বুদ্ধিবৃত্তিতে বানর কিছুটা মানুষের কাছাকাছি বরং মানুষের মধ্যে এমন কিছু কিছু উন–মানস আছে যাদের বুদ্ধি বানরের চেয়েও কম, তাদের জন্যে সাধারণ পুরুষ বাক্য ‘বানর’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়৷ ‘‘দেখতে মানুষের মত কিন্তু বুদ্ধি বানরের মত–যা যা আর বাঁদরামি করতে হবে না৷’’ কিন্তু বুদ্ধির উৎকর্ষ যাই হোক না কেন, বাঁদর বস্ত্র পরিধান করে না, যদিও তারা জল ও আগুনের পার্থক্য বোঝে৷ এই জন্যে ‘কীশ’ শব্দের অন্যতম যোগারূঢ়ার্থ হচ্ছে বাঁদর৷
‘ক’ অর্থে জল৷ জলের ঈশ–এই অর্থে ‘কীশ’ শব্দটি প্রাচীনকালে ব্যবহৃত হত৷ ভাবারূঢ়ার্থে ‘কীশ’ বলতে বোঝায় জলের স্বভাব ও গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে যিনি সম্যক্রূপে অবহিত আছেন৷
‘কীশ’ বলতে গিয়ে একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ল৷
আমাদের শহরে থাকতেন একজন মুখুজ্জে মশাই৷ তিনি যখন বর্দ্ধমান জেলায় তাঁর স্বগ্রামে থাকতেন তখন সন্ধ্যের সময় গ্রামশুদ্ধ লোক তাঁর বাড়ীতে জড়ো হত ও তাঁকে ঘিরে বসে গল্প শুণত৷ তিনি যখন জীবিকা সূত্রে আমাদের শহরে আসতেন তখন দেখা যেত–শহরের না হোক, পাড়ার অধিকাংশ লোকই তাঁকে ঘিরে রয়েছে আর বলছে–মুখুজ্জে মশাই, গপ্প বলুন......চাই গপ্প.....আরও গপ্প.......রঙিন গপ্প......মজাদার গপ্প৷
মুখুজ্জে মশাই মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক, সভ্য–ভদ্র ও শাদা–সিধে৷ কোন ব্যাপারে কারও মনে কোন জটিল প্রশ্ণ দেখা দিলে লোকে তা মুখুজ্জে মশাইয়ের গোচরীভূত করত মুখুজ্জে মশাই উত্তর দিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করতেন৷
একবার আমার অতি পরিচিত সুবোধ গাঙ্গুলী মুখুজ্জে মশাইকে জিজ্ঞেস করলেন–‘‘হ্যাঁ মুখুজ্জে মশাই, বাঁদররা আপনি বলেন খুবই বুদ্ধিমান৷ তবে তারা আমাদের মত প্যান্ট–শার্ট পরে না কেন?’’
মুখুজ্জে মশাই বললেন–‘‘এটা একটা জটিল প্রশ্ণ৷ এর সঙ্গে সমাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক প্রগতি তিনই নিহিত রয়েছে৷ তাই উত্তরটা একটু ভেবে বলতে হবে’’৷
পরদিন সন্ধ্যেয় মুখুজ্জে মশায়ের মুখ ভার.......মন খারাপ .......কপালে দুশ্চিন্তার বলিরেখা৷
সবাই বললে–‘‘কী ব্যাপার মুখুজ্জে মশাই, কী হয়েছে’’
মুখুজ্জে মশাই বললেন–‘‘দেখনা আমার সব হাসি–গপ্প আজকের রেডিও–সমাচার অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিয়েছে’’৷
সুবোধ বললে–‘‘ভেবেছিলুম, আজকে আপনি আমার প্রশ্ণটার উত্তর দেবেন৷ তা আজকের সন্ধ্যেয় কী আপনি বারান্দায় বসবেন না’’
মুখুজ্জে মশাই বললেন–‘‘না, আজ আমার মানসিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়৷ আমাদের মত অল্প বেতনের সরকারী কর্মচারীর ওপরেও মহামান্য সরকার বাহাদুর ইনকাম ট্যাক্স (আয়কর) ধার্য করবেন৷ আজ আমার পক্ষে বৈঠকে আসা সম্ভব নয়৷ ১৫৷২০ মিনিট অপেবা করে দেখো, যদি গেলুম তো গেলুম, নইলে বুঝবে আমি শুয়ে পড়েছি’’৷
