দ্বিতীয়বার কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছে বিজেপি তথা এন.ডি.এ৷ সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ হ’ল কীভাবে সারা ভারতে যে ভয়ঙ্কর বেকার সমস্যায় কোটি কোটি শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত যুবক-যুবতী বেকার হয়ে জীবন যন্ত্রণা ভোগ করছেন তার কিছুটা সমাধানের চেষ্টা করা৷ তা না করে সেই হিন্দীভাষাকে কীভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে কচি কচি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে প্রবেশ করানো যায় তার জন্য পাঠ্যবিষয়ে হিন্দীকে বাধ্যতামূলক করতে কেন্দ্র একতরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে৷ এ ব্যাপারে কস্তুরীরঙ্গনের নেতৃত্বাধীন কমিটির তৈরী জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া পেশ করার প্রস্তাব করা হয় লোকসভায়৷ ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে মাতৃভাষা, ইংরেজী ও হিন্দী ভাষাকে বাধ্যতামূলকভাবে রাখতে হবে৷ আগে ছিল মাতৃভাষা, ইংরেজী ও সংসৃকত৷ হিন্দীভাষী এলাকায় হিন্দী গুরুত্ব পেত কিন্তু অ-হিন্দী ভাষাভাষী এলাকায় তা ঐচ্ছিক ছিল৷ একে বাধ্যতামূলক করা হয় খসড়া প্রস্তাবে৷ মনে রাখা দরকার দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় শিক্ষা বিষয়টি কেন্দ্র ও রাজ্য যৌথ তালিকায় আছে৷ কাজ চালাতে ইংরেজী ও হিন্দী ভাষাকে কেন্দ্র রাখে পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে৷ হিন্দী কখনো এ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা নয়৷ এটা গুজরাট হাইকোর্টে সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে৷ হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীরা দীর্ঘ বছর ধরে একনাগাড়ে হিন্দি ভাষাকে অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলির ওপর জোর করে চাপিয়ে আসছে৷
গত সোমবার দেশ জুড়ে সমালোচনায় মুখে পড়ে এই সুপারিশ থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ কেন্দ্রের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক সোমবার জাতীয় শিক্ষানীতির সংশোধিত খসড়া পেশ করেন৷ হিন্দীকে বাধ্যতামূলক করার পরিবর্তে নমনীয় শব্দটি যোগ করা হয়েছে৷ শিক্ষার্থীরা পছন্দমত ভাষা বেছে নিতে পারবে৷ এর তীব্র প্রতিবাদ ওঠে মূলত দক্ষিণ ভারত থেকে৷ বাঙলাও তীব্র প্রতিবাদ করেছে৷ তামিলনাড়ু, কর্ণাটকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে৷ প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে এন.ডি.এ.-র ঘর থেকেও৷ এদের শরিক দল এ.আই.ডি.এম.কে প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে৷
অহিন্দী রাজ্যে জোর করে হিন্দী ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার ষড়যন্ত্রটা দেশের বহুত্ববাদী চিন্তাধারায় আঘাত হানবে এটা মনে করে দক্ষিণের রাজনৈতিক দলগুলি৷ তামিলনাড়ুর শিক্ষামন্ত্রী সেঙ্গোঁওয়াইয়াল ও মুখ্যমন্ত্রী পালানাস্বামী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এ ব্যাপারে প্রতিবাদপত্র দিয়েছেন৷ ফলে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ও বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর টুইটে জানিয়েছেন পড়ুয়াদের ওপর জোর করে হিন্দী ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হবে না৷
