আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে

লেখক
একর্ষি

(পূর্বপ্রকাশিতর পর)

অর্থনীতির বিভাগগুলির প্রসঙ্গে আর-একটা কথা জানা দরকার যে এযাবৎ  যত অর্থনৈতিক তত্ত্ব  এসেছে সেগুলোকে  দুটো প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় 

১. কেন্দ্রিত অর্থনীতি, ও

২. বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি।

বিভাগগুলির  মধ্যে  একমাত্র  প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিই বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি, বাকী সব কেন্দ্রিত ধারক ও বাহক । নোবেল পুরস্কারে  সম্মানিত প্রথম অর্থনীতিবিদ থেকে সর্বশেষ অর্থনীতিবিদ পর্যন্ত কেউই মুনাফামুখী পুঁজিবাদী কেন্দ্রিত অর্থনীতির বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু বলেননি । বরং তাঁরা  বাকবিন্যাসের জটাজাল বিস্তার করে, কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে  কেন্দ্রিত অর্থনীতিকেই  প্রকারন্তরে  সমর্থন  দিয়ে গেছেন । এবং মানবতাকে একরকম এড়িয়েই গেছেন। কেন্দ্রিত অর্থনীতির  সুফল ভোগ করে  মুষ্টিমেয় উচ্চবিত্তের মানুষ , বৃহত্তর সাধারণ মানুষের ঘরে  তার ছিঁটে-ফোটাও  পৌঁছায় না , -- যা পৌঁছায় সে হচ্ছে কেন্দ্রীভূতকরণের বিরুদ্ধে গণবিষ্ফোরণের থেকে রেহাই পাওয়ার রক্ষাকবজস্বরূপ 'সেফ্‌টি ভাল্ব' নাম তার 'দয়া-দাক্ষিণ্য-ভিক্ষা' ; তা অবশ্যই 'স্বক্ষমতা-ক্রয়ক্ষমতা-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নয়। পক্ষান্তরে নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত  আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বাঙালী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস   প্রথাগত  কেন্দ্রিত অর্থনৈতিক কাঠামোর  বাইরে বেরিয়ে এসে  আংশিক ভাবে হলেও , কিছু মানুষের  উপকারে এলেও  বিকেন্দ্রিত অর্থনীতির স্বতন্ত্র ভাবনাকে  বাস্তবে বিষ্ময়কর প্রয়োগ সাফল্যের   সম্ভবনাময় নোতুন দিগন্তের দরজা   দেখিয়ে দিয়েছেন । ( অবশ্য সর্বস্তরের মানুষের সার্বিক কল্যাণের  দিশা রয়েছে বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি আধারিত প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক অর্থিনীতির মধ্যে)। নানান বিরোধিতা ও প্রতিকূলতাকে হেলায় উপেক্ষা করে তিনি 'গ্রামীন ব্যাংক' আন্দোলনের মাধ্যমে দেখিয়েছেন বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক কাঠামোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক কল্যাণ  সম্ভব। পৃথিবীর প্রায় ৫৮টি দেশে  তিনি তার সাফল্যের  দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর কথা হল"পৃথিবীতে মানুষকে গৌরবের সঙ্গে বাঁচতে হলে  শুধুমাত্র মুনাফা অর্জনের  নেশা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে । মনুষ্যত্ববর্জিত অর্থনীতির জায়গায় মনুষ্যত্বকে সকল চিন্তা এবং কর্মকান্ডের কেন্দ্রে রেখে  নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরী করতে হবে ।" উত্তরণের  পথ হিসেবে  তাঁর নির্দেশিত  তিনটি শূন্যের জন্যে পদক্ষেপ"  এক. নেট কার্বন নিঃসরণকে  শূন্যে নামিয়া আনা । দুই. সম্পদের  কেন্দ্রীভূতকরণকে  শূণ্যে নামিয়ে আনা । তিন. ব্যাঙ্কিং  ব্যবস্থাকে সামাজিক ব্যবসায় রূপান্তরিত করার মাধ্যমে সবার  জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা এবং  বেকারত্বকে শূন্যে নামিয়ে আনা ।"  

