‘‘পাপ ছাড়ে না বাপকে’’৷ বাঙলার বহু পুরোনো প্রবাদ৷ এবার সেই প্রবাদই সত্যি হতে চলেছে রাজ্য সিপিএমের নেতৃত্বের কাছে৷ আশির দশকের গোড়ায় করা নরহত্যার প্রায়শ্চিত্ত করার বাস্তব পরিস্থিতির সম্মুখে বঙ্গদেশের পক্ককেশী কমরেডরা ১৯৮২ সালের ৩০শে এপ্রিল বিজন সেতুতে যে ১৭ জন নিরপরাধ আনন্দমার্গীকে জীবন্ত দগ্ধ করে মেরেছিল তাঁরা৷ এবার সেই পাপ সুদে–আসলে মেটানোর সময় এসেছে৷ জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা সিপিএমের অসুর বাহিনীর নিধনের সময় ঘনিয়ে এসেছে৷ অবশ্যই সৌজন্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার৷ তাঁর শাসনকার্যের সময় গড়া বিচারপতি অমিতাভ লালার নেতৃত্বাধীন কমিশন এ বিষয়ে তদন্তের কাজে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন৷ সত্তরের দশকে কসবা–তিলজলা এলাকায় (বর্তমানে ইষ্টার্ণ মেট্রোপলিটন বাইপাস সংলগ্ণ এলাকা–য়)নিজেদের সমাজকল্যাণমূলক কাজের নিরিখে প্রভাব বিস্তার করেছিল আনন্দমার্গীরা৷ আশি–র দশকের শুরুতে সেই জনপ্রিয়তা ধীর গতিতে হলেও বেড়েছিল৷ তৎকালীন স্ট্যালিন–মাও–এর তত্ত্ব পড়ে ক্ষমতায় আসা কমুনিষ্ট শাসকদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বিরোধী কণ্ঠ যেন–তেন প্রকারে রোধ করা৷ সেই ভাবনা থেকেই সমাজ কল্যাণে ব্রতী আনন্দমার্গীরা রোষানলে পড়ে কাস্তে–হাতুড়ীর পার্টির৷ আনন্দমার্গীরা ‘ছেলেধরা’ এমন প্রচার করে সিপিএম হত্যাকাণ্ডকে যথাযথ বলেও প্রচারের কৌশল নিয়েছিল পার্টি৷ কারণ সেই সময়ে সাধারণ মানুষ আনন্দমার্গীদের কাজকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল৷ দলে দলে সাধারণ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন আনন্দমার্গীদের দলে৷ দিন মজুর থেকে কলেজ পড়ুয়া, চাকুরীজীবী থেকে বুদ্ধিজীবী – সেই সময়ে সকলে আনন্দমার্গীদের মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল৷ যেহেতু আনন্দমার্গীরা সমাজে শান্তি স্থাপনের কথা বলে তাই হিংসাত্মক মতাদর্শের চেয়ে সেটি অনেক বেশী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷ এমন শান্তির তত্ত্ব কোনওভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না সিপিএমের মত দলের পক্ষে৷ তাই আনন্দমার্গীদের মূল থেকে উপড়ে ফেলাই ছিল বাম সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য৷ চাইলে খুব সাধারণ ভাবে গুলি করে বা বোমা মেরেও খুন করা যেত আনন্দমার্গীদের কিন্তু বাম সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করা৷ সেই কারণেই ১৭ জন আনন্দমার্গীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ব্লু–প্রিণ্ঢ তৈরীর কাজ শুরু হয়৷ ১৯৮২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারীর পর থেকে আনন্দমার্গীদের নিশ্চিহ্ণ করার চূড়ান্ত রূপরেখা বাস্তবায়িত করেন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন দেবরা, এমনটি অভিযোগ৷ আনন্দমার্গীদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করতে নেমেছিলেন সিপিএমের নেতারা৷ রালি, মিটিং মিছিল শুরু করে আনন্দমার্গীদের ছেলেধরা প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টা চলেছিল৷ ১৯৮২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী পিকনিক পার্কে একটি কনভেনশন ডাকা হয়৷ সেই কনভেনশনে উপস্থিত থাকা বাম নেতারা জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছিলেন