আর.জি.কর-----কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বা একমাত্র ঘটনা নয়৷ সারা দেশজুড়ে বছরে ২৫ থেকে ৩৫ হাজার বিভিন্নভাবে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ এই ধরণের ঘটনায় দেশের অনেক প্রদেশের থেকে পশ্চিমবঙ্গ অনেক পিছনের সারিতে আছে৷ তবু আর.জি.কর নিয়ে এতো সরগোলের কারণ বাঙালীর সামাজিক সাংস্কৃতিক চেতনা৷ আর.জি.করের ঘটনা বাঙালী চেতনায় আঘাত দিয়েছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ অপরাধীর কঠোর সাজার দাবী তুলেছে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ৷ এই ধরণের ঘটনার পর এই দাবী শুণতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে৷ রাজপথে মোমবাতি জ্বলবে, রাজনৈতিক দলের ক্যাডার কর্মীরা ঝাণ্ডা নিয়ে পথে নামবে এও স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে, দূরদর্শনের পর্দায় সান্ধ্য বাসরে আসর জমবে রগচটা আলোচনায়৷ এসব কোন কিছুতেই জনমানসে কোন প্রভাব পড়ে না৷ শুধু সেই হতভাগ্য মেয়েটি এক বা একাধিক দ্বিপদ জানোয়ারের লালসার শিকার হয়ে আজ পার্থিব জগতের সবকিছুর ঊধের্ব৷ তাঁর একান্ত প্রিয়জনেরা শূন্যতার হাহাকার আর একরাশ হতাশা বুকে নিয়ে ঘরের কোনে বসে প্রতিবাদের তামাসা দেখছে৷

অপরাধীর শাস্তি হয় তো হবে কিন্তু সমাজ কি এই অপরাধ থেকে মুক্ত হবে৷ এই অপরাধ প্রবণতা দমনের পথ কি? প্রতিবাদীদের কন্ঠে, দুরদর্শনের পর্দায় সান্ধ্য বাসরের কলহে ---কেউই এ পথের সন্ধান দিতে পারেনি, হয়তো জানলেও দেয় না স্বার্থে আঘাত লাগার ভয়ে৷ অল্প কিছু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ ভাবনা-চিন্তা করে৷ তবু এই সামাজিক ব্যধি নিরাময়ের একটা চেষ্টা তো কাউকে না কাউকে করতেই হবে৷

প্রাউট প্রবক্তা এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু পথ নির্দেশনা দিয়েছেন৷ অর্থনৈতিক কারণ একটা আছেই! অর্থের অভাব প্রাচুর্য দুইই মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়৷ তাছাড়া পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে শোষণের পথ সুগম রাখতে অশ্লীল হীন রুচির চলচিত্র, সঙ্গীত, সাহিত্যের মাধ্যমেও ছাত্রযুব সমাজকে অপরাধ জগতে ঠেলে দেয়৷ অপরাধীর শাস্তির পাশাপাশি অপরাধের কারণগুলো বন্ধ করতে হবে৷

এক ধরণের অপরাধ রয়েছে যা বেশি দেখা যায় অভাবী মানুষের মধ্যে৷ সেক্ষেত্রে অভাবটাই মূল কারণ৷ এখানে অভাব বলতে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা প্রভৃতি মানুষের নূ্যনতম যেগুলো চাহিদা তার কথা বোঝানো হচ্ছে৷ মানুষ যদি সৎভাবে থেকে তার নূ্যনতম চাহিদা পূরণ করবার সুযোগ না পায়---তখন সে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে জীবনের চাহিদা গুলি পূরণের জন্যে৷ পরবর্তী কালে তাদের এই অভাব জনিত অপরাধ প্রবণতা---স্বভাবে পরিণত হয়ে উঠে৷

এ একটা দিক৷ কেবল যে অন্ন---বস্ত্রাদি ভৌতিক (ফিজিক্যাল) বস্তুর অভাবই মানুষকে অপরাধ জগতের দিকে ঠেলে দেয়, তা নয়, ‘মানসিক সম্পদে’র অভাব একই ভাবে মানুষকে অমানুষ করে তোলে৷ ‘মানসিক সম্পদ’ বলতে এখানে বোঝাচ্ছি নীতিবোধ, সমাজ---চেতনা প্রভৃতি সদগুণ৷ এই সম্পদ যোগানের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত৷ অনেক সময় পিতা---মাতা নানান কারণে তাদের সন্তানদের মধ্যে সদগুণের বিকাশ করতে পারেন না৷ সেই অভাব পূর্ণ করার জন্যেই তো বিদ্যায়তনগুলো! কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষের মধ্যে এই নীতিশিক্ষার ওপর যথেষ্ট গুরুত্বই দেওয়া হয় না৷ কেবল ছাত্র---ছাত্রারা যাতে পড়া মুখস্ত করে---বেশি নম্বর পেয়ে ভাল রেজাল্ট করতে পারে---সেদিকেই শিক্ষক শিক্ষিকাদের লক্ষ্য থাকে৷

