অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শোষণ মুক্তির আন্দোলন জরুরী

লেখক
প্রবীর সরকার

ভারত একটি দেশ নয়–ভারত যুক্তরাষ্ট্র৷ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রে ও রাজ্যে পৃথক রাজনৈতিক দল শাসন ক্ষমতায় থাকতে পারে৷ তাই যুক্ত রাস্ট্রীয় কাঠামোতে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে অবশ্যই একটি সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকাটা আবশ্যিক৷ আমাদের সংবিধানে অবশ্যই তার নির্দেশনা দেওয়া আছে৷ আজ পরিবর্ত্তনশীল জগতে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটছে৷ তাই কেন্দ্র–রাজ্যের সম্পর্ক, কেন্দ্রের আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ ও বিভিন্ন ব্যাপারে বিশেষ করে নোতুন নোতুন যেসব সমস্যার উদ্ভাবন হচ্ছে তার সমাধান কল্পে বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিপূর্ণ পথকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে উভয় পক্ষকে৷

আজ যেটা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে তা হলো ভারত প্রায় ৭৭ বছর স্বাধীন হয়েছে কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে শতকরা সেই ৭০ক্ম মানুষের কোন সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়নি৷ গণতন্ত্র তখনই সার্থক হতে পারে যখন নাগরিকদের নূ্যনতম আর্থিক উন্নতি ঘটে৷ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সমস্যায় আজও ভারতের কোটি কোটি মানুষ ভয়ঙ্কররূপে বঞ্চিত৷ চরম বেকার সমস্যায় নাগরিকগণ দিশেহারা৷ কলকারখানগুলোতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, শ্রমিকরা কর্মচ্যুত হয়ে পড়ছে৷ কৃষিতে যেভাবে মানুষ আটকা পড়ছে সেইভাবে কিন্তু এদেশের কৃষি উন্নত নয়৷ বিকেন্দ্রীত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা অদ্যাবধি গ্রহণ করা হয়নি৷ গ্রামগুলিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কোন পরিকল্পনা না থাকায় গ্রামের কর্মক্ষম যুবক যুবতীরা ভাগ্যান্বেষণে গ্রাম ত্যাগ করে শহরে ও নগরে পাড়ি দিচ্ছে সেই পুরানো দিনের মত৷ ফলে নগর ও শহরগুলি অধিক জনসংখ্যার চাপে চরমভাবে দূষিত হচ্ছে ও নানা সমস্যা ও অপরাধমূলক কাজের আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

তাই কালক্ষয় না করে প্রতিটি ব্লককে স্থানীয় কৃষি সম্পদের দ্বারা উজ্জীবিত করে সেই কৃষিভিত্তিক শিল্প ও কৃষি সহায়ক শিল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করে গ্রামগুলিকে আর্থিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে ও স্থানীয় কর্মক্ষমদের কর্ম সংস্থানের আশু ব্যবস্থা করতে হবে৷ তবেই বেকার সমস্যা দূর হবে ও গ্রামগুলি সম্পদশীল ও স্বয়ংভর হয়ে দাঁড়াবে৷ এ কাজে আঞ্চলিকতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে৷ ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে ও বন্টনে সমবায় পদ্ধতিকে গ্রহণ করতে হবে যাতে প্রত্যেক নাগরিক উৎসাহ পায় ও নোতুন পথের দিশা পায়৷ সেই সার্থক গণতন্ত্রের বার্তাবহ নিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে মানুষ এগিয়ে চলবে সকলকে নিয়ে৷ গণতন্ত্র তখনই সার্থক যখন সমাজতন্ত্র এগিয়ে আসবে মুক্তির পথ দেখাবে৷ সামন্ততান্ত্রিক ব্যাবস্থা অর্থাৎ ধনী ব্যাষ্টিদের আর্থিক শোষণ থেকে সমাজকে তারা যদি মুক্তির পথ না দেখিয়ে সেই ধনীর দুলাল হয়ে ছলে–বলে–কৌশলে সেই ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার শ্লোগান ‘শোষণের উপর সমৃদ্ধি’কে ভজনা করে চলে তা হলে রাষ্ট্রের বৃহত্তম জনসংখ্যা নিঃস্ব, রিক্ত, শোষিতই হবে আর যৎসামান্য ধনীব্যষ্টিরাই ধনেপুতে লক্ষ্মীলাভ করবে, তার সঙ্গে তাদেরই কৃপাধন্য রাজনৈতিক দলের নেতা, নেত্রী ও ক্যাডাররা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হয়ে সুখে স্বাচ্ছন্দে কালাতিপাত করবে যেমন অদ্যাবধি হয়ে আসছে৷

আজ সারা ভারত তো রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে চরমভাবেই আক্রান্ত৷ দুর্নীতিতে দেশ মুখথুবড়ে পড়েছে৷ দেশ সেবক তো চোখেই পড়েনা৷ শিক্ষার মান এতটাই নিম্নগামী যার জন্যে উচ্চশিক্ষায় গবেষণাই অবহেলিত৷ শিক্ষায় এদেশে রাজনৈতিক অনুপ্রবেশটা মারাত্মক৷ আজ শিক্ষা শিক্ষাবিদদের হাতে নেই৷ সরাসরি রাজ্যের শাসকগোষ্ঠী তাদের খেয়ালখুশি মতই শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে৷ শিক্ষাক্ষেত্রকে রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় ক্যাডার তৈরীর আঁতুড়ঘর তৈরী করে ফেলেছে৷ আইনশৃঙ্খলা নেই বললেই চলে৷ মাতৃজাতির পথে ঘাটে দারুণভাবে লাঞ্ছনাটাই আজকের গণতান্ত্রিক শাসনের চরম লজ্জাজনক পরিণতি৷ আজ দারুণভাবে দেশ নৈতিকতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, ত্যাগ, নিষ্ঠা ও সেবা হতে বঞ্চিত৷ অসংস্কৃতি, উচ্ছৃঙ্খলতা, ভয়ঙ্কর আত্মগ্লানিকর ভোগবাদের দ্বারা সমাজ আক্রান্ত৷

অতীতে ভারতবর্ষের দেশপ্রেমিকগণ জীবনকে তুচ্ছ করে স্বাধীনতা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করে যে স্বাধীনতা আনয়ন করেন তা আজকের যে ব্যর্থ–বিফল গণতন্ত্রের মায়াজালে কোটি কোটি ভারতবাসী নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিত হচ্ছে সেটা কিন্তু সেই দেশপ্রেমিকদের আত্মত্যাগ কখনোই কামনা করেননি৷ আজও কিছু কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামী জীবিত আছেন তাঁরা এই চরম ব্যর্থতায় শুধু লজ্জাই পাচ্ছেন না আত্মগ্লানিতেও ভুগছেন!

মোদ্দা কথা হলো গণতন্ত্র তখনই সার্থক যখন গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা ধনীর ক্রীতদাস না হয়ে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পথে পা বাড়াবে সত্যই নোতুন কিছু করতে নচেৎ এ ব্যর্থ শাসন কোটি কোটি মানুষকে শোষণ করেই সেই শাসক ও তাদের পৃষ্ঠপোষদের উদর পূর্ত্তি করেই যাবে৷অনেক বছর তো হলো, আর কেন! এবার দেশের তরুণ তরুণীরা সাহসের উপর ভর করে সার্বিক শোষণ মুক্তির আন্দোলনে দেশকে শাপমুক্ত করুক নচেৎ দেশ জননীর চোখের জল বন্ধ হবে না৷ আর ধাপ্পাবাজ শোষকদের শোষণ বন্ধ হবে না৷