গত ৯/৬/২০২০ তারিখে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি দলের শীর্ষ নেতা শ্রীযুক্ত অমিত শাহ মহাশয় কয়েক শত কোটি টাকা খরচ করে "ভার্চুয়াল সভা"করলেন দলের নেতা নেত্রী, কর্মী,সমর্থকদের সঙ্গে । উদ্দেশ্য ছিল আগামী দিনে যে সকল রাজ্যে, বিশেষতঃ ২০২১ সালে পশ্চিম বঙ্গের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে জোরদার প্রচারের জন্যে কেন্দ্রের বিজেপি তথা এনডিএ সরকারের ছয় বছরের শাসনকালের সাফল্যগুলি তুলে ধরা । সেখানে তিনি মূলত: পশ্চিম বঙ্গের খারাপ অবস্থার প্রতি আক্রমন করতে গিয়ে বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনকে "করোনা এক্সপ্রেস" বলে' লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের অপমান করেছেন । পরের দিন শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, তিনি করোনা এক্সপ্রেস বলেন নি--যেভাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের কোনরকম সতর্কতা অবলম্বন না করে ট্রেনগুলিতে গাদাগাদি অবস্থায় নিয়ে আসা হচ্ছে তা দেখে সাধারণ মানুষ যে কথাগুলো বলছিলেন, তিনি তা-ই বলেছেন ।
এখন দেখা যাক এই মন্তব্য ও আক্রমণ- প্রতিআক্রমণগুলোর প্রেক্ষাপট কী? ভারতবর্ষে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে প্রধানমন্ত্রী শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র মোদী মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে সারাদেশে "লকডাউন" ঘোষণা করে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ভিনরাজ্যের শ্রমিকদের যারা যে রাজ্যে আছেন তারা সেখানেই থাকবেন ও তাঁদের থাকা-খাওয়া, সুখ-সুবিধা দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্যের । কিন্তু পরবর্তী সময়ে সংবাদে প্রকাশ, দীর্ঘ দুই মাসাধিককাল লকডাউন এর ফলে তারা কপর্দকশূণ্য অবস্থায় খাদ্য পানীয়, ঔষধপত্রের অভাবে ও দূররাজ্যে আত্মীয় স্বজনের বিভিন্ন অসুবিধার কারণে নিজের রাজ্যে ও স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েন যা খুবই স্বাভাবিক । অনন্যোপায় অবস্থায় তাঁরা হাজারে হাজারে কাতারে কাতারে সড়ক পথে, রেললাইন ধরে হেঁটে বা সাইকেলে,যে যেভাবে পেরেছেন চলতে শুরু করেছিলেন । পথে কেউ পথশ্রমে দমবন্ধ হয়ে, কেউবা ট্রেনের ধাক্কায় আবার অনেকে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন । সংবাদ মাধ্যমে ও সামাজিক মাধ্যমগুলিতে তুমুল সমালোচনা হচ্ছে দেখে কেন্দ্রীয় সরকার নড়েচড়ে বসে । কেন্দ্র সরকারের কেষ্টবিষ্টুরা অবস্থা বেগতিক দেখে প্রথমে রাজ্য সরকারগুলির উপর দোষারোপ করার চেষ্টা করে । কিন্তু তাতে চিড়ে ভিজছে না দেখে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্যে ট্রেন চালু করতে বাধ্য হয় ট্রেন গুলোর নাম দেয় "শ্রমিক স্পেশাল" । প্রথম দিকে শ্রমিকদেরকেই গাড়িভাড়া দিতে বলা হয় । সহায়সম্বলহীন শ্রমিকদের থেকে ভাড়া নেওয়ার মতো অমানবিক কাজের সমালোচনার মুখে রেলমন্ত্রক পিছিয়ে গিয়ে ৮৫% - ১৫% এর গল্প শুরু করে । শেষ পর্যন্ত রাজ্যগুলিই শ্রমিকদের ভাড়া ও তাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে ।
কেন্দ্রীয় সরকার সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করার আগে বা পরে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজের রাজ্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে শ্রমিকরা এই ধরনের অমানবিক অবস্থার শিকার হতেন না, পথে মৃত্যু বরণও করতেন না । শুধু তাই নয়, করোনা সংক্রমণ এর নিরিখে রেডযোন বা কনটেনমেন্ট যোনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুই মাস থেকে তারা মারণরোগে সংক্রামিতও হতেন না অথবা করোনা আক্রান্ত অবস্থায় ভিড় ট্রেনে গাদাগাদি করে অন্যদের সংক্রমণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হতেন না । তাই স্বাভাবিক ভাবেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, শ্রমিক স্পেশালগুলি কি করোনা এক্সপ্রেস এ পরিণত হয়েছে? এছাড়াও শ্রমিক স্পেশালগুলিতে শ্রমিকদের ফিরে আসার পরেই বিভিন্ন রাজ্যে করোনা আক্রান্তদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, এই বাস্তবকে উপেক্ষা করা যাবে না ।
রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীগণ কখনও সত্যের ধার ধারেন না । তাই বহুবিধ রাজনৈতিক কারণে (মধ্যপ্রদেশ-এর শাসন ক্ষমতা দখল করা অবশ্যই একটি কারণ)যখন প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ করার প্রয়োজন ছিল (ভারতে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়েছে বিদেশ থেকে আগতদের হাত ধরে, অথচ দীর্ঘদিন তাদের কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা বা বাধার সম্মুখীন হতে হয় নি) সেটা করা হয় নি, সংসদ চালু রাখা হয়েছে, বিভিন্ন ধর্মীয় সম্মেলনে বহু লোকের সমাগম হয়েছে,এই ঘটনা গুলোয় কোনো নিয়ন্ত্রণ করা হয় নি । এই সব ত্রুটি ধামাচাপা দেয়ার জন্যে ও মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতায় পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কথিত "করোনা এক্সপ্রেস" শব্দবন্ধটি শ্রীযুক্ত অমিত শাহ ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা অগাধ জলে খড়কুটোর মতো ধরে ফেলতে চাইছেন । বাংলা আজ যখন করোনা সংক্রমণ, ঘূর্ণিঝড় আমফান,আগতপ্রায় বর্ষার বিভীষিকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আপ্রাণ চেষ্টা করছে,সেই সময় দেশের স্বরাষ্ট্র মণ্ত্রী হিসেবে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত না বাড়িয়ে, একজন বিজেপি নেতা হিসেবে সমালোচনা আর রাজনৈতিক প্রচারের ঢক্কানিনাদ করে চলেছেন । তিনি করোনা এক্সপ্রেসকে বর্তমান রাজ্যসরকারের "এক্জিট এক্সপ্রেস" নামে অভিহিত করেছেন ।
অবাঙালী বাবুরা নিজেদের যত বেশি চতুর ভাবুন না কেন, বাঙালীদের অত বোকা ভাবার দুঃসাহস করবেন না । পরে হাহুতাশ করতে হতে পারে । এই বাঙালীরাই আত্মত্যাগের বিনিময়ে মহাশক্তিধর ব্রিটিশদের তাড়িয়েছে যার পরিণামে আজকে হিন্দি-সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়ারা বাংলার সামনে ছড়ি ঘোরাচ্ছে । বাঙালির পিঠ কিন্তু দেওয়ালে ঠেকে গেছে । এ বার ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রত্যাঘাতের পালা । সুতরাং কার এক্জিট কিভাবে হবে কেউ কেউ জানে না । বাঙালীকে ছোট ভাবার অনেক বড় মাশুল দেওয়ার জন্যে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীরা সাবধান!
- Log in to post comments