তাছাড়া, শিক্ষার একটা বড় মাধ্যম হ’ল শিল্প, সাহিত্য, চলচিত্র প্রভৃতি৷ আজকাল ছাত্র যুব সমাজকে অপরাধ প্রবণতার দিকে ঠেলে দিতে সব থেকে বড় মাধ্যম এই অশ্লীল সাহিত্য চলচিত্র প্রভৃতি৷ দূরদর্শনের প্রদর্শিত নাটক---সিরিয়্যাল আজকের যুবক---যুবতীদের সৎশিক্ষা দানের পরিবর্তে তাদের অন্ধকারের জগতের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে বেশি করে৷ আজকের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের লেখা গল্প---উপন্যাস প্রভৃতি যা শিক্ষার একটা বড় মাধ্যম এগুলিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যুবক---যুবতীদের আলোর দিকে নয়---অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ তাই আজকে সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়ার একটা খুব বড় ভূমিকা রয়েছে বর্তমান বুদ্ধিজীবী সমাজের একটা বিরাট অংশের৷ কিছু কিছু বুদ্ধিজীবি, জ্ঞানী---গুণী মানুষ আছেন যাঁরা সমাজকে ভাল পথে নিয়ে যেতে চান---কিন্তু তাঁরা সংখ্যায় কম৷ আর অর্থলোভী পুঁজিপতিদের বরদহস্ত তাঁদের ওপর না থাকায়, তাঁরা তাদের সুশিক্ষা সমাজে খুব একটা ছড়িয়ে দিতে পারেন না৷

অতিসঞ্চিত অর্থ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনর্থের সূত্রপাত ঘটায়৷ ধনকুবেররা তাদের সঞ্চিত ধনকে নানানবৈধ কাজে লাগায়৷ ওই ধন কালো টাকারূপে অন্ধকার জগতের নিয়মক হয়ে দাঁড়ায়৷ আর, একটা কথা, মানুষের জীবনের একটা লক্ষ্য আছে৷ জীবনের সেই পরিপূর্ণতার পথেই মানুষকে এগিয়ে চলতে হবে৷ শুভ পথ ধরে মানুষকে জীবনের পথে অগ্রসর হতে হবে৷ মানুষকে এপথে চলার প্রেরণা দেবার দায়িত্ব শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের মানুষকেই নিতে হবে৷

যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্যে দু’ধরণের পরিকল্পনা নেওয়া উচিত৷ এক স্বল্পমেয়াদী ও দুই---দীর্ঘমেয়াদী৷ স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থার মধ্যে, এক্ষেত্রে চাই কড়া প্রশাসন৷ দুর্বল প্রশাসন, দুর্বল আইন অপরাধ বা দুর্নীতি দমনে কার‌্যকরী হয় না৷ আমাদের দেশের আইন ও প্রশাসন এক্ষেত্রে যে খুবই দুর্বল---তা বলাই বাহুল্য৷ আর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হ’ল সমাজের দুর্নীতি ও অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির যে সমস্ত কারণের কথা বলা হ’ল, সেটা বুঝে সমস্যা সমাধানের সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার রূপায়ণ৷ এককথায় প্রাউট---দর্শনে এটাকে বলা হয় বাহ্যিক চাপ সৃষ্টি ও অভ্যন্তরীণ সদ্ভাবনার (এক্সটার্নাল প্রেসার এণ্ড ইন্টারন্যাল আর্জ) জাগরণ৷ এই জাগরণ আনতে বড় ভূমিকা নিতে হবে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতের মানুষকে৷ এমন এক সাংস্কৃতিক আলোড়ণ তুলতে হবে যা মানুষকে তার পরম লক্ষ্যের পানে এগিয়ে চলতে হবে প্রেরণা দেবে৷ তখনই সমাজ থেকে অপরাধ প্রবণতা প্রতিহত করা সম্ভব হবে৷