মুখুজ্জে মশাইয়ের শ্রোতৃবর্গ তাঁর প্রতীবায় তীর্থের কাকের মত হা–পিত্যেশে আকাশের পানে চেয়ে বসে রইল মিনিটের পর মিনিট৷ কিন্তু কই, মুখুজ্জে মশাইয়ের পদধ্বনি তো শোণা যায় না’’৷
হঠাৎ মুখুজ্জে মশাইয়ের পদধ্বনি......৷ শান্ত সংযত ভাবলেশহীন মুখ৷ মুখুজ্জে মশাইয়ের মুখে দুশ্চিন্তার বলিরেখা অন্তর্হিত৷ মুখুজ্জে মশাই দৃৃতার সঙ্গে বললেন ‘‘ইউরেকা........ইউরেকা.......পেয়েছি....... পেয়েছি’’৷
সবাই সমস্বরে বললে–কী পেয়েছেন মুখুজ্জে মশাই কী পেয়েছেন বলুন .......বলুন৷
মুখুজ্জে মশাই বললেন–‘‘তবে শোণো, কতকগুলো গোপন কথা ......অতিগুহ্য তত্ত্বকথা......৷
কিছুদিন পূর্বে কিস্কিন্ধ্যানগরে নিখিল বিশ্ব বানর মহাসভার অধিবেশন হয়েছিল৷ তাতে উপস্থিত জ্ঞানী–গুণীরা অনেকেই বললেন–‘‘সভ্যতার প্রগতির সঙ্গে আমাদেরও তাল মিলিয়ে চলতে হবে৷ সেই কোন সুপ্রাচীন যুগ থেকে বানরদের ‘কীশ’ বলা হয়ে আসছে৷ ‘কীশ’ শব্দের মানে যাদের জ্ঞান–বুদ্ধি সবই আছে, কেবল প্যান্ট–কোট পরে না৷ আজকের পরিবর্ত্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের প্যান্ট–কোট পরা উচিত কিনা এ নিয়ে গভীরভাবে ভাববার দিন এসেছে৷
অধিবেশনে বানর–মহাসভার অনেক তাগড়া তাগড়া এম–পি–ও উপস্থিত ছিলেন৷ তাঁরা বললেন–এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে এখানে বসে সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভাল৷ বরং বিষয়টি জনমত সংগ্রহের জন্যে প্রেরণ করা হোক–আর একটি শক্তিশালী কমিশন নিয়োগ করা হোক৷
সকলেই সমস্বরে বললে–পৃথিবীর কোন ভূখণ্ডে কোন বৃক্ষে কোন বানর প্রকাশ্যে বা গোপনে বসবাস করছে তা ধরবার উপায় নেই আবার সব গোষ্ঠীর বানরের ভাষা সব বানরেরা ভালভাবে বোঝে না কারণ বানরদের গোষ্ঠীগতভাবে ভাষা–ভেদ আছে৷ কোন লিপিও নেই..... কোন লিখিত সাহিত্যও নেই ........ গোটা একটিও সংবাদপত্র নেই৷ তাই জনমত সংগ্রহের মাধ্যমগুলো বানরদের মধ্যে বিশেষ কাজ দিতে পারে না৷ এ অবস্থায় একটি শক্তিশালী কমিশন নিয়োগ করলে ভাল কাজ হবে৷
একটি শক্তিশালী কমিশন নিয়োগ করা হ’ল, আর ঠিক করা হ’ল কমিশনের রায় সর্বজনগ্রাহ্য বলে বিবেচিত হবে৷
যথাকালে কমিশনের রায় বেরুল৷
কমিশন বানরদের জন্যে একটি বিশেষ ধরণের থ্রী–কোয়ার্টারস্ প্যান্টের (না–হাফ, না–ফুল)– বিধান দিলেন যাতে পায়ের ফাঁক দিয়ে ন্যাজটি সহজেই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে৷ গায়ে থাকবে এক ধরণের নাইলনের জামা যা গাছের ডালে ছিঁড়বে না, কাঁটা ক্ষিঁধলেও ফেঁসে যাবে না৷ কমিশনের রায় বেরোবার কিছুদিন পরে বানর মহাসভার আবার একটি অধিবেশন বসল৷ অধিবেশনে কর্মকর্ত্তারা বললেন–কমিশনের রায় গ্রহণযোগ্য