পূর্ব প্রকাশিতের পর
শৈব প্রথা
শৈব ও আর্য বিবাহ প্রাচীন ভারতে ভালভাবেই চলত৷ বর্ত্তমানে তাদের কিছু কিছু ভগ্ণাংশ আধুনিক বিবাহে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে৷ হিন্দু বাঙালীর বিবাহে যে সকল দেশাচার (কলাগাছ দিয়ে, অভাবে বাঁশগাছ দিয়ে ছাদনাতলা তৈরী করা, ঘটে ডাব, অভাবে বেল ব্যবহার করা–এগুলি সবই দেশাচার), কুলাচার (কুলের গাছ দিয়ে আঘাত করা, শ্বশুর ঘরে ঢুকবার সময় দুধ উথলে যাওয়া, দুধে আলতা পরে দাঁড়ানো), স্ত্রী–আচার (এয়ো [অবিধবা >অবিহআ >আহিয়া >এয়ো)৷ কেবল সধবা মেয়েরাই এতে অংশগ্রহণ করতে পারেন–বিধবারা পারেন না৷ তাই এয়ো মানে অবিধবা যার তাদ্ভবিক রূপ হ’ল ‘এয়ো’৷ বাঙলার অন্যান্য অংশে মেয়েরাই এয়ো হয়, কিন্তু রাঢ়ে বিবাহিত পুরুষেরাও এয়ো হতে পারেন] হওয়া) ইত্যাদি সমস্তই বিবাহ পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত৷ হ্যাঁ, তাই বলছিলুম, মনে হয় আগে এই দেশাচার, কুলাচার, স্ত্রী–আচার ছিল না৷ সমস্ত অনুষ্ঠান এসেছে পরবর্ত্তীকালে যখন বাঙলার মানুষের মনে আর্যত্বের ছাপ লাগাবার একটা হ্যাংলামি এসে গেছল৷
ব্রাহ্ম বিবাহ
ব্রাহ্ম বিবাহে (বর্ত্তমান ব্রাহ্ম সমাজে প্রচলিত বিবাহ এই অর্থে‘ ব্রাহ্ম বিবাহ’ শব্দ মনু ব্যবহার করেন নি৷ বর্ত্তমান ব্রাহ্ম সমাজের উদ্ভব ইংরেজ আমলে, মনু ছিলেন তার অনেক আগে৷ ব্রাহ্মবিবাহ তৎকালীন সমাজে প্রচলিত একটি বিবাহ পদ্ধতি বিশেষ)৷ সালংকারা কন্যাদানকে মনু সমর্থন করেছিলেন যদিও এই কন্যাদান ব্যবস্থা একটা মানবিকতা–বিরোধী ব্যবস্থা৷ এতে নারীকে গোরু–ছাগল–হাঁস–মুরগীর পর্যায়ভুক্ত করা হয়৷ মানুষ মানুষকে দান করবে কোন স্পর্দ্ধায়৷ নারী কি বেচাকেনার পণ্য৷ হ্যাঁ এককালে–এককালে কেন, প্রাচীনকালে দীর্ঘদিন ধরে মানুষ নিয়েও ব্যবসা চলত৷ নারী–পুরুষ উভয়কে নিয়ে হাটে–বাজারে কেনা–বেচা চলত যদিও আজ সে কথা ভাবতেও বিচ্ছিরি লাগে, তবু কথাটা সত্যি৷ এমনকি, ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে বাঙলায় কিছু কিছু মানুষ কেনা–বেচা চলত৷ বাঙলায় শেষ নারী–বিক্রয়ের ঘটনা ঘটেছিল বাখরগঞ্জ জেলার ঝালকাঠি নামক একটি হাটে মাত্র সাতটি টাকার বিনিময়ে৷ slave trade বা ক্রীতদাস বিক্রয় প্রথাও ছিল ঠিক এমনই৷ পরিশ্রমী কালো পুরুষ ও নারীকে দাস–দাসী হিসেবে খাটাবার জন্যে সভ্য (?) দেশের মানুষেরা ব্যাপকভাবে কিনতেন৷ ক্রেতা ছিলেন মুখ্যতঃ প্রাচীন রোমক ও গ্রীস দেশের ধনাঢ্য বণিকেরা৷
