বিকেন্দ্রীত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই গণতান্ত্রিক অর্থনীতির সার্থক রূপ

লেখক
প্রবীর সরকার

দেশ পরিচালনা করা যদি সহজ হতো তাহলে কথাই ছিল না৷ সুগৃহকর্তা বা কর্ত্রী যদি না হয় তাহলে সে গৃহের কল্যাণ ও উন্নতি হয় না৷ ঠিক তেমনই রাষ্ট্রের প্রধান যদি সুশাসক না হয় তা হলে সেই রাষ্ট্র কখনোই উন্নতি করতে পারে না৷ আজ মনে পড়ে সেই অতীতের সুলতানী যুগের কথা৷ ভারত সম্রাট নাসিরুদ্দীনের বেগম রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেন তখন সম্রাটকে বেগম একজন দাসী রাখার প্রার্থনা জানান৷ তিনি কোরাণ নকল করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তাই তাঁর পক্ষে দাসী রাখা সম্ভব নয় বলে বেগমকে জানান৷ আর রাষ্ট্রের কোষাগারের অর্থ প্রজাদের৷ সেই অর্থ অযথা ব্যয় কারর অধিকার তাঁর নেই৷ এই বোধ যদি শাসকদের না থাকে তাহলে তো তাঁরা ধার করেই শাসন পরিচালনা করবেন৷ তাই তো বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শাসকগণ ঋণের পাহাড় করে বসেছেন৷ যেমন আয় তেমন ব্যয় করাটাই কাম্য৷ এই সমস্যা সংকুল পশ্চিম বঙ্গে বিগত বাম সরকার কয়েক লক্ষ হাজার কোটি টাকা ঋণ রেখে গেছেন তার সুদ মেটাতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে৷ তা হলে বর্তমান সরকার রাজ্যের খরচ চালাবেন কি ভাবে? এই দশা বর্ত্তমান কেন্দ্র সরকারেরও হয়েছে৷ কেন্দ্র সরকার ঋণ ভারে জর্জরিত৷ শুধু নানা ধরণের কর হতভাগ্য জনগণের ওপর চাপিয়ে তো আর অত্যধিক ব্যয় নিটীহ করা সম্ভব নয়৷ তাই আয়ের পথ খুঁজতে হবে আর ব্যয় সংকোচ করতে হবে সরকারকে৷ এদেশের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার শুধু সরকারী কর্মচারী ও প্রশাসনে যুক্তদের কথাই ভাবেন৷

ভারত মূলতঃ কৃষি প্রধান দেশ৷ তাই ব্যাপক কৃষির উন্নতি করা কৃষি ভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক শিল্প গড়ে তুলে আয়ের উৎস বাড়াতে হবে৷ দেশের খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ চিন্তা করে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে খরচ করতে হবে ৷ বাহিরের দেশে কাঁচা মাল বিক্রি  অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷

উৎপাদন ও বন্টনে অবশ্যই নিয়ন্ত্রন আনতে হবে ও যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ রেশনিং ব্যবস্থায় আনতে হবে শৃঙ্খলা৷ প্রতিটি কর্মক্ষম মানুষ যাতে কর্ম করার সুযোগ পায় ও প্রত্যেকের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে সেদিকে আন্তরিক দৃষ্টি রাখতে হবে৷ বেকার সমস্যার সমাধান করতে হবে তৃণমূল স্তর হতে৷ প্রতিটি ব্লককে স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে সমবায়ের মাধ্যমে৷ তবেই গণতন্ত্রের সার্থকতা৷ দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র ধনী ব্যবসায়ীদের অঙ্গুলি হেলনে চলে৷ নির্বাচনে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করতে হয়৷ আর সেই টাকার যোগান দেন ওই ধনীরা৷ তাই শাসকদের লক্ষ্য থাকে কিভাবে সেই ভাগ্যবিধাতাদের সন্তুষ্ট রাখা যায়৷ তাই ধনীর শ্রীবৃদ্ধি যাতে হয় সরকারের ষোল আনা সেই দিকেই নজর৷ দেশের শতকরা ৭০ শতাংশ মানুষ প্রায় দারিদ্র্য সীমার নীচেই বাস করে৷ নিম্ন মধ্য বিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অবস্থা শোচনীয়৷ কারণ তাদের সামাজিকতা রক্ষা করতে প্রাণান্ত৷ মাঝে পড়ে তারা চিড়ে চেপ্ঢা হচ্ছে৷ এমন শাসন ব্যবস্থা চলছে যার দরুণ রাষ্ট্রে বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই৷ নোতুন কর্মদ্যোগ নেই৷ অধিকাংশ ছোট বড়ো কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নানা কারণে৷ অর্থের বিনিময় মূল্য এতটাই কমে গেছে যা কহতব্য নয়৷ তাই দারুণ মুদ্রাস্ফীতির কারণে কম আয়ের মানুষ জন একেবারে দিশে হারা৷

