অনেক হয়েছে  আর নয়

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

শেষের পরেও শুরু আছে৷ আজকের সূর্যাস্তের ও কালপ্রাতের সূর্যদয়ের মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই৷ প্রকৃতির  নিয়মের কোন হেরফের নেই৷ আর পাঁচটা দিনের মতই সূর্যটা অস্ত যায়, নববর্ষের প্রথম সূর্র্যেদয় ঠিক আগের দিনের মতই হবে৷ এইভাবেই ৩৬৫ দিন পার করে আর একটা নববর্ষের নবপ্রভাতের অরুণ আলো দুয়ারে এসে পড়বে৷ প্রকৃতির এই নিত্যদিনের আসা-যাওয়ায় কালের মানসিক পরিমানে শুধু সংখ্যার হেরফের হয়৷

কালের মানসিক পরিমানের সঙ্গে আমাদের জীবনের সম্পর্ক গভীর৷ মানুষ পৃথিবীতে আসে অতি অল্প সময়ের জন্যে৷ সময়ের স্রোতে গা-ভাসিয়ে সুখ-দুঃখের তরী বেয়ে উত্তরসূরী রেখে চলে যায়৷ এই আসা-যাওয়া পশুর জীবনেও ঘটে৷ কিন্তু মানুষতো পশু নয়৷ পশুর থেকে অতিরিক্ত কিছু আছে৷ মানুষ-পশুতে পার্থক্য শুধু দৈহিক গঠনে নয়, মানুষের বুদ্ধি বিবেক যা তার মধ্যে উচিত-অনুচিত বোধ জাগায়, সমাজে তার কি করনীয়, কি করনীয় নয় তা বুঝিয়ে দেয়৷ মানব জীবনে সময়ের মূল্য এখানেই৷ স্বল্প সময়ের বাসভূমি এই পৃথিবীতে মানুষ যতটা বেশী সময়ের সদ্ব্যবহার করে নিতে পারে সৎ কাজে, কল্যাণের কাজে তবেই তার কাছে সময়ের গুরুত্ব৷

মানুষের বুদ্ধির বিকাশই সমাজ সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়, জাগতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার করায় সার্বিক কল্যাণের জন্যে৷ কিন্তু জগতে এমন কিছু স্বার্থপর লোক আছে, যারা সমাজের কল্যাণ চায় না, বুদ্ধির বিকাশ চায় না, সমগ্র মানব সমগ্র জীব জগতের সার্বিক কল্যাণে মানুষের বুদ্ধির ব্যবহার হোক৷ এই ধরণের মানুষরাই সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে ব্যষ্টি স্বার্থ চরিতার্থ করতে৷ চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে মানুষকে ভাবজড়তায় আচ্ছন্ন করে জাতিগত, গোষ্ঠীগত, সম্প্রদায় গত সংঘাত সৃষ্টি করে সমাজে ফাটল ধরিয়ে, বিভেদ সৃষ্টি করে মুনাফা লোটে৷

৭৭ বছর আগে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল ব্রিটিশ শাসিত ভারতে অবিভক্ত বাঙলায়৷ একই ভাষা কৃষ্টি সাহিত্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অভিন্ন একই জনগোষ্ঠী মুনাফাখোর ধন কুবের ও ধুরন্ধর রাজনৈতিক নেতাদের চতুর চালে সম্প্রদায়গত ভাবজড়তায় আচ্ছন্ন হয়ে নিজেদের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে ভৌগোলিক সীমানা ভাগ করে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে যায়৷ আজ আবার সেই ধর্মান্ধ আসুরিক শক্তি সক্রীয় হয়ে উঠেছে ওপারে৷ খুন, সন্ত্রাস, ছিনতাই---আতঙ্কিত নাগরিক জীবন দিন রাতের পার্থক্য ভুলে গেছে৷ সুর্যদয়ের  সকালগুলোও অমানিশার অন্ধকারের চেয়েও কালো মনে হয়৷ ভাষা,কৃষ্টি,সংস্কৃতিগত অভিন্নতার তরঙ্গ বেয়ে এপারেও ধেয়ে আসছে, ওপারের বিষাক্ত হাওয়া, এপারেও সক্রীয় হচ্ছে ভাবজড়তায় আচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক সাপদকুল৷ ৭৭ বছর ধরে বয়ে বেড়ানো সাম্প্রদায়ীকতার ক্ষত আবার নতুন করে খুঁচিয়ে তুলতে চাইছে৷

তুলতে চাইছে, তুলতে পারছে কারণ এই ভাবজড়তায় আচ্ছন্ন মানুষগুলো থেকে শুধু মৌখিক প্রতিবাদে সময় নষ্ট করে গেছি৷ জীবনের মূল্যবান সময়গুলো কেটে গেছে বাজে কাজে, বাজে কথায়৷ কিন্তু  আর নয়, অনেক হয়েছে৷ সাম্প্রদায়িকতার শাণিত কৃপানে আর নয় রক্তপাত, আর নয় বিভেদ বৈষম্য, আর নয় ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত৷ বর্ষশেষের শেষ দিনে সব মানসিক দুর্বলতা, বিভেদকামী চিন্তাকে বিসর্জন দিয়ে সমাজ থেকে সবরকমের ভাবজড়তাকে দূর করতে, আসুরিক শক্তির বিনাশ করতে নীরবচ্ছিন্নভাবে আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিতে হবে, শুধু শপথই নয় সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে৷ তার জন্যে চাই মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনা৷ মানুষ জন্মালেই মানুষ হয় না৷ দুঃসাধ্য সাধনায় মানুষকে মানুষ হতে হয়, মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়৷

২০২৫ নববর্ষের প্রথম প্রভাতেই শুরু হোক সর্বপ্রকার গ্লাণিমুক্ত কলুষমুক্ত নির্মল পৃথিবী, ঐক্যবদ্ধ আদর্শ সমাজ ঘটনের সংগ্রাম, মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনা৷