আনন্দমার্গীদের বিরুদ্ধে৷ সত্যসাধন চক্রবর্তী (সাংসদ), কান্তিগাঙ্গুলী (তৎকালীন কমিশনার যাদবপুর পুরসভা ও প্রাক্তন মন্ত্রী), সুজন চক্রবর্তী (তৎকালীন ছাত্রনেতা তথা প্রাক্তন সাংসদ), সন্তোষ মিত্র (সংসদ), ক্ষুদিরাম ভট্টাচার্য (বিধায়ক), গঙ্গাধর নস্কর (বিধায়ক), রবীনদেব (প্রাক্তন বিধায়ক), বিজনবিহারী পুরকায়স্থ, অধ্যাপক নির্মাল্য বাগচী, অধ্যাপক অবন্তীকুমার সান্যাল, অধ্যাপক রথীন্দ্র নারায়ণ বসু, রজত বন্দ্যোপাধ্যায়, মিহির চট্টোপাধ্যায় (নাট্যকার), আশুতোষ সেন (অ্যাড্ভোকেট), কবি অরুণ মিত্র, বাদল দাশগুপ্ত, সুনীল চক্রবর্ত্তী (চেয়ারম্যান যাদবপুরপুরসভা), বীরেন ঘোষ (ভাইস চেয়ারম্যান, যাদবপুর পুরসভা) প্রশান্ত দাশগুপ্ত (কমিশনার যাদবপুর পুরসভা), প্রণব সেন (কমিশনার যাদবপুর পুরসভা), অধ্যাপক রবি রায় সেইদিনের কনভেনশনে উপস্থিত ছিলেন৷ ঘটনার ঠিক একদিন আগে হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত ছক নিয়ে ২৯ এপ্রিল কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের পৌরোহিত্যে সন্তোষপুর লোকাল কমিটির সেক্রেটারি স্বপন চক্রবর্ত্তী ওরফে বাবলু, রামনাথ সিং, অর্জুন মুখোপাধ্যায়, গোপাল রায়, নির্মল হালদার সহ সিপিএমের বেশ কিছু কুখ্যাত কর্মীদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়৷ সেই মিটিংয়েই আনন্দমার্গীদের নিধনযজ্ঞের পরিকল্পনা পুরোপুরি তৈরি হয়ে যায়৷ ছক মেনে প্রথমে এলাকায় আনন্দমার্গীদের বিরুদ্ধে বারবার মিছিল করা শুরু হয়৷ পরিকল্পনা করা হয় যে, সিপিএমের ‘হার্মাদ’ বাহিনী তিন ভাগে ভাগ হয়ে তিন জায়গায় আনন্দমার্গীদের জন্যে অপেক্ষা করবে৷ বিজন সেতু, বালিগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন ও বালিগঞ্জ রেলওয়ের জিনিসপত্র রাখার জায়গায় তারা আনন্দমার্গীদের জন্যে অপেক্ষা করবে৷ তিনটি দলের নেতৃত্ব দেবে বাবলু, রামনাথ সিং ও নির্মল হালদার ও কুখ্যাত বাহিনী৷ যখনই আনন্দমার্গীরা তিলজলার আশ্রমের দিকে যাবে তখন তাদের পিটিয়ে ও জ্বালিয়ে খুন করা হবে৷ সেই জন্যে তিনটি দলের কাছে আগে থেকেই প্রচুর পরিমাণে জ্বালানিও মজুত রাখা হয়েছিল৷ সন্ন্যাসীরা বিজন সেতুর ওপরে আসতেই সিপিএম নেতা–কর্মীদের একটি দল তাঁদের ঘিরে ফেলে লাঠি, রড দিয়ে হামলা চালানো হয়৷ কার্যত চক্রব্যুহে আটকে পড়া সন্ন্যাসীরা সিপিএমের ওই উন্মত্ত দলের কাছে কাকুতি মিনতি করতে থাকেন৷ কিন্তু মৃত্যু নেশায় বুঁদ সশস্ত্র বাহিনীর প্রথমে রড ও লাঠির ঘায়ে অচেতন করে দেয় অবধূতদের৷ এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য এলাকায় জমায়েত করে থাকা সিপিএমের ক্যাডাররাও বিজন সেতুর ওপর ভিড় বাড়িয়ে সেই নৃশংসতাকে কয়েকগুণ বাড়াতে হাত লাগান৷ এরপর অচেতন অথচ জীবিত অবধূতদের একের পর এক গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় সিপিএমের কমরেডরা৷ সিপিএমের এক প্রাক্তন বিধায়ক একজন অবধূতকে গায়ে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে সেই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন৷ পরে ওই হার্মাদদের দল একের পর এক অর্ধদগ্ধ সন্ন্যাসীদের দেহ বালিগঞ্জ স্টেশনের রেল লাইনে ফেলে দিয়ে ‘হায়েনার হাসি হেসেছিলেন’৷ তৎকালীন ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রয়াত পুলিশকর্তা সদানন্দ চক্রবর্তী ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছিলেন, রেললাইনে