তাঁর কৃতিত্বকে সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা জানিয়েও বেশীকিছু  না বললেও   দু'একটি কথা  তো বলতেই হয়। প্রথম কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে তাঁর ক্ষুদ্র-ঋণ প্রকল্পে অংশঅগ্রহন  ৯৮ শতাংশ মহিলাদের, এদের জন্য প্রথাগত ঋণব্যবস্থার মত কোন জামিনদার (গ্যারাণ্টার) বা জামিন রাখার ব্যবথা ছাড়াই। তাঁর ভবীষ্য-দৃষ্টি ছিল গ্রামের সবচেয়ে অবহেলিত-হতদরিদ্র-অজ্ঞ-নিরক্ষর-ধর্মভীরু-সংস্কারবদ্ধ মহিলারা ঋণের সামান্য টাকার অপব্যবহার করবেনা, কিস্তিরও খেলাপ করবে না । এই বিশ্বাসে ভর করেই তিনি এগিয়েছেন , এখানেও সাফল্য  ৯৮ শতাংশের বেশী । ঘুরিয়ে বললে ব্যাপারটার মানে দাঁড়াল গ্রামোন্নয়ন বা গ্রামের মানুষের উন্নয়নে  (উন্নয়নের সব ­ক্ষত্রেই) নৈতিকতার ভিত্তিটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত, ' কাওকে আমি ঠকাবো  না।' বোধ হয় এই কারণে পুরুষমহলের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি , অথচ নীতি বোধে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোণ পথও দেখাননি । নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের উণ্ণয়নই  প্রকৃত উন্নয়ন। দ্বিতীয় কথা--গ্রামীনব্যাঙ্ক  আন্দোলন  বা ক্ষুদ্র-ঋণ প্রকল্প  কোন গ্রাম বা কোন পঞ্চায়েত বা  কোন ব্লকে বা কোন নির্দিষ্ট  অঞ্চল জুড়ে  হয়নি। সমাজের সার্বিক উন্নয়ন প্রকল্পও এটা নয়, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মানুষের  মঙ্গলভাবনা একথা আগেই বলা হয়েছে ,অর্থাৎ সামগ্রিকতার অভাব রয়েছে। কৃতিত্বটা সমাজের ক্ষুদ্র-ভগ্নাংশ-করপোরেট সমাজের বা পুঁজিপতিদের মুনাফামুখী অমানবিক কেন্দ্রীভূতকরনের বিরুদ্ধে,  নিঃস্বার্থ-ভালবাসার আবেগে উদ্বুদ্ধ হয়ে  সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্যে স্বপ্ন দেখা ও বাস্তবে কিছু  করে দেখাণোর  দুঃসাহসিকতায় ।

