আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব বা প্রাউটের ভিত্তি হ’ল নব্যমানবতাবাদ৷ বিশ্বের সমস্ত মানুষ, শুধু মানুষই নয়, পশুপক্ষী, তরুলতা সকলের কল্যাণই নব্যমানবতাবাদের মূল কথা৷

এই পৃথিবীর রুক্ষ মাটিতে এর বাস্তবায়ন হবে কিভাবে? তাও প্রাউট-প্রবক্তা তাঁর সমাজ দর্শনে উল্লেখ করেছেন৷ এই পথ হ’ল প্রাউটের ‘সমাজ আন্দোলনে’র পথ৷ এখানে এই ‘সমাজ’ কথাটি একটি বিশেষ অর্থ বহন করে৷ এখানে ‘সমাজ’ বলতে বোঝানো হয়েছে এক-একটি স্বনির্ভর হওয়ার সম্ভাবনাপূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলের জনগোষ্ঠী (সোসিও-ইকনমিক- ইয়ূনিট)৷

এই অঞ্চলটিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার জন্যে যে আন্দোলন তাকেই বলা হচ্ছে প্রাউটের সমাজ আন্দোলন৷ এমনি ভাবে প্রাউটে সারা বিশ্বের সমস্ত এলাকারই উন্নয়ন ঘটানোর কথা বলা হয়েছে৷ আর এজন্যে ওই এলাকার আপন আপন বৈশিষ্ট্য অনুসারে পৃথকভাবে পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে ওই এলাকাকে সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ শোষণমুক্তকরণ ও তার সর্বাত্মক উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে৷

শোষক ও শোষিতের মধ্যে প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না৷ তাই সমস্ত এলাকা তথা সমস্ত জনগোষ্ঠীকে শোষণমুক্ত করে তাদের সর্বাত্মক উন্নয়নের পথ ধরেই বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে৷ প্রাউটের এই নীতিকেই বলা হয়েছে---‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা৷’

যেমন ধরা যাক এক বিস্তীর্ণ অনাবাদী মালভূমি সদৃশ অঞ্চলের উন্নয়ন ঘটাতে হবে৷ এক্ষেত্রে প্রথমে ওই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের ভূমির প্রকৃতি, উচ্চতা তার জলধারণের ক্ষমতা ইত্যাদি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ওই অঞ্চলকে কতকগুলি প্লটে বিভক্ত করতে হবে ও বিভিন্ন প্লটের জন্যে তার ভূমির বৈশিষ্ট্য অনুসারে পৃথক  পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে৷ হয়তো কোনও প্লটে ভাল ধান হতে পারে, কোথাও রবিশস্য হতে পারে, কোথাও বসতবাড়ী ও দোকানপাট হতে পারে৷ এইভাবে প্রতিটি প্লটের জন্যে পৃথক পৃথক পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিটি এলাকার উন্নয়নে হাত দিতে হবে৷

বৃহত্তর মানব সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্যে এই ধরনের পরিকল্পনা নিতে হবে৷ তাই প্রাউটের পরিকল্পনায় গোটা পৃথিবীকে প্রায় তিন শতাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে৷ সম অর্থনৈতিক সমস্যা, সামূহিক মনস্তত্ত্ব, অভিন্ন ভাষা-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের  ধারা, জলবায়ু, ভূপ্রকৃতি, যোগাযোগের সুবিধা, অর্থনৈতিক বিকাশ ও স্বয়ম্ভরতা অর্জনের সম্ভাবনা প্রভৃতি নানান দিক বিবেচনা করেই এই বিভাজন করা হয়েছে৷ প্রাউটের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে প্রতি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্যে ওই অঞ্চলের সমস্যা---বিশেষ করে অর্থনীতি সমস্যা ও সম্ভাবনার ভিত্তিতে পরিকল্পনা ও কর্মসূচী রচনা করতে হবে৷ আর এই পরিকল্পনা রচনা ও রূপায়নে পূর্ণ অধিকার ওই অঞ্চলের মানুষেরই ওপর থাকবে৷ এই সমস্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলকে প্রাউটের ভাষায় বলা হয়েছে ‘সমাজ’৷ যেমন বাঙালী সমাজ, উৎকল সমাজ, অঙ্গিকা সমাজ প্রভৃতি৷

আর, বিশেষ এক সমাজের, ন্যায় সঙ্গত সদস্য তাকেই বলা হবে যে ওই অর্থনৈতিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের সঙ্গে নিজের স্বার্থকে মিলিয়ে দিয়েছে৷ যেমন কোন একজন ‘ক’ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বসবাস করছেন, এখন তিনি যদি তাঁর উপার্জিত অর্থ অন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলে পাচার না করে’ ওই অঞ্চলে ব্যয় করেন, তাহলে তাঁকে এই ‘সমাজে’র বৈধ সদস্য বলে গ্রহণ করা হবে, তিনি যে ভাষাভাষী হোন না কেন, তাতে কিছু যায় আসবে না৷

