আফগান চর্চা ঃ ভারতবর্ষের মানুষের ঐতিহাসিক দায় ও দায়িত্ব

লেখক
সুকুমার সরকার

ভারত-ইতিহাসের প্রাণকেন্দ্র যদি হয় মহাভারত, তবে সেই মহাভারতের সুগন্ধি ইতিহাসের এক অন্যতম চরিত্র গান্ধারী৷ যিনি কিনা ছিলেন গান্ধার দেশের রাজকন্যা৷ বর্তমানে যা আফগানিস্তানের একটি প্রদেশ৷ আমরা যদি আরও দূর অতীতের দিকেও তাকাই সেখানেও দেখতে পাবো, ভারতবর্ষের গর্বিত জাতিসত্তার দাবীদার আর্যদের পূর্বপুরুষেরা এই আফগানিস্তানের ভেতর দিয়েই ভারতবর্ষে এসেছিলেন৷ সুতরাং ভারতবর্ষের মানচিত্রের উত্তরাংশে এই আফগান দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের যোগ সুদূর অতীত থেকে ও আত্মিকও বটে৷ শিক্ষা-সংস্কৃতির পাণিনি, যাজ্ঞবল্ক্য, তক্ষশিলাও ভারতবর্ষ আফগানিস্তানের মধ্যে কোথায় যেন আজও একটি যোগসূত্র স্থাপন করে চলেছে৷ আর রবীন্দ্রনাথের গল্পের মধ্যে দিয়ে সেই যোগসূত্র যেন আজও আমাদের হৃদয়ে একটি স্থায়ী আসন করে নিয়ে আছে৷ ফলে কাবুলিওয়ালাদের দেশে কিছু ঘটলে আমাদের দরদী মনের কোণে কিছু একটা দূর্বলতা দেখা দেয়ই৷ যতই তা ভিন্ন ধর্মমতীয় রাজনৈতিক ভাবনায় রক্তাক্ত হোক না কেন! যে  আত্মিক মিলনের সংস্কৃতিতে ভারতবর্ষ আজ পুষ্ট তার প্রবেশদ্বারও যে ওই আফগানিস্তানই৷ আর তাই আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ভারতবর্ষের মানুষের চর্চা অমূলক নয়৷ সেদেশে এদেশের মানুষ মরছে বলে, কিংবা এদেশের  মানুষ সেদেশে বিপদে পড়ে আছে বলে নয় সকল আফগানবাসীর জন্যই ভারতবাসী চিন্তিত৷

তালিবানি উত্থান শুধু আফগানিস্তানের জন্য নয় উপমহাদেশের জন্য চিন্তার কারণ৷ যে মূল ইসলাম ধর্মমতের  মধ্যে থেকে বিকৃত ইসলামী চিন্তার এই তালিবানিদের জন্ম  সেই মূল ইসলামপন্থীরাও তালিবানিদের উত্থানে চিন্তিত৷ কেননা, ধর্মমতীয় ভাবনার উর্ধে চৌদ্দশো বছর আগের যে শরিয়াতি আইনের দোহাই দিয়ে তালিবানিরা আস্তিন পরে বন্দুক হাতে নিয়েছেন,সেই আস্তিনের আড়ালে আসলে লুকিয়ে আছে একটি হিংস্র দানব৷ তাঁরা সেখানে নিজেরাই শরিয়তি আইনের বাইরে হিংসা, মাদক পাচার, নারী ধর্ষণ সহ নানান অমানবিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত৷

এটাকে কোনো মতেই বিশুদ্ধ ইসলামী শরিয়তি চিন্তার প্রতিফলন বলা যায় না৷ তাই যাঁরা ধর্মমতীয় ভাবনায় তালিবানদের সমর্থন করছেন, তাঁরা বিকৃত ইসলামপন্থীকেই সমর্থন করছেন৷ আর যাঁরা তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে বেঁচে এসেও তালিবানিদের গুণকীর্ত্তন করছেন, তাঁদের প্রেক্ষাপটটি কিন্তু ভিন্ন৷ অধ্যাপক তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের তালিবানি গুণকীর্ত্তন করা দেখেই বোঝা যায় সেদেশে তালিবান কী ভয়ঙ্কর! এদেশের যাঁরা তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথার বিরূপ সমালোচনা করেছেন, তাঁরা বোঝারই চেষ্টা করছেন না যে, জীবিকা করার জন্য তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে আফগানিস্তানে যেতে হলে এটাই তাঁকে বলতে হবে৷ নইলে আফগানিস্তানে জীবিকা করতে তালিবানিরা বন্দুকের গুলিতে তাঁর বুক ঝাঁঝরা করে দেবে৷ যেমন করেছিল ‘‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’’ এর লেখিকা সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের৷ এটা অধ্যাপক তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় খুব ভালো করেই জানেন৷ আর তাই তাঁর বক্তব্য সুকৌশল৷ এটা বুঝতে ভুল করলে অধ্যাপক তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি যেমন অন্যায় করা হবে, তেমনি তালিবান সম্পর্কে ধারণা সঠিক হবে না৷

জীবিকার জন্য তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই আফগানিস্তানে পাড়ি জমান৷ আফগানিস্তান থেকেও বহু মানুষ এদেশে জীবিকার জন্য আসেন৷ এটা ভারত- আফগানিস্তানের দীর্ঘ হাজার বছরের ঐতিহ্য৷ যেটা প্রথমেই বলেছি৷ কিন্তু যেটা আমাদের বুঝতে হবে, যেখানে আফগানিস্তানীরা  এদেশে জীবিকা করতে এলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো দরদী লেখকের সহানুভূতি পেয়ে যান, সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মেয়েদের ভালবাসা পেয়ে যান, সেখানে ভারতীয়রা আফগানিস্তানে জীবিকা করতে গেলে বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা হতে হয় কেন? আফগানরা কি আদতেই শকুনি মামার উত্তরসূরি? নাকি বিকৃত ইসলাম ভাবনা তাঁদের এমনটি করেছে? বৌদ্ধযুগে বোধ করি আফগানিস্তান শান্তিপ্রিয়ই ছিল৷ নইলে পাণিনি জন্মালেন কী করে? বহেমিয়ার পাহাড়ে এত সুন্দর সুন্দর বৌদ্ধমূর্তি তৈরি হয়েছিল কী করে? মাটি কখনো মানুষকে হিংস্র করে না৷  মানুষকে হিংস্র করে তুলে ভুল দর্শন৷ ভুল চিন্তা৷ বিশ্বের যেখানে যত সন্ত্রাসী দল বা সংঘটন আছে সবগুলিই এই ভুলের থেকে সৃষ্টি৷ তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ নীতি৷ সেই নীতিতে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি লাভের অঙ্কে জঙ্গিদের সমর্থন করে থাকে৷ সেই লাভ বাণিজ্যিক সম্প্রসারণই হোক অথবা আধিপত্য বিস্তারের সম্প্রসারণই হোক৷ কিন্তু ভারতবর্ষের চিন্তা এসবের উর্ধে৷ ভারত- আফগানিস্তানের  সম্পর্ক ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক৷ আর তাই ভারতবর্ষ এত চিন্তিত৷ আর তাই ভারতবর্ষের সংবাদ মাধ্যমও ভারত-আফগান সম্পর্ক নিয়ে এত চর্চা করে চলেছে৷ এ আমাদের ঐতিহাসিক দায় ও দায়িত্ব৷