আনন্দনগর অস্থি পাহাড়ে ‘‘আল্ট্রাডেন্স ফরেষ্ট প্রকল্পের রূপায়ণ নিয়ে কিছু কথা

লেখক
আচার্য নারায়ণানন্দ অবধূত

ঘন বনসৃজনের প্রয়োজনীয়তার কারণ ঃ পশ্চিম রাঢ়ে বৃষ্টিপাত খুবই কম কারণ গাছ-পালা খুব কম৷ বিস্তর সরকারী ফরেষ্ট জমি, পাহাড় ও সাধারণ ভূমি বৃক্ষহীন৷ সাধারণ মানুষের  মধ্যে বৃক্ষ লাগানোর চেতনা ও মানসিকতা খুবই নগণ্য৷ নেই বললেই চলে৷ গাছ-পালা লাগালে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাবে৷

ঘন বনসৃজনের জন্যে স্থান নির্বাচন ঃ আনন্দনগরে গুরুদেব শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী অনেক প্রকারের সেঞ্চুরি, পরিবেশ সংবর্ধন কানন (পসকা) ও ফল-ফুলের বাগান ও কানন দিয়েছেন৷ অস্থিপাহাড়েও দিয়েছেন৷ আমাদের পুরনো  মার্গী ও গৃহী আচার্য কিসেন সিংসুদ দাদাজী আনন্দনগরে ঘনবনসৃজনের জন্যে আমার কাছে প্রস্তাব রাখেন ও জমি চিহ্ণিত করে দিতে বলেন৷ তিনি গাছ লাগাবেন৷ আমি শুনে উৎফুল্ল হয়ে উঠি৷ আমি আনন্দনগরে অনেকগুলো জায়গার মধ্যে প্রথম তালিকায় অস্থিপাহাড়ের নাম রেখেছি৷ কারণ এর ভবিষ্যৎ উজ্বল, সম্ভাবনা ও সুযোগ-সুবিধাও বেশি৷

অস্থিপাহাড়ের  নামকরণ ঃ অভেদানন্দ ডিহির মধ্যে  অস্থিপাহাড়৷ শুধু পাহাড়টির নাম অস্থিপাহাড়৷ ২৭শে ডিসেম্বর ১৯৮০ ৰাৰা অভেদানন্দ ডিহি যান, ওখানে ডায়নোসরের ফসিল আবিষ্কার করেন৷ ডায়নোসরের ফসিল যে জায়গায় পাওয়া যায় ওই পাহাড়টির নামকরণ করেন ‘‘অস্থিপাহাড়’’৷ ৰাৰা পাহাড়ের উপর গেছিলেন ও পাথরের উপর বসেই ডায়নোসরের ফসিল আবিষ্কার করেন৷

আত্মত্যাগ ঃ আনন্দনগরের বিশেষ মহিমা আছে৷ অনেক সাধকের, অনেক ত্যাগের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে৷ এই অভেদানন্দ ডিহি প্রকল্প গড়ে তুলতেও অশুভ শক্তির আক্রমণ নেবে এসেছে৷ ১৯৯৭ সালের ২৯শে সেপ্ঢেম্বর  রাত এগারোটায় অভেদানন্দ ডিহি আশ্রমে তরুণ ও যুবক সন্ন্যাসী আচার্য অনির্বাণ ব্রহ্মচারীর উপর আক্রমণ নেমে আসে৷ আশ্রমের তথা জনকল্যাণমূলক  কাজকর্মকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে  সিপিএম গুণ্ডারা তাঁকে নির্মমভাবে কুপিয়ে  হত্যা করে৷

ঘন বনসৃজনের জন্যে অস্থিপাহাড়কে কেন প্রথম তালিকায় নেওয়া হয়েছে?