তবে একটা কথা ভেবে বিস্ময় হয় তা হ’ল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থাটা চালু সেখানে কী কারণে কেন্দ্র নানাভাবে ভাষা ও অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি করে থাকে? এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দেশ৷ কেন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে রাজ্যগুলির ত্যাগ, সদিচ্ছা ও পারস্পরিক মধুর সম্পর্কের ওপর৷ কেন্দ্র কখনো কট্টর স্বৈরাচারিতার নীতি প্রয়োগ করতে পারে না৷ দীর্ঘ ৭২ বছরের গণতান্ত্রিক শাসনে বহুবার কেন্দ্রের সেই নীতিকেই দেশবাসী দেখে আসছে৷ তাছাড়া শিক্ষায় বেসরকারীকরণটাই কাম্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে৷ শিক্ষাবিদদের দ্বারা শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত হবে৷ এ দেশে দেখা যায় কি রাজ্য ও কি কেন্দ্র যেখানে যখন যে দল শাসনে আসে সেই দলই এই শিক্ষাকে কেন্দ্র করে বড়ই বাড়াবাড়ি করে চলে৷ জনগণের সরকারের কর্তব্য নয় শিক্ষাকে নিয়ে অযথা নাক গলানো৷ শিক্ষার পবিত্রতাকে রক্ষা করাটা কর্তব্য যাতে দেশে সুশিক্ষিত নাগরিক গড়ে উঠতে পারে৷ শিক্ষা বিস্তারে সরকার কি কেন্দ্র ও রাজ্য আর্থিক সহায়তা করবে৷ শিক্ষাবিদ্দের হাতে শিক্ষা থাকাটাই কল্যাণকর৷ রাজনৈতিক দলগুলি শিক্ষাকে নিয়ে বাড়াবাড়িটা বেশী করে৷ এটা অনৈতিক৷ সরকার আসবে ও যাবে৷ কিন্তু সুশিক্ষাব্যবস্থাই দেশের সুনাগরিক গড়ে তুলবে যারা দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যাবে৷ তাই শিক্ষার পবিত্রতাকে নষ্ট করার অধিকার কারোর নেই৷ এতে শিক্ষা ব্যবস্থাটা নোংরা দলতন্ত্রের হস্তক্ষেপে ধবংসপ্রাপ্ত হয়৷ ইংরেজ আমলে শিক্ষাবিদগণ ইংরেজ সরকারকে শিক্ষা ব্যবস্থায় সরাসরি নাক গলাতে দেন নি৷ সেদিন বিদ্যার মন্দির ছিল পবিত্র৷ আজ দলীয় রাজনীতিতে শাসকদলের স্পর্শে শিক্ষা মোটেই শ্রীবৃদ্ধির পথে এগোচ্ছে না৷
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যেটা স্মরণে রাখা দরকার তা হ’ল ভারতের কৃষ্টি, সংস্কৃতি সবকিছু দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন সংসৃকত সাহিত্যের ওপর৷ তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে সংসৃকত ভাষার পঠন-পাঠনকে ভারতের শিক্ষা জগতে যে মর্যাদা দেওয়া দরকার সেটা বর্তমানে দেশের কেন্দ্র ও রাজ্যসরকারগুলি বিশেষ নজর দিচ্ছে বলে মনে হয় না৷ সংসৃকত পঠন-পাঠনকে মাধ্যমিক স্তরেতেও পড়ানোর কোন ব্যবস্থা নেই৷ যে সংসৃকত ভাষাটা ভারতের সকল ভাষার জননী স্বরূপা আর যার মধ্যে রয়ে গেছে সমগ্র ভারতের আসল পরিচয়, সেই সংসৃকত ভাষাকে হেয় করে ভারত কখনও বিশ্বের দরবারে সার্থক মানবতাবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না৷
শিক্ষা অর্থাৎ বিদ্যাশিক্ষা৷ ‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’৷ আধ্যাত্মিক জ্ঞান ছাড়া মানুষ মনুষত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে না৷ তাই আধ্যাত্মিক শিক্ষা ছাড়া শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না৷ ভারতবর্ষে এটি হ’ল সুশিক্ষার চাবিকাঠি৷
এই শিক্ষাকে রক্ষা করাটা জাতীয় পবিত্র কর্তব্য৷ প্রাচীন ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার আঙ্গিককে বাদ দিয়ে সুশিক্ষা অসম্পূর্ণই থাকে৷
অনেক ভাষা শেখাটা প্রশংসনীয়৷ মানুষ যতগুলো ইচ্ছে ভাষা শিখুক, তা ভাল৷ কিন্তু কারো ওপর জোর করে কোনও ভাষা চাপিয়ে দেওয়াটা অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক৷
বরং কেন্দ্রকে স্মরণে রাখতে হবে , সমস্ত রাজ্যের অভিভাবক হিসেবে সমস্ত স্বীকৃত আঞ্চলিক ভাষাগুলির উন্নতিসাধন করাই তার পবিত্র কর্তব্য৷
- Log in to post comments