খবরের কাগজহীন কয়েকটা দিন নিঃসঙ্গ কেটে গেল৷ কোভিড-১৯ এর কোপে শারদ উৎসবের আড়ম্বর অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়৷ তবু আড়ম্বর না থাকলেও আয়োজন তো ছিল৷ তাই কর্মীরা সবাই গৃহমুখে৷ কয়েকটা দিন পাশে এক গুরুভাই ছাড়া কেউ ছিল না৷
সকাল বেলায় প্রাত্যহিক সাধন ভজন শেষে হাতের কাছে খবরের কাগজ না পেয়ে মনটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগত৷ অথচ হাতের মুঠোয় ধরে থাকা যন্ত্রটার স্ক্রিন স্পর্শ করলেই চোখের সামনে দুনিয়ার খবর ভেসে ওঠে৷ তবু খবরের কাগজে চোখ না পড়লে মনের তৃপ্তি মেটে না৷ পাশের গুরু ভাইটি বলল --- দাদা এও এক প্রকার সংস্কার, বদ অভ্যাস, এর থেকে মুক্ত হওয়া উচিত৷ বিজ্ঞান কত এগিয়েছে, সামান্য আঙ্গুলের ছোঁয়ায় ছোট্ট স্ক্রিনটায় ভেসে ওঠে দুনিয়ার খবর৷ আর আপনি এখনও খবরের কাগজে পড়ে আছেন৷ দেখবেন কদিন পরেই এইসব খবরের কাগজ ব্যাকডেটেড হয়ে যাবে৷
বিজ্ঞান সত্যি এগিয়েছে! পর্বত কন্দর থেকে, অন্ধকারময় অরণ্যের পর্ণকুঠির থেকে আলো ঝলমল শহরের সুরম্য অট্টালিকায়, গরুর গাড়ির চাকা থেকে মহাকাশ যানে বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে সভ্যতা সংস্কৃতিকে পিছনে ফেলে৷ বিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের লোভ ক্ষুধানল৷ অতৃপ্ত বাসনা চরিতার্থ করতে মানুষ বেহিসাবীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে প্রকৃতির ওপর৷ বিষাক্ত হচ্ছে প্রকৃতির পরিবেশ৷ পৃথিবী মনুষ্য বাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে৷
গত চারশো বছরে বিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধেয়ে আসছে মারণ ব্যাধি বুবনিক প্লেগ থেকে কোভিড-১৯৷ বিজ্ঞানও হাঁপিয়ে ওঠে রোগ জর্জরিত মানুষকে নিরাময়ের পথ দেখাতে৷ প্লেগ, গুটি বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা, করোনা..... বিজ্ঞান জানে না এর শেষ কোথায়!
বিজ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতা রঙ পাল্টেছে, শোষক শোষনের ধারা পাল্টেছে, ধনীর আড়ম্বরের রূপ পাল্টেছে, মানুষের স্বার্থ-লোভ আরও বেশী ভয়ঙ্কর হয়েছে, সভ্যতা বিবর্ণ হয়েছে--- বিজ্ঞান এগিয়েছে!
খোলা আকাশের নীচে, বিস্তৃত আঙিনার মাঝে সবুজ বণাণী ঘেরা মৃত্তিকা নির্মিত গৃহের মানুষগুলো অনেক বেশী উদার ছিল, নির্মল মনের অধিকারী ছিল, অল্পে সন্তুষ্ট ছিল, আত্মীয়-পরিজন-প্রতিবেশী মিলে সবাই সবাকার সুখ-দুঃখের ভাগীদার ছিল৷
আজকের লোহার খাঁচায় মোড়া বহুতল ফ্ল্যাটের বাক্সবন্দী মানুষগুলো কী একটু বেশী স্বার্থপর হয়ে যায় নি৷ বিজ্ঞান যেমন আমাদের অঞ্জলি ভরে দিয়েছে তেমনি হৃদয় নিঃস্ব করে নিয়েছে৷ সেই নিঃস্ব হৃদয়ে আশ্রয় নিয়েছে আদিম হিংস্র পাশবিকতার অতৃপ্ত বৃত্তি৷ তারই প্রকোপে নির্ভয়া হাথরস...স্বার্থের সংঘাত৷ কোন আইন, কোন আদালত, কোন শাস্তি এই বৃত্তির প্রকোপ রোধ করতে পারে না পারবে না৷
তবে কী বিজ্ঞানের অগ্রগতি রুদ্ধ করে দিতে হবে? প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের দৃষ্টিতে---বিজ্ঞানের বিরোধিতা নয়, বিজ্ঞান এগিয়ে চলুক তার গবেষণাগারে, হৃদয়ের বিস্তার হোক মানুষের মনরাজ্যে৷ বিজ্ঞানের অগ্রগতির পাশাপাশি স্নেহপ্রেম প্রীতিপূর্ণ নির্মল মনের উদার হৃদয়ের মানুষ চাই৷ তার জন্য চাই সভ্যতার আঁতুড় ঘর প্রাচীন ভারতের অন্ধকারময় অরণ্যের তপবনের সেই সাধনা৷ অর্থাৎ বিজ্ঞানের গবেষণার পাশাপাশি আধ্যাত্মিকতার চর্র্চ, আধ্যাত্মিক অনুশীলন সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, নতুবা বিজ্ঞান মানুষের জীবনে চরম অভিশাপ বয়ে আনবে৷
লীলা মজুমদারের একটি গল্পের শেষ কথা ছিল--- ‘‘বন থেকে জানোয়ার তুলে আনা যায়, কিন্তু জানোয়ারের মন থেকে বনকে তুলে ফেলা যায় না৷’’ আধুনিক বিজ্ঞান অন্ধকারময় অরণ্যের পর্ণকুঠির থেকে আমাদের তুলে এনেছে আলো ঝলমল শহরের সুরম্য অট্টালিকায়, সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে তপবনের সেই সাধনা৷ বিজ্ঞানের সৌজন্যে গৃহ প্রাঙ্গণে আড়ম্বরে সাজসজ্জা বেড়েছে কিন্তু মনরাজ্যে মানুষ হয়ে গেছে অনেক সংকীর্ণ, স্বার্থপর৷ আজকের নির্ভয়া হাথরসের মতো পাশবিক ঘটনা ও মানুষের নানা মানসিক ব্যাধির মূল কারণ এটাই৷ তাই বিজ্ঞান এগিয়ে চলুক, কিন্তু আমাদের মনে তপবনের সেই সাধনা আবার ফিরে আসুক৷ বিজ্ঞানের চর্চা ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন দুইয়ের সমন্বয়েই সভ্যতা বাঁচবে, সংস্কৃতি বাঁচবে, সমাজের শূচিতা বজায় থাকবে৷
- Log in to post comments