১) এর প্রাকৃতিক অবস্থান  অত্যন্ত  সুন্দর৷ দুই দিকে অর্থাৎ পশ্চিমে ও উত্তরে খিরখিরা পাহাড়, দক্ষিণে সমতল ভূমি৷ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটু দূরে পৃথিবীর প্রাচীনতম ক্ষয়িষ্ণুপর্বত বেলামু পাহাড়৷

২) পশ্চিম প্রত্যন্ত আনন্দনগরের সীমান্তের শেষ প্রান্তে আমাদের অভেদানন্দ ডিহি৷ এখানে আমাদের জাগৃতি, স্কুল ও একজন দাদা পোষ্টিং আছেন৷

৩) অস্থিপাহাড় ঘেঁষে রয়েছে বিরাট জলাশয়৷

৪) অস্থিপাহাড়ে কিছু গুল্মজাতীয় গাছ ছাড়া অন্য কোনো  গাছপালা নেই৷

৫) কোন গাছ না থাকায় উন্মুক্ত পাহাড় রোদে-বর্ষায়, ঝড়-ঝঞ্চায় দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছিল৷

৬) গাছ থাকলে পরিবেশ স্নিগ্দ থাকবে৷ পাহাড়ের ক্ষয়রোধ হবে৷

৭) এখানকার তন্ত্রপীঠে সাধনা করতে সুবিধা হবে৷

৮) সাধক, দর্শনার্থীদের ও ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণীয়  করে তুলবে৷

ঘনজঙ্গল করার প্রস্তুতি ও বৃক্ষরোপণ ঃ

পাহাড়টি ১৫ একরের৷ প্রথমেই সরকারী ল্যাবরটারি থেকে মাটি পরীক্ষা করে নেওয়া হয়েছে৷ বর্ষার চার মাস আগেই জেসিবি দিয়ে স্থানটি খোঁড়া হয়েছিল৷ কারণ মাটি আলগা না হলে জমিতে জল ধরে রাখার ক্ষমতা তৈরী হবে না৷ জমি খোঁড়ার পর যথেষ্ট পরিমাণে খড়, গাছের  পাতা ও গোবর সার দিয়ে জমির উর্বরতা ও উৎকর্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়েছে৷

চারাগাছের জন্যে সরকারী ও বেসরকারী বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল৷ কিন্তু প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত সরকারী বিভাগ দিতে অস্বীকার করে৷ আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে মেদিনীপুরের বেসরকারী নার্শারী থেকে স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিশরকম প্রজাতির কুড়ি হাজার চারাগাছ ক্রয় করা হয়েছে৷ নার্শারীর মালিক আমাদের গাছ লাগানোর উৎসাহ, ব্যবস্থাপনা, প্রস্তুতি ও মহৎ উদ্দেশ্য দেখে বিনামূল্যে ৩-৬ ফুট উচ্চতার তিনহাজার চারাগাছ দান করেন৷

এক স্কোয়ার মিটার দূরত্ব রেখে সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ মিশ্র ভাবে রোপণ করা হয়েছে৷ পঞ্চবটির গাছ যেমন বেল, আমলকি, নিম, শিমুল, বট ও অশ্বথ (যেকোন একটি আর বাকি চারটি নিয়ে পঞ্চবটি) ছাড়াও শাল, মেহগনি, ছাতিম, বকুল, কৃষ্ণচূড়া, আম কাঁটাল, কাজুবাদাম ইত্যাদি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে৷ পরমপুরুষের অসীমকৃপায় চারাগাছ রোপন চলাকালীন রোজ বৃষ্টিপাত হতে থাকে৷

আশ্রমের প্রবেশ পথে সারণী বৃক্ষ হিসেবে বকুল,শিবালি, পারিজাত, আম কাঁটাল, সবেদা ইত্যাদি চারারোপন করা হয়েছে৷

