প্রাচীন সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারে বছরে ছ’টা ঋতুর উল্লেখ আছে৷ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত৷ কিন্তু ভারতের অনেক স্থানে, বিশেষ করে সমুদ্রের তটবর্তী এলাকায় তথা পূর্ব ভারতে মূলতঃ চারটে ঋতু৷ সেগুলি হচ্ছে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত৷ ক্ষাঙলায় শীত ঋতু শেষ হতে না হতেই গরম শুরু হয়ে যায়৷ তাই বসন্ত ঋতু এখানে পনেরো দিনের জন্যেও স্থায়ী হয় না, আর হেমন্ত তো শীতেরই অঙ্গ৷
মানুষ যখন নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করে তখন সে তার জন্যে উপযুক্ত সময় বেছে নেয়৷ শীতকালে ক্ষাঙলায় ‘আমন’ ধান কাটা হয়, আগের থেকে অর্থাৎ শরৎকালেই সবাই জানতে পারেন যে এ বছর আমন ধানের ফসল কেমন হবে৷ এখানে স্মরণীয় যে ক্ষাঙলায় ধানই ছিল মুখ্য ফসল, গম বা রবিশষ্য হত কম৷ প্রকৃতিও তখন নিজের উপযুক্ত সাজে সেজে ওঠে, নদীতে জল ভরে যায়, কাশ–শিউলি ইত্যাদি নানান ফুল ফুটে ওঠে৷ এ ফুলগুলি ক্ষাঙলার প্রাচীন ফুল, যেমন বটগাছও ক্ষাঙলার নিজের৷ ক্ষাঙলাই এ সবের মূল নিবাস৷ তাই, প্রকৃতি যেন নানান ফুলের ডালি সাজিয়ে মানুষের আরতি করে আর বলে এটাই তোমার সবচেয়ে ভালো সময়৷
মানুষের সংগ্রাম সার্বভৌমিক, অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সংগ্রাম করে তাকে এগিয়ে যেতে হয়৷ বলাবাহুল্য, পরমপুরুষ মানুষকে সবসময় প্রাণরস তথা প্রাণশক্তি জুগিয়ে চলেন৷ যদিও সাংখ্য দর্শনের বহু ‘পুরুষ’ বা ‘জন্য ঈশ্বর’ এমনটা নন, তিনি নিষ্ক্রিয় সাক্ষী–সত্তা মাত্র, আর মানুষের কাছে সেই ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজনও নেই৷ আসলে কিন্তু পরমপুরুষ বা পুরুষোত্তোমের কাছ থেকেই মানুষ সর্বাত্মক সংগ্রামের প্রেরণা পায়৷
মানুষ প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির ওপর নিজেকে অধিষ্ঠিত করার জন্যে সংগ্রাম করে৷ একেই বলে জয়, আর এই জয় যখন স্থায়ী হয়ে যায় তখন বলব বিজয়৷ বিজয়া দশমীর এই যে উৎসব এটা ‘বিজয়োৎসব’৷ উৎসব শব্দের ব্যুৎপত্তি হচ্ছে–উৎ–সুূল্৷ ‘সু’ ধাতুর সঙ্গে ‘অল্’ প্রত্যয় লাগলে হয়ে যায় ‘সব’ যার অর্থ জন্মগ্রহণ করা, আর ‘উৎ’ মানে উচ্ছ্বলিত হয়ে ওঠা অর্থাৎ মানুষ যখন নেচে নেচে প্রাণের উচ্ছ্বলতা দিয়ে নোতুন জীবনের আস্বাদন গ্রহণ করে তখন তাকে ‘উৎসব’ বলে৷
এখন আমরা গভীরভাবে দেখলে, এই উৎসবকে আমরা বিজয়োৎসবের মহড়া বলতে পারি, বিজয়োৎসব নয়৷ বিজয়োৎসবের প্রতীক্ষায় আমরা অসহ্য ব্যগ্রতা নিয়ে বসে আছি৷ সমগ্র পীড়িত মানবাত্মা গভীর আগ্রহ সহকারে অপেক্ষা করছে, কবে তাদের সামূহিক জীবনের বিজয়োৎসব পালিত হবে৷ আমরা তো প্রতি বছর কেবল এর মহড়া দেখছি৷
মানুষের শত্রু কে? কার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এই বিজয়োৎসব পালন করা হবে? মানুষের নিজের মনের ভেতর অষ্টপাশ ও ষড়রিপু আছে৷ এই ভেতরের শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্যে মানুষকে সারা জীবন আধ্যাত্মিক সাধনা করে যেতে হবে৷ এই হ’ল মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম৷ মানুষ যেদিন সাধনায় সিদ্ধ হবে সেদিনই হবে তার মানস–আধ্যাত্মিক জগতে বিজয়োৎসব৷
কিন্তু মানুষ সমাজবদ্ধ জীব৷ যে মানুষ অন্য মানুষের সঙ্গ চায় না, সে মানুষ নয়৷ মানুষ মানুষের মধ্যে থেকেই তার সেবা করবে, কল্যাণ করবে, মিলেমিশে বড় বড় কাজ করবে, এটাই যথোচিত৷ সামাজিক জীবনে সে–ই মানুষের শত্রু যে তার শান্তির নীড়ে আগুন লাগাতে চায়, যে তার ঘর ভাঙতে চায়, যে মানুষকে ক্ষুধা–তৃষ্ণায় রেখে, পীড়া দিয়ে, লাঞ্ছনা দিয়ে পশু স্তরে নাবিয়ে আনতে চায়, তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে৷ যে নিয়ম বা দুর্নিয়মের ফলে এই সমাজ বিরোধীরা উৎসাহ পায়, সেই সব নিয়ম–নীতিও মানুষের শত্রু৷
তাই, যথার্থ বিজয়োৎসব মানুষ সেদিনই পালন করবে যখন মানুষের এই সামাজিক শত্রুর পতন হবে, আর এই শক্তির মুখ দিয়ে যেদিন আর কোনো আবাজ বেরুবে না৷ সেইজন্যে এই বিজয়োৎসবকে আমি বিজয়োৎসবের মহড়া বলছি৷ এই বিজয়োৎসবে তোমরা ব্যষ্টিগত ভাবে অর্থাৎ মনে মনে আর সমষ্টিগত ভাবে অর্থাৎ জোরে জোরে এই বলে ব্রত নাও যে, যারা মানবতার শত্রু তার বিরুদ্ধে সীমাহীন সংগ্রাম চালিয়ে একদিন আমরা বাস্তবিকই বিজয়োৎসব পালন করব৷ বিজয়োৎসবের মহড়া তো অনেকদিন থেকে দেখে আসছি, এখন প্রকৃত বিজয়োৎসব পালন করা দরকার৷ (বিজয়া দশমী, ১৯৮০, কলকাতা)