যেমন বাঙলাতে যারা স্থায়ীভাবে বাস করেন তিনি যে ভাষাভাষী হোন না কেন, তিনি যদি তাঁর সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বার্থকে ওই এলাকার স্বার্থের সাথে মিশিয়ে দেন তাহলে তিনি তিনি বাঙালী বলেই পরিগণিত হবেন৷ তাকে এখানকার স্থানীয় মানুষই বলা হবে৷

বিভিন্ন সমাজের মধ্যে সমন্বয়-সাধনকারী সংস্থা হ’ল প্রাউটিষ্ট সর্বসমাজ সমিতি৷ এই বিভিন্ন প্রাউটিষ্ট ‘সমাজ’ আপন আপন এলাকায় অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ তথা স্বয়ম্ভরতার আন্দোলন করবে৷

সেই সব আন্দোলন কখনও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে রূপ নিতে পারবে না, তার কারণ---

(১) সবার আদর্শ এক আর তা হ’ল প্রাউট৷

(২) সবাই এক সংস্থার নির্দেশ মেনে চলবে৷ ওই সংস্থা হ’ল---প্রাউটিষ্ট সর্বসমাজ সমিতি৷

(৩) সবাই শোষণ বিরোধী আন্দোলন করে যাবে ৷ এখানে শোষণের সংজ্ঞাও অভিন্ন৷

(৪) সবার সর্বোচ্চ নেতৃত্ব অভিন্ন৷

(৫) সবার ভিত্তি নব্যমানবতাবাদ৷

প্রাউটের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে মৌল অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির সমাধান হয়ে গেলে, যেমন সকলের নূ্যনতম চাহিদার গ্যারাণ্টি মিললে, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার অবদমনের অবসান হলে ও অর্থনৈতিক মানের মধ্যে মোটামুটি সমতা এলে---একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চলকে মিলিয়ে বৃহত্তর অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে৷ এইভাবে ধীরে ধীরে গোটা ভারত বা গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এক অভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হবে৷ এমন একদিন আসবে গোটা পৃথিবীটাই এক অভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হবে৷

এই হ’ল প্রাউটের সমাজ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য৷ ‘আমরা বাঙালী’ প্রাউটের এই নীতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে৷ এখানে বাঙালী বলতে তাদেরই বোঝানো হচ্ছে, যাঁরা বাঙলায় উপার্জিত অর্থ বাঙলাতেই খরচ করেন, এখানকার ভাষা সংসৃকতির প্রতি যিনি শ্রদ্ধাশীল, তিনি যে কোনও ভাষাভাষী হোন না কেন৷ ‘আমরা বাঙালী’ প্রাউটিষ্ট সর্বসাজ সমিতির সদস্য ও ভারতের অন্যান্য সমাজ যেমন ভোজপুরি সমাজ, অঙ্গিকা সমাজ, কোশল সমাজ প্রভৃতির সঙ্গে বহুবার যৌথ মিছিলও করেছে৷ এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় ‘আমরা বাঙালী’ অন্য কোনও ভাষাভাষীদের বা সমাজের বিরুদ্ধে নয় ‘আমরা বাঙালী’ প্রাউট তথা নব্যমানবতার ভিত্তিতেই শোষণমুক্ত সুসমৃদ্ধ পূর্ণ বাঙলা (বাঙালীস্তান) গড়তে চায়৷ ‘আমরা বাঙালী’ অন্য কোন ‘ভাষাভাষী’ বা সমাজকে শোষণ করতে চায় না, তেমনি বাঙালী জাতি শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হবে, তাও সহ্য করবে না৷ শোষক ও শোষিতের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে না, তাই একথা অনস্বীকার্য যে শোষণ তা যে কোনও রকমই হোক না কেন, তার জাতীয় সংহতির তথা বিশ্বভ্রাতৃত্বের পথে কণ্টকস্বরূপ৷ ‘আমরা বাঙালী’ বাঙালী জাতির প্রতি তথা বাঙলার প্রতি যত প্রকার শোষণ ও বঞ্চনা চলছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে প্রকৃতপক্ষে জাতীয় সংহতি ও তথা বিশ্ব মানব ঐক্যের ভিতকেই সুদৃঢ় করছে৷