অবশ্যই কিন্তু মাঝখানে একটি বিপদ হয়ে গেছে৷ কমিশনের রায় বেরোবার পর সমাজ–উন্নয়ন দপ্তরের ফালতু মিনিষ্টার (উপমন্ত্রী) মহোদয় বিশ্বের একটি বিশ্বস্ত মাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন৷ প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল ইউনিবার্স্যাল ট্রেডার্স্ কোম্পানী আনলিমিটেড অর্থাৎ এঁরা বিশ্বের সমস্ত দেশেই অসীমিতভাবেই তৈরী–পোষাক সরবরাহ করে থাকেন ও করবেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফালতু মিনিষ্টারের সঙ্গে পোষাক প্রতিষ্ঠানের মতভেদ দেখা দিল৷
ফালতু মিনিষ্টার বললেন– আপনাদের পোষাক গোটা বিশ্বের সমগ্র বানর সমাজই পরিধান করবে৷ সুতরাং আপনাদের লাভ হবে অঢেল৷ এজন্যে আমাকে অন্ততঃ দশ লাখ টাকা সেলামী দিতে হবে’৷
পোষাক–প্রতিষ্ঠান বললে–আপনাকে দশ লাখ টাকা সেলামী দিতে গেলে আমাদের পড়তা পড়বে না৷ বড় জোর পাঁচ লাখ টাকা ছাড়তে পারি৷ তার বেশী এক কাণাকড়িও না৷ তা ছাড়া জানেনই তো, বাঁদরদের সংখ্যা কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের মত ক্রমঃক্ষয়িষ্ণু৷ আজকের চাহিদা যা কাল তা থাকবে না৷
ফালতু মিনিষ্টার আর পোষাক–প্রতিষ্ঠানের সেলামী নিয়ে কষাকষিতে শেষ পর্যন্ত পোষাক তৈরীর কাজ বন্ধ হয়ে গেল৷
সবাই সমস্বরে বললে–তারপর তারপর তারপর
সভাপতি বললেন–‘এখন আর পোষাক–প্রতিষ্ঠানের তৈরী প্যান্ট–শার্ট ব্যবহারে কোন বাধা নেই–আপত্তিরও কারণ নেই৷ এমন সময় সভার এক কোণ থেকে একজন ছোকরা বানর এম. পি. (তরুণ তুর্ক) চীৎকার করে বলে উঠল–চলবে না...চলবে না পোষাক–পরা চলবে না......চলবে না৷
সবাই বললে–কেন.....কেন..... কেন?
ছোকরা বানর বললে–‘ধরুন, আমরা সবাই যদি প্যান্ট–শার্ট পরি তাহলে আমাদের সঙ্গে মানুষের তফাৎ রইল কোথায় এমনকি ন্যাজের সিংহভাগও প্যান্টের ভেতরেই থেকে যাচ্ছে৷ আর সেজন্যে মহামান্য সরকার বাহাদুর আমাদের ছাড়বেন না৷ সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ওপর ইন্কাম ট্যাক্স ধার্য করবেন৷ তাই আমরা যদি আয়করের রাহুগ্রাস থেকে বাঁচতে চাই তাহলে আমাদের সবাইকার ‘কীশ’ হয়ে থাকা উচিত৷
ছোকরা বানরের ভক্তরা সবাই একসঙ্গে বললে–চলবে না.....চলবে না৷ পোষাক পরা চলবে না......চলবে না......হুপ্ হুপ্ হুপ্৷
চলবে না.......চলবে না চক্রান্তকারীদের কালো মুখোশ খুলে দাও.....খুলে দাও......তাদের কালো হাত পুড়িয়ে দাও পুড়িয়ে দাও–হুপ্ হুপ্ হুপ্৷
বন্ধুগণ ভাইসকল বানরজাতির ওপর সাম্রাজ্যবাদীদের এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের এই মুহূর্ত থেকে একতাবদ্ধ হতে হবে৷ আমাদের সরব হতেই হবে৷ হুপ্ হুপ্ হুপ্৷
আমরা কীশ হয়ে জন্মেছি, কীশ হয়ে আছি, আর কীশ হয়েই মরব৷ কীশ হয়ে থাকা আমাদের জন্মগত অধিকার৷ হুপ্ হুপ্ হুপ্৷ (মধুমালঞ্চ, কলিকাতা, ১৬৷৩৷৮৬)