ভারতে প্রায় ১১৬৫২১টি পঞ্চায়েৎ আছে৷ তাই পঞ্চায়েৎ রাজ যেখানে চলছে, সেই রাষ্ট্রে প্রতিটি পঞ্চায়েৎকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে গড়ে তোলার চেষ্টাটা আর কবে হবে? প্রতিটি পঞ্চায়েৎকে যদি সব দিক হতে উন্নত করা হয় তাহলে সেই পঞ্চায়েতের লোকজন ভালোভাবে রুজিরোজগার করতে সক্ষম হবে৷ কিন্তু ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় শোষণের মাত্রা অত্যধিক তাই পঞ্চায়েৎগুলি সচ্ছল হতে পারেনি৷ ভাগ্যান্বেষনে মানুষকে গ্রাম ছেড়ে শহর ও নগরের দিকে পাড়ি দিতে হয়৷ ফলে লোক গ্রাম ত্যাগ করে নগর ও শহরে এসে ভীড় করে ফলে আর্থিক সামাজিক দিক হতে প্রচন্ড চাপ পড়ে শহর এলাকায়৷ পরিবেশ প্রচন্ড ভাবে দূষিত হয়৷ জনসংখ্যার চাপে স্বাস্থ্যহানি ঘটে৷ চরম সমস্যায় পড়ে এলাকাগুলি৷

তাই বিকেন্দ্রিত ভাবে সন্তুলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পরিকল্পনার আমূল পরিবর্ত্তন দরকার৷ সমাজতান্ত্রিক বাঁচে তাই ছোট ছোট কুটির শিল্প গড়ে তুলে ভারতের আর্থিক ও সামাজিক চিত্রটির পরিবর্তন ঘটাতে হবে৷ নিজের গ্রাম বা পঞ্চায়েতে বসে যদি অধিকাংশ লোক জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে পারে তা হলে তাদের অনেক দিক হতে সুবিধা হবে৷ আয় তুলনামূলক ভাবে কম হলেও অসুবিধাটা হবে না কারণ ব্যয় কম হবে৷ বাড়িতে বসেই অধিকাংশ ব্যষ্টি রোজগার করতে পারবে ও পরিবারকে সেবা দিতে সক্ষম হবে৷ গ্রামগুলি উন্নত হবে৷ শিল্পের একদেশীকরণটা ক্ষতিকারক৷ তাতে শোষণের মাত্রা বাড়ে জীবনের নিরাপত্তা কমে যায়৷ মানুষকে বোঝাতে হবে যে গ্রামের সার্বিক উন্নতিই হলো সমগ্র দেশের উন্নতি৷ শুধু কয়েকটি শহর বা নগরকে কেন্দ্র করে আর্থিক উন্নতি ঘটানো সেটা– সেই শরীরকে বঞ্চিত করে মুখে রক্ত সঞ্চালন করার মতোই ব্যর্থ প্রচেষ্টা– যাতে স্বাস্থ্যের উন্নতি না হয়ে রোগের বিকাশ ঘটে মাত্র৷ এতে দেশ দুর্বল হয় শোষণের মাত্রা বাড়ে, লক্ষ লক্ষ মানুষ বঞ্চিত হয় আর কিছু লোভী মানুষের উদর পূরণ হয় মাত্র৷ তাই গ্রামকে অর্থাৎ পঞ্চায়েতগুলিকে সব দিক হতে মাথা তুলে দাঁড়াবার পরিকল্পনা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার নিক৷

আর্থিক উন্নয়নে সমবায়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে কারণ গণতন্ত্রের সার্থকতা হলো আর্থিক বিকাশ ঘটানোতে গ্রাম বা পঞ্চায়েতগুলির উন্নয়ন করায়৷ এই কাজে সরকারকে গ্রাম বা পঞ্চায়েতের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করে যেতে হবে৷ গ্রামের জমি স্থানীয় লোকের হাতে থাকবে বাহিরের লোক যেন টাকার লোভ দেখিয়ে তাদের জমির অধিকার হতে বঞ্চিত না করে৷ তাহলে সেই অতীতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনে যেমন নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে গ্রামের চাষী সর্বস্বান্ত হয়েছিল ও শোষিত হয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল একদিন তেমনটাই যে ঘটতে পারে তাতে সন্দেহ নেই৷

মোদ্দা কথা হলো এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র জনগণকে সেবা দিতে ব্যর্থ৷ তাই গণতন্ত্রের স্বার্থে আজ জনগণের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে৷