‘বাঙালীস্তান’ শব্দটিতেও আপত্তি থাকার কোনও মাত্র সঙ্গত কারণ থাকতে পারে না৷ মিজোদের অঞ্চলকে বলা হয় মিজোরাম (রাম মানে এখানে স্থান), তামিলদের দেশকে বলা হচ্ছে তামিলনাড়ু (নাড়ু মানেও স্থান), এই সব নামে যদি আপত্তি না থাকে ও এসব নাম যদি সংবিধানসম্মত হয়, তাহলে বাঙালীদের স্থান অর্থাৎ নিজস্ব বাসভূমি---এই অর্থে ‘বাঙালীস্তান’ শব্দটিও কোনও যুক্তিতে দোষাবহ হতে পারে না৷

লক্ষ্যণীয়, বাঙালী জাতি আজ নানান দিক থেকে শোষিত ও বঞ্চিত৷ বাংলা ভাষা বিশ্বের সবচেয়ে মধুর ভাষা রূপে রাষ্ট্রসংঘে স্বীকৃত৷ বাঙলার সাহিত্য অত্যন্ত উন্নত৷ রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করে বাঙলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসনে বসিয়েছেন৷ তবুও এই পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী অফিসে বাংলা ভাষা ব্রাত্য হয়ে রয়েছে৷ পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডে ৬৫ শতাংশ বাঙালী, কিন্তু সেখানে স্কুল-কলেজে বাংলা শিক্ষার কোনও সুযোগ নেই৷ সরকারী ও বেসরকারী অফিসেও বাংলা ভাষার মর্যাদা নেই৷ একই অবস্থা অসম, বিহার, ওড়িষ্যার বাঙালীদের৷ ত্রিপুরা মূলতঃ বাংলা ভাষী রাজ্য৷ কিন্তু সেখানেও বাংলা ভাষা তার মর্যাদা পায় না৷ সম্প্রতি সেখানে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে বাংলাকে ঐচ্ছিক ভাষাতে পরিণত করা হয়েছে৷ অর্থনৈতিক দিক থেকে বাঙালীরা সর্বত্র কোনঠাসা৷ শোষণে শোষণে জর্জরিত৷ পশ্চিমবাঙলার অর্থনৈতিক ক্ষমতাও অবাঙালীদের কুক্ষিগত৷

এ অবস্থায় কি অর্থনীতি, কি ভাষা, কি সংসৃকতি---সর্বক্ষেত্রেই বাঙালীরা চরম বঞ্চনা ও শোষণের শিকার৷ এখনও যদি বাঙালী জাতি তার ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার জন্যে সংগ্রাম না করে তাহলে বাঙালী জাতি নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাবে৷ বাঙলার ঐতিহ্য, গৌরব---সব কিছু আজ ভূলুণ্ঠিত৷

এই বাঙলা চৈতন্যদেবের বাঙলা, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের বাঙলা৷ ঋষি অরবিন্দ, শহীদ ক্ষুদিরাম, প্রফুল্লচাকী, বাঘাযতীন, মাষ্টারদা সূর্য সেনের বাঙলা৷ অজস্র দধীচি ঋষিতুল্য আত্মত্যাগীর বাঙলা, নেতাজী সুভাষচন্দ্রের বাঙলা৷ এ বাঙলা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বাঙলা৷ কিন্তু আজকের বাঙালীরা বাঙলার এই গৌরবময় ঐতিহ্য ভুলে পরানুকরণের নেশায় উন্মত্ত৷ বাঙলার ঐতিহ্য-বিরোধী পুঁজিবাদ ও মার্কসবাদের তাঁবেদার হয়ে আজ বাঙালীরা নিজেদের মধ্যে খুনোখুনিতে ব্যস্ত৷ বাঙালী ঐক্য, বাঙলার সুউচ্চ সংসৃকতি আজ বিধবস্ত৷

কিন্তু মহান ধর্মগুরু তথা যুগান্তকারী প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন, ‘‘বাঙলার সভ্যতা খুবই শক্তিশালী সভ্যতা---বৌদ্ধিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যা খুবই প্রাগ্রসর৷ মরণের ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলার মত প্রাণশক্তি তার যথেষ্ট আছে৷’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘বাঙালী নামধেয় জনগোষ্ঠী অতীতে জীবিত ছিল, আজও জীবিত আছে, আর আমি আশা করব, ভবিষ্যতে আরও দুর্দান্তভাবে জীবিত থাকবে৷’’

আমরা চাই প্রাউট প্রবক্তার মহান আদর্শ ও বজ্রদীপ্ত বাণীতে উজ্জীবিত হয়ে সমস্ত বাঙালীরা আজ নিজেদের মধ্যে ভেদ-বিভেদ ভুলে তাদের হৃত-গৌরব পুনরুদ্ধার করতে এগিয়ে আসুক৷ বাঙলার নবজাগরণের মাধ্যমে আবার সোনার বাঙলা গড়ার এই মহান কর্মযজ্ঞে আমরা সবাইকেই সাদর আমন্ত্রণ জানাই৷