এ ব্যাপারে ভারত ও ইয়ূরোপের অন্যান্য দেশগুলোও কম যেত না৷ পূর্ব বাঙলা থেকে মেয়ে কিনে পশ্চিম বাঙলায় বিক্রয় করা সে কালের বোম্বেটেদের একটা বড় কাজ ছিল৷ ওই ধরণের মেয়েদের অনেকেই পুত্র–বধু রূপে গ্রহণ করত–বিশেষ করে তাদের মধ্যে যদি কন্যাগত পণপ্রথা প্রচলিত থাকত৷ তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি অনেকে সমর্থন করলেও কন্যাদান প্রথা প্রাচীনকালের দাস ব্যবসায়ের নামান্তর মাত্র৷ এতে নারীর সম্মান ধূলোয় লুটিয়ে যেত৷ বিবাহে টাকা নিয়ে যারা ছেলের বিবাহ দেয় তারাও কিন্তু ঘুরে ফিরে ছেলে বেচা–কেনায় নাবেন৷ কলকাতায় বিবাহের স্ত্রী–আচারের মন্ত্রে আছে শ্বাশুড়ী বরকে সূতো দিয়ে ঘিরতে ঘিরতে বলছেন,
‘‘কড়ি দিয়ে কিনলুম, দড়ি দিয়ে বাঁধলুম,
হাতে দিলুম মাকু, একবার ভ্যাঁ করো তো বাপু৷’’
‘বিবাহ’ শব্দের যথার্থ অর্থ দেখতে গেলে, তার বৈয়ষ্টিক ও সামাজিক মূল্যায়ন করতে গেলে কোন কোন বিবাহ বিবাহপর্যায়ভুক্তই নয়৷
আনন্দমার্গ প্রথা
হ্যাঁ, আনন্দমার্গের বিবাহ–পদ্ধতি মনুক্ত গন্ধর্ব প্রায় বিবাহ, তবে এই বিবাহ প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত হয়৷ অর্থাৎ সামাজিক ভাবে অনুষ্ঠিত, সমাজ–স্বীকৃত ভাবে অনুষ্ঠিত গন্ধর্ববিবাহ এই আনন্দমার্গ বিবাহ৷ আইনের ভাষায় এটি হিন্দু বিবাহ৷ তবে আমরা আইনের কারবারী নই,আমরা মানবতার উজ্জীবক৷ (‘‘গন্ধব‘ বিবাহ’’, ‘শব্দ–চয়নিকা, ১৯শ পর্ব)
রাঢ়ে তথাকথিত নিম্নবর্ণের লোকেদের মধ্যে শৈব মতে বিবাহ এখনও প্রচলিত আছে৷ বর–বধূর মালা বদল হ’ল আর বর কনেকে কিছু ধান দিলে৷ ধান দেবার অর্থ হ’ল–আমি সারা জীবন কনের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিলুম৷ আর বর কনের মাথায় খানিকটা সিঁদুর ঢেলে দিলে৷ বর বললে–‘আজীবনং ভাতকাপড়ং স্বাহা’৷ এইভাবে সরল অনাড়ম্বর পরিবেশে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিবাহ সম্পন্ন হয়ে থাকে৷ ব্রাহ্মণ পুরোহিত ডাকার কোন প্রয়োজন হয়না৷ এই হ’ল উদার শৈব মতবাদের অন্যতম নিদর্শন৷
(‘‘সভ্যতার আদি বিন্দু’’, ‘রাঢ়’, ৪থ অধ্যায়)
বিবাহ বিচ্ছেদ
হিন্দু আইনে একজন হিন্দু নাগরিক একাধিক বিবাহ করতে পারেন না কিন্তু মুসলিম আইনে একজন মুসলমান নাগরিক একাধিক বিবাহের অধিকারী৷ হিন্দু স্বামী অথবা হিন্দু স্ত্রীকে বিবাহ–বিচ্ছেদের দাবী নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয় কিন্তু একজন মুসলমান নাগরিক আদালতের সাহায্য ব্যতিরেকেই বিবাহ–বিচ্ছেদের অধিকারী৷ এছাড়া মুসলমান স্বামী তাঁর স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে পারেন কিন্তু একজন মুসলমান স্ত্রী তাঁর স্বামীকে পরিত্যাগ করতে পারেন না৷ এছাড়াও মুসলমান স্বামীকে স্ত্রীকে ত্যাগের জন্যে কোন রকম কারণও দেখাতে হয় না৷