বিদ্রোহী বাঙলা--- নেকড়ে বিদ্রোহ

লেখক
সুকুমার সরকার

বাঙলা একদিকে যেমন পৃথিবীর প্রাচীন পাথর-মাটির দেশ,  তেমনি পৃথিবীর বৃহত্তর ব-দ্বীপ ভূমি৷ উষ্ণ-আদ্র আবহাওয়ার কর্কটক্রান্তি রেখায় অবস্থিত প্রাচীন এই পাথর-মাটির দেশেই ঘটেছিল প্রথম মানব প্রজাতির উদ্ভব৷ আবার এর বর্ধিত অংশ ব-দ্বীপবঙ্গ হওয়ায় জীবন-জীবিকাও ছিল সহজ৷ এই সহজ জীবন-জীবিকার খোঁজে ভারতবর্ষের অপরাপর ভৌম-সংস্থানের মানুষসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ চলে আসেন এই বৃহৎ বঙ্গে৷ আর  এই কারণেই বাঙলার মানুষের মধ্যে বহু দেশের মানুষের রক্ত মিশে আছে৷ বহু ভৌম অঞ্চলের মাটির গুণ মিশে আছে৷ এই বহু জায়গার মাটির গুণ ও বহু মানুষের রক্তের মিশ্রণ বাঙলা ও বাঙালিকে একটি বিশেষ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে৷ যা অপরাপর বিশ্বের মাটি ও মানুষের মধ্যে নেই৷ এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্যই কবি দ্বিজেন্দ্রলাল বলেছেন---

ধনধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা

তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা

ও সে স্বপ্ণ দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা৷

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,

সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি,

আবার এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্যই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘‘বাঙলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত৷’’ এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যই বাঙলার মাটি ও মানুষকে দিয়েছে অমিত শক্তি, অমিত তেজ৷ এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যই বাঙলার মাটি ও মানুষকে করেছে চির বিদ্রোহী৷ এই জন্যই বাঙলার আরেক নাম বিদ্রোহী বাঙলা অপরাপর বিশ্বের সকল মানুষকে ভালোবেসে তার স্নেহময় মাতৃক্রোড়ে আবার ঠাঁইও দিয়েছে৷ নিজস্ব প্রাণধর্ম বজায় রেখে অন্যের কাছ থেকে বিভিন্ন কিছু নিয়ে সমৃদ্ধও হয়েছে৷ কিন্তু সহজে কারও কাছে মাথা নোয়ায়নি৷ কারও কাছে বেশ্যতা স্বীকার করেনি৷ বাঙালি চিরকাল তার প্রাণধর্ম বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে৷ কোনো জাতির এই নিজস্ব প্রাণধর্ম বজায় রাখার চেষ্টা করার নামই বিদ্রোহ৷ এই বিদ্রোহে বাঙালি জাতি চির বিদ্রোহী৷ প্রাচীনকাল থেকে বাঙালি জাতির মধ্যে  এই বিদ্রোহী সত্তাটা কীভাবে কাজ করে চলেছে এই ধারাবাহিক নিবন্ধে আমি তা তুলে ধরার চেষ্টা করবো৷

