অপরাধ প্রবণতা---চরমদণ্ড সমাধান নয়

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

শুধু আর.জি.কর নয়, সারা দেশেই নারী নির্যাতন ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে চলেছে৷ আর.জি.কর নিয়ে লাগাতার আন্দোলন চলছে, এই আন্দোলন যে অপরাধীর মনে কোন রেখাপাত করেনি, বা তাকে সৎপথে ফিরে আসার কোন কোন প্রেরণা দেয়নি তার প্রমাণ সারা দেশে আর.জি.কর নিয়ে আন্দোলন চলাকালীন পাল্লা দিয়ে ধর্ষন নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ আর.জি.কর আন্দোলন যারা করছে তাদের অনেকেরই তিলত্তমাকে নিয়ে তিলমাত্র ভাবনা চিন্তা নেই৷ তারা অনেকে অনেক জ্বালা বুকে নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে ধর্ষনজনিত অপরাধ থেকে সমাজকে মুক্তি দিতে নয়, তাদের লক্ষ্য রাজ্য শাসক দলের বিনাশ, তাতে যদি আর.জি.করের মত ঘটনা আরও দু-চারটে ঘটে ঘটুক৷ তাতে শূন্যের জ্বালা কিছুটা প্রশমিত হবে৷ ব্যর্থতার হতাশায় আশার সঞ্চার করবে৷

ব্যাপারটা এমন নয় যে আর.জি করের মত বর্বরোচিত ঘটনা এই রাজ্যে আগে ঘটেনি, বাম আমলে বানতলা, বিজনসেতু, সহ এই ধরণের পাশবিক ঘটনার বহু নজির আছে৷ তখন সোস্যাল মিডিয়ার এত দৌরাত্ম্য ছিল না, তাছাড়া সিপিএমের সন্ত্রাসে মানুষ মুখ খুলতে ভয় পেত৷ আজ সেই পরিবেশ বাঙলার নেই৷

তবু অতীতের নজির তুলে আর.জি.করের ঘটনাকে লঘু করার চেষ্টাও পাপকে প্রশ্রয় দেয়৷ যদিও আন্দোলনে যারা নেমেছে তাদের অনেকেরই সম্পর্কে ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ প্রবাদটি প্রযোজ্য৷

আর.জি.করের ঘটনা তাদের সাধু সাজার একটা সুযোগ করে দিয়েছে৷ শাসক বিরোধী সব পক্ষই এখন ধর্ষনজনিত অপরাধের চরমদণ্ড ফাঁসী চাইছে৷ শাসক বিরোধী সব পক্ষের সমর্থন নিয়ে রাজ্য বিধান সভায় একটি বিলও পাশ হয়েছে অপরাধীর ফাঁসী চেয়ে৷ তবু প্রশ্ণ থেকেই যায় অপরাধীর ফাঁসীতে কি সমাজ পাপমুক্ত হবে৷ এই রাজ্যে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় নামে এক ব্যষ্টির ফাঁসি হয়েছিল বাম আমলে ধর্ষনজনিত অপরাধের জন্যে৷ তাতেও তো সমাজ পাপমুক্ত হয়নি৷ যদিও ধনঞ্জয়ের অপরাধ নিয়ে বিতর্ক আছে৷ রাষ্ট্রে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশ প্রশাসন আইন আদালতও থাকবে, অপরাধীর বিচার হবে, সাজাও হবে৷ কিন্তু সমাজকে এই ধরণের জঘন্য অপরাধ থেকে মুক্তির পথ কি?

একটা কথা স্পষ্ট---অপরাধীর কঠোর সাজা হলেও সমাজ অপরাধ প্রবণতা থেকে মুক্ত হয় না৷ মানুষের মানসিক ক্ষুধা বা আভোগ একটা স্বাভাবিক ব্যাপার৷ মানসিক ক্ষুধার পরিতৃপ্তি না হলে সে নানা হীন কাজের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে৷ নর দানবদের শোষনের কবলে পড়ে আজকের সমাজে এই ধরণের মানুষই বেশী৷ তাছাড়া পথভ্রষ্ট রাজনৈতিক নেতারাও নানা কু-কর্মে জড়িয়ে পড়ে৷ মানুষের এই মানসিক এষণা বা আভোগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সমাজ থেকে পাপ নির্মুল করা সহজ হবে না৷ তাছাড়া মানুষের নানা কু বৃত্তিকে অনুপ্রাণিত করছে অশ্লীল শিল্প সাহিত্য, চলচ্চিত্র সঙ্গীত৷ তাই সমাজে এই ধরণের জঘন্য অপরাধের জন্যে সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ও দায়ী৷ আর সে দায় এড়াতে পারে না সাংস্কৃতিক জগতের সুশীল সমাজ৷ তাছাড়া মানুষের চিন্তার রাজ্যে ও আর্থিক ক্ষেত্রেও চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে৷ যা মানুষকে অপরাধ প্রবণতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ এর থেকে বাঁচতে হলে মানুষকে সাহিত্য,শিল্প-কলা, সঙ্গীত, বাদ্য ও আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে৷ তবেই সমাজ অপরাধ প্রবণতা মুক্ত হবে৷

ধর্ষনের মত সামাজিক অপরাধের ক্ষেত্রে আর্থিক দিকটাও অবহেলা করলে চলবে না৷ বিশেষ করে পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র কাঠামোয় এই অপরাধ প্রবণতা শোষণের সহায়ক৷ দুর্নীতি, নৈতিক অধঃপতন রোধ করে সমাজের সুচিতা ফিরিয়ে আনতে হলে নন্দন বিজ্ঞানের চর্চা, আধ্যাত্মিক অনুশীলনের পাশাপাশি আর্থিক বুনিয়াদকেও নূতন করে গড়ে তুলতে হবে৷ পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীত অর্থনৈতিক কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন এনে স্থানীয় মানুষের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা তুলে দিতে হবে৷ প্রতিটি মানুষের জীবন ধারণের নূ্যনতম প্রয়োজন অন্ন,বস্ত্র,বাসস্থান, শিক্ষা চিকিৎসার নিশ্চিততা দিতে হবে৷ প্রতিটি মানুষের হাতে ক্রয় ক্ষমতা দিতে হবে৷ এইভাবে স্বচ্ছল অর্থনীতি-উন্নতচিন্তা ধারা ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন স্বচ্ছ সমাজ গড়ার সহায়ক হবে৷