বিদ্যার্থী ও বিদ্যা সাধনা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

সরস্বতী পূজা হয়ে গেল৷ বিদ্যার্থীরা ঘটা করে সরস্বতী পূজো করল৷ দু’দিন ধরে আনন্দ উৎসব করলো, পুষ্পাঞ্জলি দিল৷ আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রারা যদি ভেবে থাকে, ভক্তিভরে সরস্বতী পূজা করলুম---আর পাশের কোন চিন্তা নেই, তাহলে কিন্তু মস্ত ভুল হবে৷ দেখো যারা সরস্বতী পূজা করে না বা সরস্বতী দেবীকে মানেও না বা সরস্বতী দেবীর কথা জানেও না--- যেমন অন্যান্য মতে বিশ্বাসীরা তাঁরা কেউ বিদ্যার্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই৷ পাশ্চাত্ত্যের যে বড় বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক,চিন্তাবিদ, তাঁরাতো আর সরস্বতী পূজা করেন না, কিন্তু বড় বড় বিদ্বান হতে পেরেছেন৷ আর যারা দিবারাত্রি সরস্বতীকে প্রণাম করে অথচ বিদ্যাচর্র্চয় যাদের নিষ্ঠা নেই, তাঁরা কিন্তু বিদ্যালাভ করতে পারছে না৷ তাহলে ব্যাপারটা বুঝলে তো ! ভালো করে মন দিয়ে পড়াশুনা করতে হবে৷ তাছাড়া অন্য কোন উপায়ে বিদ্যালাভ করা যাবে না৷ এ ব্যাপারে একথাও তোমাদের জানাতে চাই, কেবল পড়াশুনা করলেই বা স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি লাভ করলেই প্রকৃত বিদ্বান হওয়া যায় না, বা তারপর বড় একটা চাকরী পেলেই অথবা ভালো রোজগার করতে পারলেই তোমরা বিদ্যার্থীরা জীবনে সাফল্য লাভ করবে এটা ভাবা মস্ত ভুল৷ প্রকৃত বিদ্যা কী? এটাই তোমাদের আগে জানতে হবে৷ বলা হয়, ‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’ অর্র্থৎ সেটাই বিদ্যা যা মানুষকে বিমুক্তি দেয়৷ বিমুক্তি মানে স্থায়ী মুক্তি৷ কী থেকে মুক্তি- না, বন্ধন থেকে মুক্তি৷ মুক্তির বিপরীত অবস্থা বন্ধন৷

এখানে আরেকটা কথা জানা দরকার৷ আমরা তিন ধরনের বন্ধনে আবদ্ধ৷ কী কী সেই তিন প্রকার বন্ধন? ভৌতিক যার মানে ফিজিক্যাল (physical) বন্ধন, মানসিক বন্ধন, আধ্যাত্মিক বন্ধন৷

‘ভূত’ মানে যা পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক) অনুভব করা যায়৷ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম্,---এগুলিকে বলা হয় ভূত বা সাধারণভাবে পরিদৃশ্যমান পাঞ্চভৌতিক জগৎ৷

এখন আমাদের আলোচ্য বিষয়ে আসি৷ ভৌতিক বন্ধন মানে সহজ কথায় আমাদের বেঁচে থাকার জন্যে যে খাদ্য,বস্ত্র, গৃহ, ঔষধাদি স্থূল বস্তুর প্রয়োজন হয়, এগুলোর অভাব৷ এগুলো প্রয়োজনমত না পেলে মানুষের এগিয়ে চলার গতি রুদ্ধ হয়ে যায়৷ এই অভাব অনটন না থাকাই হল ভৌতিক বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া৷ সাধারণত অর্থ বা টাকা পয়সার দ্বারা এই সব প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করা যায় ও এই ধরনের অভাব মেটানো হয়৷ তাই অর্থ রোজগারের জন্যে সবাই উদ্যোগী হয়৷ বর্তমানে তাই অধিকাংশ মানুষই পড়াশুনা করে অর্থ রোজগার করবে,এটাই উদ্দেশ্য থাকে৷ অর্থ উপার্জনটাকেই তারা তাদের জীবনের লক্ষ্য হিসেবে মনে করেন৷ অর্থ উপার্জন করে স্থূল অভাব মেটানো যায় ঠিকই কিন্তু এর দ্বারা যথার্থ মানুষ হওয়া সম্ভব নয়৷ আজ সমাজের তথাকথিত উচ্চমহল থেকে সাধারণ স্তর পর্যন্ত যে অজস্র দুর্নীতি ও অপরাধ মূলক কাজ হচ্ছে, এসবের অতিক্ষুদ্র ভগ্ণাংশ অভাবের কারণে৷ টাকা পয়সা আছে কিন্তু মনটাই নোংরা আবর্জনায় ভর্ত্তি--- ‘আরও চাই আরও চাই’ ভাব, মনের মধ্যে সবসময় যেন একটা বাঘ লুকিয়ে আছে, যে সবসময় বলছে ‘‘ম্যায় ভূখা হুঁ,ম্যায় ভূখা হুঁ’’৷ উদ্দাম লোভ ও দুর্নীতিগ্রস্ত মন, মনের সংযম নেই--- এই সব সমস্যাই তো আজ সমাজটাকে ধবংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ তাহলে বুঝলে কেবল আর্থিক সমস্যার সমাধানটা বড় কথা নয়--- মনের যথার্থ বিকাশ ঘটাতে হবে, নৈতিক বিকাশ ঘটাতে হবে৷        (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)