বিদ্রোহী বাঙলার প্রথম যে বিদ্রোহের রূপ আমরা পাই তা আজ থেকে প্রায় সাত-আট হাজার বছর আগে৷ সাত-আট হাজার বছর আগের সেই বিদ্রোহী বাঙালিরা ছিলেন অস্ট্রিকো-নিগ্রোয়েড সঞ্জাত দ্রাবিড় জাতি৷ বহিরাগত আর্যরা যাঁদেরকে অনার্য বলে অবজ্ঞা করেছিল৷ তবে অনার্য বলে অবজ্ঞা করলেও বাঙলা ও বাঙালির অমিত তেজ আর্যরা প্রথম থেকেই টের পেয়ে গিয়েছিল পশ্চিম-উত্তর ভারত জয় করে প্রথম যখন আর্যরা বাঙলায় প্রবেশ করতে যার তখনই৷ বাঙলার প্রবেশ দ্বার তখন ছিল আর্য বিজিত মিথিলার পূর্ব প্রত্যন্ত দ্বারবঙ্গ৷ আজ যাকে দ্বারভাঙ্গা বলা হয়৷ এই দ্বারবঙ্গের পূর্বের বঙ্গ তখন পরিচিত ছিল রাঢ় নামে৷ প্রস্তরময় রক্ত মৃত্তিকার দেশ হিসেবে  এমন নাম হয়েছিল৷ আর্যরা যখন এই রাঢ়বঙ্গের দিকে ধাবিত হতে থাকে, সেদিনের সেই বিদ্রোহী বাঙালিরা আর্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে  পোষা কুকুর ও পোষা নেকড়ে লেলিয়ে দিয়েছিল৷ সেই প্রতিরোধের মুখে আর্যরা বহুদিন পর্যন্ত বঙ্গে প্রবেশের সাহস দেখাননি৷ বাঙালির তাড়া খেয়ে দেশটিকে তাঁরা বর্জন করেন এবং নাম দেন ‘‘বর্জভূমি’’৷ সেই থেকে রাঢ়ে আরেক নাম হয় ‘‘বর্জভূমি’’৷ বিস্মৃত ইতিহাসে এটাই ছিল বাঙালির প্রথম বিদ্রোহ৷ বিস্মৃত এই ইতিহাসকে গ্রথিত করেছেন বহু অজানা ইতিহাসের সত্য উদঘাটক মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘‘সভ্যতার আদিবিন্দু রাঢ়’’ গ্রন্থে৷ তবে এই বিদ্রোহ কোনো সুসংঘটিত বিদ্রোহ ছিল না৷ এই বিদ্রোহ ছিল আদিম মানবের স্বাভাবিক জীবন-জীবিকায় এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় প্রবেশের লড়াই৷ এক মানব গোষ্ঠীর অন্য মানবগোষ্ঠীর আগমণকে মেনে নেওয়া না নেওয়ার লড়াই৷ তবে সেই মেনে না নেওয়াও বেশি দিন টিকিয়ে রাখা যায় না৷ মানব প্রজাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মিলন প্রক্রিয়াটাও স্বাভাবিক ব্যাপার৷ এই মিলন প্রক্রিয়াতেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উদ্ভূত বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে বৃহত্তর মানব সমাজ ঘটনের দিকে এগিয়ে চলেছে৷ এই এগিয়ে চলার ইতিহাসে অস্ট্রিকো-নিগ্রোয়েড সঞ্জাত অনার্য দ্রাবিড় বাঙালির নৃতত্ত্বে এসে যোগ হয় আর্য নৃতত্ত্ব৷ আর্য অনার্য সংঘর্ষ-মিলনের পর যে বাঙালি জাতি ঘটিত হয় সেই বাঙালি আর্য অনার্য উভয়ের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে, উভয়ের পোশাক-খাদ্যাভাস নিয়ে, উভয়ের দায়াধিকার ব্যবস্থা নিয়ে আরও বেশি পুষ্ট হয়েছে৷ তবে সর্বাবস্থাতেই বাঙালি জাতি তার নিজস্ব প্রাণধর্ম বজায় রেখে চলেছে৷ বিদ্রোহী সত্তা বজায় রেখে চলেছে৷ এই বিদ্রোহী সত্তায় আদিম দ্রাবিড় বাঙালির অসংঘটিত প্রথম এই বিদ্রোহের নাম দেওয়া যেতে পারে ‘নেকড়ে বিদ্রোহ’৷ এই বিদ্রোহের অনেক অনেক পরে বাঙালি জাতি দ্বিতীয় যে বিদ্রোহ সংঘটিত করেছিল, সেই বিদ্রোহের নাম ‘কৈবর্ত্য বিদ্রোহ’৷ এটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সুসংঘটিত গণবিদ্রোহ৷ পরের পর্বে সেই কৈবর্ত বিদ্রোহ নিয়ে আলোচনা করবো৷ (ক্রমশঃ)