'অর্থশাস্ত্র'কে সামনে রেখে এপর্যন্ত যা  বলা হল, অর্থনীতির পরিচয় দিতে গিয়ে কথাটি  ব্যুৎপত্তিগত ও প্রয়োগ গত অর্থ সন্ধান অর্থনীতিবিদের  বক্তব্য  মন্থন করলে  চেতনার  কতগুলো  দিগন্ত খুলে যায় । যথাঃ- (ক) অর্থনীতির সিদ্ধান্তগুলোকে  হতে হবে প্রয়োগভৌমিক তথা প্রাকৃতিক শক্তির সংগে সংগত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা মানুষের অস্তিত্ব ও তার অবস্থান-বৃত্তের (চৌহদ্দীর)পরিক্ষেত্রটা বিরাজ করছে  কঠোর ভাবে ' ল অব্‌ দ্য নেচার'-এর  ওপর দাঁড়িয়ে । গায়ে চিমটি  কাটলে যেমন নিজের অস্তিত্ব বোঝা যায় ,তেমনি কঠোর বাস্তবতার ছেঁকা পদে পদে মানুষের মালুম হয়।  নজির হিসাবে বণ্টন ব্যবস্থাকে নেয়া যাক।  বণ্টন হচ্ছে চারপায়া চৌকির মতন অর্থনীতির একটা  গুরুত্ব পূর্ন পায়া ( স্তম্ভ) ।  সমাজে বণ্টনব্যবস্থার ওপরেই দাঁড়িয়েমানুষের ভোগ ব্যবস্থা। বণ্টনের সংগে জড়িয়ে আছে  জগতের  কল্যান ও অকল্যাণ। তাই বণ্টন নীতি  গ্রহণের আগেভাগে কতগুলো প্রাকৃতিক সূত্র ও সত্যকে  মানা দরকার । যেমন - ১।  মানুষ মন প্রধান জীব । কেড়ে খাওয়া , মেরে খাওয়া  ,শোষণ - বঞ্চনা  ও ব্যষ্টি-সমষ্টির কল্যাণ ভাবনার উৎস্থল মানুষের  ওই মন । ' মনটাই করে যত গোলমাল ।' তাই বাউল বলে পাগলা তোর মনটাকে বাঁধ ।                                       ২। বৈচিত্র্যই প্রকৃতির  ধর্ম । এই জগতের কোন দুটো বস্তুই হুবহু এক নয় ; দুটো মন এক নয় ; এমনকি দুটো অণু পরমাণুও এক নয়। এই বৈচিত্র্যই প্রকৃতির স্বভাব। কেউ যদি  সব কিছুকে  সমান করতে চায় তবে  তা মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই নয়।  এটা তো প্রাকৃত ধর্মের বিরোধিতা। এর ফল ব্যর্থ হওয়াই স্বাভাবিক কথা।  ৩।  পৃথিবীর একটা নির্দিষ্ট আকার ,আয়তন ও  ভর (মাস্‌) আছে । তাই পৃথিবীর  যে সমস্ত সম্পদ তাও সীমিত। এই সীমিত সম্পদ দিয়েই  জগতের সব মানুষের  অভাব-দুঃখ দূর করতে হবে ও তার স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে । ৪। *সম্ভাব্য প্রতিকূল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করে। যুক্তিসংগত প্রয়োজনের বাইরে  অহেতুক সঞ্চয় করলে   অন্যদের অভাব মেটাতে  ভাঁড়ারে টান পড়বে। * তাছাড়া অনেকে সঞ্চয় করে যা প্রয়োজনের অতি অতিরিক্ত, অথচ তা ভোগ করে না  বা কোন কাজেই লাগেনা;' আমার এত আছে 'এটা ভেবেই , দেখেই তাদের চোখের  সুখ'।  ফলটা কী হল না  জমিয়ে রেখে  অন্যকে অভাব মেটাতে বঞ্চিত করল । তাহলে ব্যাপারটা কী হল না এটা একটা মানসিক ব্যাধি। *আবার মানুষের ধর্ম (স্বভাব ধর্ম , প্রপার্টি ) হচ্ছে মানুষ যা চায়  তা অনন্তভাবে চায়, ভৌতিক সম্পদ তো সীমিত । সীমিত ভৌতিক সম্পদ যা নিজেই সীমাবদ্ধ  তা সীমাহীন অনন্ত সুখ দেবে কি করে । অবাস্তব ,তা কখনও কোন কালে  হ্য়না ।  একজন-দুজন ,বা কিছু মানুষ কিংবা সবাই  যদি স্বভাব ধর্মের এষণায় অনন্ত সুখ পেতে ভৌতিক সম্পদের দিকে মন ছুটিয়ে দেয়  তাহলে  অন্যদের  জাগতিক  দুঃখ ঘুঁচবে কি করে?  এই বিকৃত মানসিকতার  মানুষগুলোর দুঃখ তো ঘুচবেই না , উল্টে তারা অন্যদের চরম ভাবে বঞ্চিত করবে , শোষণের পথ খুলে দেবে ।  তাই সঞ্চয়টা বিভাগীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত সামবায়িক সংস্থার  বা কালেক্‌টিভ্‌বডি'র (বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত উচ্চপর্যায়ের নিয়ামক সংস্থা) অনুমোদন সাপেক্ষ  হওয়া দরকার । ৫। ভৌতিক সম্পদে  অনন্ত সুখ মিটছেনা , অথচ মানুষের মনে  সীমাহীন সুখের তীব্র বাসনা আছে। এই সুখ মেটাবার ব্যবস্থা সমাজে না-থাকলে বণ্টনব্যবস্থা গড়ে তোলা অসম্ভব। জেনে রাখা ভাল, মানসিক সম্পদ ও আধ্যাত্মিক সম্পদ সীমাহীন। পৃথিবীর সবাই যদি একসঙ্গে  মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদ কুক্ষীগত করতে চায়  তাহলেও কারো কিছু যাবেনা আসবে না। কেউই শোষণ-বঞ্চনার শিকার হবে না। তবে একটা কথা, সমাজে, সংবিধানে (সাংবিধানিক অধিকার হিসাবে)মানসিক-আধ্যাত্মিক সম্পদের অধিকার ও পাওয়ার নিশ্চিততা থাকতে হবে । ৬। প্রকৃতির শিক্ষা ভোগের জন্য জীবন  নয়, জীবনের জন্যেই ভোগ  অর্থাৎ অস্তিত্ব রক্ষা করতে, জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে, উদ্বর্তনায় এগিয়ে যাবার জন্যেই ভোগব্যবস্থা। সমাজে এই সহজ সত্য কথাটার মান্যতা না থাকলে  বন্টন ব্যবস্থা  গড়ে তোলা কঠিন ।                                                                                                                                     (ক্রমশঃ)