প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম ঃ মেদিনীপুর থেকে দুইটি  মেটাডোর গাড়ি করে চারাগাছ আনা হয়৷ একটি গাড়ি ঠিকভাবে আশ্রমে পৌঁছে যায়৷ অন্যটি আশ্রমের কাছাকাছি এসে গাড়ি ঘুরাতে গিয়ে রাস্তার পাশে মাটিতে চাকা বসে যায়৷ অন্য ট্রাক্টর দিয়ে টেনে তুলে আনতে হয়েছে৷ দ্বিতীয় সমস্যা হয় অস্থিপাহাড়ে যাওয়ার রাস্তা খারাপ ও পিচ্ছিল৷ অন্যস্থানে (বাঁশগড়ে আমাদের আশ্রমে) চারাগাছ নামাতে হয়৷ সেখান থেকে ট্রাক্টর করে অস্থি পাহাড়ে নিয়ে যেতে হয়৷ বার বার উঠানো নামানো করাতে কিছু চারাগাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷

রক্ষনাবেক্ষন ঃ

১) ছাগল-ভেড়া, গরু-মোষ গবাদিপশুর থেকে রক্ষার জন্য বেড়া তৈরী করা হচ্ছে৷

২) আশ্রমের দুটি কঁুয়ো, জলাশয় থেকে প্রয়োজনে জলসেচের ব্যবস্থা করা হবে৷

৩) জল সেচের জন্যে পাম্প ও পাইপ, বৈদ্যুতিক তারের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷

৪) আশ্রমে ফার্ম ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক আয়োজিত  দিবা-রাত্রি দুজন প্রহরীর ব্যবস্থা রয়েছে৷ তাছাড়া আচার্য শুভময় ব্রহ্মচারী দাদা আশ্রমের দায়িত্বে রয়েছেন ও গাছের  প্রয়োজনীয় যত্ন নিচ্ছেন৷

৫) আচার্য দেবপ্রেমানন্দ অবধূত দাদা ‘‘ডি’’ ডিট সেক্রেটারি যিনি নিষ্ঠার সঙ্গে চারাগাছ রোপণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন৷ তাঁর তদারকিতেই এই ঘনবনসৃজনের প্রকল্পের  বাস্তবায়ন হতে চলেছে৷

বনসৃজনের দ্বিতীয় প্রকল্প ঃ

ৰাৰা মেমোরিয়ালের দক্ষিণে দক্ষিণ আনন্দনগর৷ এখানে প্রায় পাঁচ একর জমিতে আচার্য কল্যাণেশ্বরানন্দ অবধূত দাদার দীর্ঘ অক্লান্ত প্রয়াসে বনসৃজন হয়েছে৷ এবার আরও তিনএকর জমিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাজুবাদামের এক হাজার চারাগাছ রোপণ করা হয়েছে৷ রক্ষণাবেক্ষণের  সম্পূর্ণ ব্যবস্থা দাদা নিজেই দেখাশুণা করছেন৷

বনসৃজনের তৃতীয় প্রকল্প ঃ গুড়িডি মৌজায় ‘‘রামবুটান কম্পাউণ্ড’’৷ প্রায় আড়াই হাজার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও পাঁচশত কাজুবাদাম চারাগাছ রোপণ করা হয়েছে৷ আচার্য দেবপ্রেমানন্দ অবধূত দাদা নিয়মিত তদারকি করছেন৷ এখানে প্রায় দশ একর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের জঙ্গল রয়েছে৷

কৃতজ্ঞতা স্বীকার ঃ আমাদের মিশনের দীর্ঘদিনের পুরোনো মার্গী ও গৃহীআচার্য কিসেন সিংসুদ দাদার আর্থিক  সহায়তা ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই নতুন প্রকল্প ‘‘আল্ট্রা ডেন্স ফরেষ্ট প্রোজেক্ট’’ ২০২১ সালের জুলাই মাসে শুভারম্ভ হয়েছে৷ আমি আনন্দনগর  বাসির পক্ষ থেকে তাকে অভিনন্দন, শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানাই৷ আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে তাঁর দ্বারা আনন্দনগরের আরও প্রগতি হোক৷