পূর্ব প্রকাশিতের পর,
পঞ্চগৌড়ের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় রাঢ়বঙ্গের কথা---১)‘রাঢ়াবঙ্গ’--- পঞ্চগৌড়ের প্রথম গৌড় হচ্ছে ‘রাঢ়’৷ আর পঞ্চগৌড়ের মধ্যে রাঢ় সব চেয়ে বড়৷ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে রাঢ় বাঙলার প্রাকৃতিক চৌহদ্দি হচ্ছে---পশ্চিমে বিন্দ্যপর্বতের শাখা রামগড় পাহাড় ও সন্নিহিত শৈলময় অরণ্যময় মালভূমি অঞ্চল, এবং গঙ্গা-পদ্মা-ভাগীরথী-হুগলী---বঙ্গোপসাগর পরিবেষ্টিত ভূভাগ৷ রাঢ় কথাটি দুটি অর্থ প্রচলিত ১. প্রাচীন অষ্ট্রিক ভাষায় রাঢ় মানে রক্তমৃত্তিকার দেশ, অর্থাৎ সবচেয়ে প্রাচীন শিলা---গ্রানাইট শীলা গঠিত ভূভাগ৷ গ্রানাইট শিলাক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট ল্যাটারাইট মৃত্তিকা হয় লালচে (লৌহাকরিক থাকার কারণে)৷ ২. রাঢ় কথাটির বিশিষ্টার্থে আর এক অর্থ হচ্ছে সৌন্দর্যও বৈভব৷---এককালে সাল-মহুয়া-পলাশাদির অরণ্যশোভিত গিরি- ঝর্ণা ---ঝোরা- নদী- উপত্যকা খচিত রাঢ় বাঙলা ছিল অতুলনীয় সৌন্দর্যের ভূস্বর্গ৷ আর অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদে প্রকৃতির অমেয় কৃপাধন্য রাঢ়৷ খনিজ ---প্রাণীজ---বনজ---কৃষিজ---সব সম্পদেরই সহাবস্থান ছিল রাঢ়ের মাটিতে৷ তাই সৌন্দর্যের---বৈভবের রাণী--- বাঙলার এই অঞ্চলটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘রাঢ়’৷ ভূমি বৈশিষ্ট্যে রাঢ়ের আর এক নাম ছিল ‘সুক্ষ্ম’৷
প্রাচীন কালের ভুক্তি ভিত্তিক ‘জনপদ’ বিভাজন রীতি অনুযায়ী রাঢ়ের ছিল দু’টি ‘ভুক্তি’৷ ১) বর্ধমান ভুক্তি ও ২) দণ্ডভুক্তি৷
অ.১) বর্ধমান ভুক্তি দামোদরের উত্তরে রাঢ়ের উত্তরাংশ নিয়ে বর্ধমান ভুক্তি৷ একালের জেলাভিত্তিক অবস্থান হচ্ছে --- সাবেক বর্ধান, ধানবাদ, বীরভূম, দেবঘর, দুমকা, গদ্দা, সাহেবগঞ্জ ও পশ্চিম মুর্শিদাবাদ৷ সেকালে হাওড়া ও হুগলি বর্ধমান জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল৷
২৷ দণ্ডভুক্তি---সাবেক মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, মানভূম, পূর্বরাঁচি, সিংভূম ও ভঞ্জভূম নিয়ে ছিল দণ্ডভুক্তি৷
আ. দিকগত বিচারে রাঢ়ের দুটি ভাগ ---
অ) পূর্ব রাঢ় --- মোটামুটি জেলাভিত্তিক পূর্ব রাঢ় হচ্ছে ---পশ্চিম মুর্শিদাবাদ, বীরভূম জেলার উত্তরাংশ, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, বাঁকুড়া জেলার ইন্দাস থানা৷
আ. পশ্চিম রাঢ়,---জেলাভিত্তিক পশ্চিম রাঢ় হচ্ছে সাবেকসাঁওতাল পরগণা, বীরভূম জেলা উত্তরাংশ বাদে, বর্ধমানের পশ্চিমাংশ, ইন্দাশ থানা বাদে বাঁকুড়া জেলা,পুরুলিয়া জেলা,ধানবাদ জেলা, হাজারিবাগ জেলার (বর্তমান গিরিডি জেলা) কাস্মার পেটারওয়াড, গোলা, জেরিডি ও রামগড়াদি, রাঁচি জেলার সিল্লি সোনাহাতুবুন্দু ও তামার থানা, সিংভূম জেলা, মেদিনীপুর জেলার ঝাড়্গাম- সদর ও সদর দক্ষিণ৷
ই. দিকগত বিভাজন---ঐতিহসিকেরা দিকগত পরিচয়ে রাঢ়কে উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন৷ অজয় নদ দুই ভাগের সীমা রেখা৷ আবার রাঢ়দেশ গঙ্গার দক্ষিণে ও পশ্চিমে সীমাবদ্ধ ছিল৷
