয়েছে৷ তবু যা আছে সেই স্বাভাবিক উদ্ভিদের মধ্য উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ---শাল, সেগুন, পলাশ, মহুয়া, শিমুল, জারুল, গর্জন, গরান সুন্দরী, গেঁওয়া, গোলপাতা, কেলে ইত্যাদি৷ শিশু, শিরীষ, বাঁশ, বেত, হলদি, পিটুলি, ছাতিম, নিম, তাল, তমাল, খেজুর, বট, অশত্থ ইত্যাদি৷

* জলজ সম্পদ---নদী মাতৃক বাঙলা বিপুল জলসম্পদের ভাণ্ডার৷ এক দিকে বঙ্গোপসাগর ও মূল ভূখণ্ড-সংলগ্ণ অসংখ্য খাড়ি বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের জলে পুষ্ট অসংখ্য নদী, অন্যদিকে উত্তরে হিমালয় থেকে উৎপন্ন ও পশ্চিমে মালভূমি- পাহাড়ী অঞ্চল থেকে উৎপন্ন অসংখ্য নদ-নদী ৷ যেমন- গঙ্গা,পদ্মা,ভাগীরথী, ষমুনা, মেঘনা ব্রহ্মপুত্র, মেচি, বালাসন, কর্ণফুলি , মধুমতি , গোমতী, খোয়াই, করতোয়া, কংসাবতী , দ্বারকেশ্বরী , শিলাই , হলদি, সুবর্ণরেখা, দামোদর,অজয়, ময়ূরাক্ষী, রূপনারায়ণ, ভৈরব, জলঙ্গী, চুর্ণী, ইছামতী, কালিন্দী, রায়মঙ্গল, পিয়ালী, মাতলা, বিদ্যাধরী , গোসাবা ইত্যাদি ছাড়াও অসংখ্য খাল ,বিল, নালা, ভাঙড়, ডোবা , হাওড় ,সরোবর, বড় বড় দীঘি-পুষ্করিণী৷ অধিকন্তু, প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ভাষায়---‘‘আজকে আমাদের যে বাঙালী সভ্যতা ও সংস্কৃতি, তার শ্যামলতা, তার সুশোভনতা তা তৈরী করে দিয়েছে রাঢ়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদী-উপনদী বাহিত সভ্যতা- সংস্কৃতি ও তার সঙ্গে গাঙ্গেয় -সভ্যতা ও ব্রহ্মপুত্র সভ্যতার মহামিলনে বাঙালী সভ্যতা পেয়েছে তার অলোক-সামান্য মাধুর্য৷’’

*জীবজন্তু---বাঙালীর অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে এখানকার জীবজন্তু ৷ যেমন---হাতি, গণ্ডার, বাঘ, ভালুক, হায়না, শেয়াল, বাইসন, শূকর-বন্যশূকর, হরিণ, নেকড়ে, গরু, মহিষ, ছাগল ,ভেড়া ইত্যাদি সহ ময়ূর--- হাঁস-মুরগী- ও অসংখ্য প্রজাতির পাখি!

*শিল্প-বাণিজ্য-ঐতিহাসিকদের রচনা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে কৃষি প্রধান দেশ হলেও বাঙ্গলায় নানা রকম শিল্পজাত দ্রব্য তৈরী হ’ত৷ তবে প্রাচীনকাল থেকেই বিশেষ ভাবে বস্ত্রশিল্পের জন্যে বাঙলা দেশে বিদেশে প্রসিদ্ধি লাভ করে ছিল ,অর্থাৎ প্রাচীনকালেই বাঙলার বস্ত্রশিল্প যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছিল৷ এ দেশে ক্ষোম (শণের তৈরী কাপড়), দুকুল (এক জাতীয় সূক্ষ্ম কাপড়),পত্রোর্ণ (এক ধরণের রেশম), কার্পাস (কার্পাস তুলোর কাপড়) প্রসিদ্ধ ছিল৷’’ বাংলার যে মসলিন উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সমগ্র জগতে বিখ্যাত ছিল!’

* বস্ত্রশিল্পের পাশাপাশি বৃহৎ বঙ্গে রকমারি শিল্পের বিকাশ ঘটে---যেমন চিনিশিল্প, লবণশিল্প, মৎসশিল্প, কারুশিল্প, স্থাপত্য শিল্প লৌহশিল্প, কাষ্ঠশিল্প ,দতন্তশিল্প, কাংস্যশিল্প , নৌশিল্প, প্রস্তরশিল্প, মৃৎশিল্প, তৈজসপত্র (বাসন কোসন), স্বর্ণ ও মণি শিল্প, কুটির শিল্প-পটুয়া শিল্প, কাঁথা সেলাই শিল্প বাঙলার কর্মকার ও সুত্রধরেরা গৃহ, নৌকা, শকট প্রভৃতি নির্মাণ করতেন এবং দৈনন্দিন জীবন যাত্রার নানা উপকরণ যোগান দিতেন বস্তুতঃ কাষ্ঠশিল্প একটা উত্তরের সুক্ষ্ম শিল্পে উন্নীত হয়েছিল৷ বাঙলায় প্রাপ্ত বিভিন্ন লিপি-কাব্য-তাম্র পট্টোলি, ও ব্রহ্মগুপ্তের কাহিনীর মধ্যে এর স্বীকৃতি আছে৷

ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ তাঁর ইতিহাস - সমাজ - রাজনীতি গ্রন্থে দেখালেন---মেদিনীপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বাঙলার সমুদ্র সিঞ্চিত উপকূলভাগ প্রাচীনকাল থেকেই ছিল লবণ-শিল্পকেন্দ্র৷ মেদিনীপুরের তমলুক, হিজলী আবার এর মধ্যে প্রধান৷ আঠারো শতকের শেষভাগে এই দুই জেলায় প্রায় ৩৫ হাজার শ্রমজীবী এই শিল্পে লিপ্ত ছিল৷’’

এই দেশে তমলুক ও চট্টগ্রামের বন্দর অতি প্রসিদ্ধ ছিল৷ এখন চট্টগ্রামের হালিসহর ,পতেঙ্গ ডাধল, মুড়িং প্রভৃতি স্থানে প্রাচীন কালের জাহাজের অনুরূপ জাহাজ নির্মিত হয়ে থাকে৷ ‘‘(বৃহতত্ব ---দীনেশচন্দ্র সেন)৷’’ জাহাজ নির্মাণের একটা প্রাচীন ঐতিহ্য বাঙলার ছিল৷ প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে থেকেই বাঙলায় জাহাজ তৈরী করা হত৷ জাহাজ তৈরীর কেন্দ্রগুলি ছিল দক্ষিণবঙ্গে৷ মেদিনীপুর, হাওড়া, চবিবশ পরগণা অঞ্চলে--- বাঙলাদেশের খুলনা, বাখরগঞ্জ (প্রাচীন নাম চন্দদ্বীপ), নোয়াখালি ( প্রাচীন নাম ভল্লুক > ভুলুয়া) ও চট্রগ্রামে জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র ছিল৷ ‘‘--- বর্তমানে’’ ‘‘খুলনা, বাখরগঞ্জ ও নোয়াখালিতেও জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র স্থাপন করা যায়৷ এদিকে বসিরহাট, ডায়মণ্ডহারবার ও আলিপুরের পরিবেশ জাহাজ নর্মাণের পক্ষে অনুকূল৷’ ---প্রাউটের অর্থনীতি---শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷

অতীত বাঙ্গলার শিল্প বিন্যাসের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে---‘‘সংঘবদ্ধ শিল্প গোষ্ঠীর উদ্ভুতি ’’৷ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখছেন---’ এইরূপ সংঘবদ্ধ শিল্পী জীবনের ফলেই বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পীগোষ্ঠী ক্রমশঃ বিভিন্ন বিশিষ্ট জাতিতে পরিণত হইয়াছে৷ তন্তুবায়, গন্ধবণিক , স্বর্ণকার, কুম্ভকার , কংসকার , শঙ্খকার, মালাকার, তক্ষণ, তৈলকার প্রভৃতি বিভিন্ন শিল্পীসংঘ মাত্র ছিল৷ --- পরে ইহারা ক্রমে সমাজে - এক একটি বিভিন্ন সম্প্রাদায়ে পরিণত হইয়াছে৷ (জৈন-বৌদ্ধ যুগে ও ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের জাগরণের কালে বাঙলায় এই জাতপাতের ব্যাধিটি অনুপ্রবেশ করে)৷ ’ বাঙলার সমাজ ব্যবস্থায় এঁদেরকে ‘নবশাখ’ সম্প্রদায় বলা হ’ত৷ এগুলো আসলে পেশাভিত্তিক গোষ্ঠী৷ তৎকালীন সমাজে মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বা অর্থনৈতিক জীবনের প্রয়োজনে যুগের জীবন ধারায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে গেছে৷ আদিতে জাতপাতের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক ছিলনা৷ ধরণটা ছিল পরিবার কেন্দ্রিক কুটির শিল্প, একটি পরিবার বংশ পরম্পরায় একই পেশা নিয়েই চলেছিল৷ পরিবার বেড়েছে কিন্তু পেশা (জাত ব্যবসা) ছাড়েনি৷ মোটামুটি, নবাবী আমল পর্যন্ত এটাই ছিল অকৃষিজীবী সিংহভাগ বাঙালীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও নিশ্চিততা৷ বর্তমানে পশ্চিমা ধাঁচের আধুনিক শিল্পায়নের ও বাজার ব্যবস্থার গুঁতোয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পেশা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দুটোই গেছে, নামের শেষে পদবীগুলো তার স্মৃতিভার বহন করছে মাত্র৷ (চলবে)