অমৃত–উৎসব নয়–চাই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম

লেখক
মনোজ দেব

স্বাধীনতা লাভের ৭৭ বছর অতিক্রান্ত হ’ল, এখনও প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ণ ওঠে জনগণ কি সত্যই স্বাধীনতা লাভ করেছে এ প্রশ্ণ উঠেছে এই জন্যেই যে, স্বাধীনতা লাভের পর খাতায় কলমে এতগুলো পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হ’ল, আবার নতুন সরকার নতুন নামে পরিকল্পনা শুরু করলো৷ গরীবী হটানোর জন্যে কত না প্রতিশ্রুতি সরকারের পক্ষ থেকে শোণানো হ’ল, কিন্তু এ সব সত্ত্বেও তো আজ দেশের কোটি কোটি মানুষ দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না৷ বিভিন্ন আর্থিক সংস্থার প্রকাশিত তথ্য বলছে ভারতের সিংহভাগ সম্পদ করায়ত্ব করে রেখেছে মুষ্টিমেয় ধনিক সম্প্রদায়৷ তারাই অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক, জনগণের ভাগ্য বিধাতা৷ শাসক শুধু কলের পুতুল৷ স্বাধীনতার অমৃত কারা পান করছে কাদের জন্যে স্বাধীনতার অমৃত কাল৷

কিন্তু এদিকে আবার সরকার আমাদের শোণাচ্ছেন, ভারত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে! জিডিপি বাড়ছে! কিন্তু কাদের আয় বাড়ছে রমা কৈর্বত্য, হাসিম শেখ, যারা মাথার ঘাম ফেলে গায়ের রক্ত জল করে মাঠে কাজ করে–সোণার ফসল ফলায় তারা–তাদের পরিবারের লোকজন –তাদের আয় বাড়ছে কি আয় বাড়ছে তো মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর, আয় বাড়ছে তো সুবিধাভোগী কিছু রাজনৈতিক নেতার আর তাদের কৃপাধন্য কিছু উচ্চবেতনভোগী চাকুরী জীবীর৷ তাদের আয় বাড়লেই কি আম জনতার আয় বাড়ল! তাদের মুখে হাসি ফুটে উঠল!

তাহলে এ স্বাধীনতা কাদের স্বাধীনতা ওই মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী মানুষেরা নয় কি জনসাধারণ ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতির কথা শুণতে শুণতে ক্লান্ত৷ আর কোনো প্রতিশ্রুতিতে ওদের মন ভরে না৷

কিন্তু এর মূল কারণ কি আগে ব্রিটিশরা না হয় সবকিছু শোষণ করে নিয়ে যেত৷ এখন কী কারণে যারা খাদ্য উৎপাদন করে তাদের পেটে অন্ন নেই, যারা বস্ত্র উৎপাদন করে তাদের পরণে কাপড় নেই, যারা ঘর বানায় তাদের ভাল করে মাথা গুঁজবার ঘর নেই, কেন দেশের ছাত্র–যুবা যারা দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ তারা বেকারত্বের জগদ্দল পাথরের চাপে নিষ্পিষ্ট৷

তার মূল কারণ তো এইটাই যে, দেশের শাসকগোষ্ঠী পুঁজিবাদী নীতি নিয়ে চলেছে, পুঁজিবাদের ওপর নির্ভর করে চলছে৷ আর জনগণকে অর্থনীতির তত্ত্ব কথার কচকচানি শুনিয়ে চলেছে৷ সেই পুরনো গদ! পুরাতনের জীর্ণ কংকালকে আঁাঁকড়ে ধরে রেখেছে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা৷

কবিগুরু বলেছেন,

‘‘পুরোনো সঞ্চয় নিয়ে শুধু বেচাকেনা, আর চলিবে না৷

বঞ্চনা বাড়িয়া ওঠে ফুরায় সত্যের যত পুঁজি৷’’

এই পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে রেখে কিছুই লাভ হবে না৷ মূল নীতি যদি ভুল হয়, যতই কর্মদক্ষতা দেখানো হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত সবই ভস্মে ঘি ঢ়ালার সামিল হবে৷

তাই চাই নোতুন আদর্শ, যা পুঁজিবাদ ও জড়বাদী ত্রুটি থেকে মুক্ত৷ সেই নোতুন আদর্শের সন্ধান দিয়েছেন মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্চন সরকার৷ যে আদর্শের নাম ‘প্রাউট’৷ ‘প্রাউট’ বলছে, অর্থনৈতিক গণতন্ত্রই একমাত্র বিকল্প৷ ধনতন্ত্রে দেশের সম্পদ ক্রমশঃ কুক্ষিগত হতে থাকে ধনিক শ্রেণীর হাতে, আর মার্ক্সবাদে দেশের সম্পদ কুক্ষিগত হয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে–তারাই হয়ে ওঠে ‘নয়া বুর্জোয়া শ্রেণী’৷ জনগণের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা থাকে না, আর অর্থনৈতিক ক্ষমতার অভাবে শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে আর কোনো ক্ষমতাই থাকে না৷

তাই প্রাউট–প্রবক্তা বলেছেন, অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে প্রথমে অর্থনৈতিক ক্ষমতা জনগণের হাতে দিতে হবে৷ সবাইকে ‘ক্রয়ক্ষমতা’ দিতে হবে–নিত্য প্রয়োজনীয় সমস্ত দ্রব্যের ক্রয় করার সামর্থ্য দিতে হবে৷ স্থানীয় মানুষের হাতে থাকবে স্থানীয় অর্থনৈতিক উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষমতা৷ স্থানীয় অর্থনীতি–জমি বা কলকারখানার মালিকানা বা কৃষি–শিল্প–ব্যবসা–ব্ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার ওপর বহিরাগত লুঠেরা পুঁজিপতিদের কোনো অধিকার থাকা চলবে না৷ তবেই জনগণ প্রকৃত স্বাধীনতা পাবে৷

আর তা করতে গেলে দেশের শাসকগোষ্ঠীকে পুঁজিবাদ বা মার্ক্সবাদের মোহ থেকে মুক্ত হতে হবে–নিঃস্বার্থ হতে হবে–‘অর্থনৈতিক গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠায় নিষ্ঠাশীল হতে হবে৷ তা না হলে কেবল প্রতিশ্রুতি ও চমক সৃষ্টির বন্যা বইয়ে দিয়ে আখেরে জনগণের কোনো লাভ হবে না৷ জনগণকেও এই সত্য সুস্পষ্টভাবে বুঝতে হবে ও সরকারকে এই পথে আনতে বাধ্য করতে হবে৷ তাই স্বাধীনতার অমৃত–উৎসব নয়, চাই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম৷