ভূমান্তিক বিভাগ,---রাঢ় বাঙলার জনবিন্যাসের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভূকান্তিকতা৷ মানে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ছোট ছোট রাজ্য বা জনপদগুলোর নামের শেষে থাকত ‘ভূম’৷ যেমন---১. বীরভূম, ---অষ্ট্রিক ভাষায় ‘বীর’ মানে অরণ্য৷ এই জনপদে ‘সিংহ’ পদবীধারী কায়স্থ রাজারা রাজত্ব করতেন৷ ২. গোপভূম---এখানে ঘোষ পদবীধারী রাজারা রাজত্ব করতেন৷ এই রাজাদের মধ্যে ‘ইছাই ঘোষ’ ছিলে স্বনামধন্য পুরুষ৷ ৩. সামন্তভূম,---এখানে উগ্রক্ষত্রিয় ‘সামন্ত’ পদবীধারী রাজারা রাজত্ব করতেন৷ ৪. শিখর ভূম --- পরেশনাথ পাহাড় ---এর আর এক নাম ‘সমেতশিখর’৷ এই রাজ্যের সীমানায় থাকা সমেতশিখর পাহাড়ের নাম অনুসারে জনপদটির নাম হয়েছে ‘শিখরভূম’৷ অঞ্চলটায় বিশেষভাবে বাঙলার রাজুয়ারা, বেদে মাহাতো ও বাউরিরা বসবাস করান৷ এছাড়া আছেন রাঢ় নিবাসী মৈথিল ব্রাহ্মণদের এর শিখর---সমাজ নামে একটি শাখা৷ ৫. মল্লভূম,---এটা মূলতঃ বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণপুর মহকুমা৷ বীর হাম্বির মল্ল এই জনপদের প্রতিষ্ঠাতা৷ তাই এই ছোট রাজ্যের নাম হয়েছিল ‘মল্লভূম’৷ ৬. সেনভূম, --- এটাও ওই বাঁকুড়ারই সদর মহকুমা৷ ‘সেন’ পদবীধারী রাজারা এখানে রাজত্ব করতেন৷ তার থেকেই রাজ্যটির নাম সেনভূম৷ উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে--- রাঢ়ীয় বৈদ্যদের মধ্যে একটা আলাদা সেনভুম সমাজ আছে এখানে ৷ ও আর কথিত আছে যে সেনভূমের রাজা বাঁকুড়া রায়ের নাম অনুসারে ‘বাঁকুড়া’ নামটি এসেছে৷
৭.মানভূম,---রাজ্যের রাজা মানসিংহ দেব-এর নাম অনুসারে রাজ্যটির নাম হয়ে ছিল ‘মানভূম’, প্রাচীন রাজধানী ‘মানবাজার’৷ উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে---পরবর্তীকালে এই রাজ্যেরই সিংহভাগ অংশ নিয়ে গঠিত হয় ‘কাশীপুব’রাজ্য৷ এছাড়াও ‘জয়পুর ও ঝালদা’র জমিদারী ছিল এই রাজ্যরই অংশ৷ ৮. বরাহভূম---আদিবরাহ ও কেশবরাহ নামে দুই মুণ্ডাভাই রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা করেন৷ পরবর্তীকালে রাজ্যটি টুকরো টুকরো হয়ে ছোট ছোট জমিদারীতে পরিণত হয়৷
৯.সিংহভূম---কোল উপজাতির রাজারা রাজ্যটি শাসন করতেন৷ পরে রাজ্যটি ভেঙে দু’টুকরো হয়---পূর্বাংশের নাম হয় পোড়াহটি, পশ্চিমাংশের নাম হয় ‘সিংভূম’৷ আবার পরবর্তীকালে ভাগ হয়ে পোড়াহাটি রাজ্য হয় পশ্চিমে ‘খঁরসোবা রাজ্যও পূর্বে সেরাইকেল্লা রাজ্য৷ ইংরেজ আমলে দু’টোই ছিল দেশীয় রাজ্য ৷
১০.ধবলভূম বা ধলূম,---এই রাজ্যের রাজাদের পদবী ছিল ধবলদেও,তার থেকে রাজ্যের নাম ধবলভূম ৷
১১.শবরভূম,--- শবর জাতীয় অর্থাৎ খেড়িয়ামোড়া রাজারা এখানে রাজত্ব করতেন ৷ পরবর্তীকালে এই রাজ্যটিও ভেঙে অনেকগুলো জমিদারীতে পরিণত হয়৷
১২. ভঞ্জভূম , --- ময়ূরভঞ্জ রাজ্যটির প্রাচীন নাম ভঞ্জভূম ৷ রাজপরিবারের সকলের প্রতীকেই ময়ূর আঁকা থাকত মলে রাজ্যটিকে বলা হ’ত ময়ূরভঞ্জ ৷
১৩.সপ্তশতী, ---সপ্তশতী (সাতশইকা) ব্রাহ্মণ রাজারা এখানে রাজত্ব করতেন৷ মুসলিম যুগে এদের রাজত্ব শেষ হয়ে যায় ৷
১৪. ভুরিশ্রেষ্ঠ বা ভুরশুট,---রায় (বন্দ্যোপাধ্যায়) পদবীধারী রাঢ়ী ব্রাহ্মণ রাজারা এখানে রাজত্ব করতেন৷ (চলবে)
- Log in to post comments