পড়ে থাকা সন্ন্যাসীদের অর্ধদগ্ধ মৃতদেহের অবস্থা দেখে তা সরাতে রাজি হয়নি ডোমেরা৷ বাধ্য হয়ে পুলিশকেই দায়িত্ব নিয়ে মৃতদেহ সরানোর কাজ করতে হয়েছিল৷ ঘটনার পর পুলিশ তল্লাশি করে সুপ্রিয়া ব্রহ্মচারিণীর সোনার ঘড়ি ও চাদর উদ্ধার করে সিপিএম নেতা শম্ভু নস্ক্রের বাড়ি থেকে৷ যদি সিপিএম এই ঘটনায় যুক্ত না থাকত তাহলে সিপিএম নেতা শম্ভু নস্করের বাড়িতে আহত সন্ন্যাসিনীর জিনিসপত্র গেল কী করে? এমন প্রশ্ণ উঠেছিল তৎকালীন পুলিশ মহলেই৷ কিন্তু রাইটার্স বিল্ডিঙের চাপে ইচ্ছা সত্ত্বেও পুলিশকর্তারা বিষয়টি ধামাচাপা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ সিপিএমের নেতা–কর্মীরা যে এই ঘটনার সে৷ ওতপ্রোতভাবে যুক্ত তা আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে রাইটার্স বিল্ডিংস্ সকলেই জানতেন৷ তবুও বাম সরকার নিজের ক্ষমতার প্রয়োগ করে দোষীদের শাস্তির হাত থেকে আড়াল করে রেখেছিল৷ ১৭ জন আনন্দমার্গীকে হত্যার পরেও বারবার হামলা করা হয়েছে আনন্দমার্গের সন্ন্যাসীদের ওপর, এমন ঘটনারও নজির রয়েছে৷ প্রকাশ্য দিবালোকে কয়েক হাজার মানুষের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করে আনন্দমার্গীরা৷ তৎকালীন বাম সরকারের কাছে দাবি জানাতে থাকে, সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত বিচারপতিকে দিয়ে এই ঘটনার তদন্ত করতে হবে৷ তাদের দাবী মেনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেটি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির বদলে হাইকোর্টের বিচারপতিকে দিয়ে কমিশন গঠন করেছিল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু৷ যা ‘দেব কমিশন’ নামে পরিচিত ছিল৷ এই কমিশন কী তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছিল তা আজও কেউ জানে না৷ এছাড়া তিনটি থানাতে দায়ের করা হয় মোট পাঁচটি কেস্ঙ্গ শিয়ালদহ জিপিআরএস, কসবা থানা ও তিলজলা থানাতে দায়ের হয়েছিল এই কেসগুলি৷ ঘটনার পর আটক করা হয়েছিল ৬৮ জন সন্দেহভাজনকে৷ আসলে কোনও লাভই হয়নি তাতে৷ শুধুমাত্র জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল সন্দেহভাজনদের৷ সেই সময় বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া কেসগুলি কেন যথার্থ তদন্ত হল না সেটিরও সঠিক তদন্ত করা হোক৷ সেই সময় কেন পুলিশ অভিযুক্তদের হাতে পেয়েও ছেড়ে দিলেন? কেন ২৩ জন মূল অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ পেয়েও কোনও শাস্তি হল না তাদের? বাম সরকারের তরফ থেকে কোনও সাহায্য করা হয়নি তাদেরও৷ বাধ্য হয়ে ১৯৯৯ সালে আনন্দমার্গ সংস্থার তরফ থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়িকে পাঠানো হয় একটি চিঠি৷ ৬৬ পাতার সেই চিঠিতে নারকীয় সেই ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ দেওয়া হয় ও দাবি করা হয়েছিল এই ঘটনায় যথার্থ তদন্তের ৷ তবে এখন আনন্দমার্গীরা তাকিয়ে রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের তৈরি অমিতাভ লালার কমিশনের রিপোর্টের দিকে৷ যে বিচারপতিকে সিপিএমের সদ্য প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক বিমান বসু একসময় বলেছিলেন ‘লালা তুই বাংলা ছেড়ে পালা৷’ এখন দেখার বিষয়, লালা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলে কাদের বাংলা ছেড়ে পালাতে হয়৷
- Log in to post comments