বিশ্ব পরিবেশ প্রসঙ্গে ভিন্ন চিন্তা

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

বিশ্ব পরিবেশ দিবস---কাজটা মহৎ, কিন্তু উদ্দেশ্য কতটা মহৎ, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়৷ এত দিবস পালনের হুড়োহুড়ি--- পরিবেশ দিবস, মাতৃদিবস, পিতৃদিবস....দিবসের ছড়াছড়ি৷ কিন্তু লাভের লাভ হচ্ছেটা কি! সত্যি বলতে কি নানা দিবস পালনের উদ্দেশ্য ও মাহাত্ম্য বোঝাতে যে সব যুক্তির অবতারণা করা হয় তাকে তো অস্বীকার করার উপায় নেই৷ পৃথিবীর পরিবেশ দিন দিন মনুষ্য বাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে, একথা স্বীকার না করে উপায় নেই৷ বিজ্ঞান যেমন অঞ্জলি ভরে দিচ্ছে, তেমনি হৃদয় নিঙড়ে নিয়েও নিচ্ছে৷ কিন্তু মানুষকে সচেতন করতে একটি বিশেষ দিনে কয়েকটা গাছ লাগিয়েই কর্ম যজ্ঞ শেষ! ভারতের মত শিক্ষায় অনগ্রসর দেশে এক দিন কোন বিষয়ে একটা দিবস পালন করে কি মানুষকে সামাজিক,স্বাস্থ্য পরিবেশ বিষয়ে সচেতন করা সম্ভব! মানুষের সীমাহীন লোভ সংযত করতে না পারলে পরিবেশ দুষন থেকে প্রকৃতিকে রক্ষা করা সম্ভব নয়৷

প্রকৃতির পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ জঙ্গল ধবংস৷ মানুষের বেঁচে থাকতে যে অক্সিজেনের প্রয়োজন তা মূলত গাছই সরবরাহ করে৷ মানুষের জীবন ধারণের জন্যে ও সুস্থভাবে বাঁচার জন্য আরও যা প্রয়োজন তাও প্রতক্ষ ও পরোক্ষভাবে উদ্ভিদ জগতের ওপর নির্ভরশীল৷ তাই ‘গাছ লাগাও প্রাণ বাঁচাও’, ‘একটি গাছ একটি প্রাণ, ‘এ সব স্লোগান সহজেই মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়৷ কিন্তু বনসর্জন না  করে স্লোগান সর্বস্ব উদ্যোগ নিরর্থক হলেও উদ্দেশ্যহীন নয়৷

সমাজ সচেতন প্রতিটি মানুষ, যাঁরা রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেন তাঁদের মানতেই হবে যে রাষ্ট্রসংঘ থেকে পঞ্চায়েত প্রধান  সবটাই কর্র্পেরেট দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণে৷ যেখানে লাভের ষোলআনা হিসাব না করে এক পয়সা ব্যয় করা হয় না৷ এই যে এত দিবস নিয়ে একদল মানুষকে মাতিয়ে রাখা এটাও কর্র্পেরেট জগতের কূট কৌশল ছাড়া কিছু নয়৷

মহান দার্শনিক পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর রচিত একটি প্রভাত সঙ্গীতে উদাত্ত কন্ঠে বলেছেন, ‘‘মানুষ যেন মানুষের তরে সব কিছু করে যায়, একথাও যেন মনে রাখে পশুপাখি তারপর নয়, তরুও বাঁচিতে চায়’’৷ এদের সবাইকে নিয়ে আমাদের পরিবেশ৷ আর মানুষ এদের বড় ভাই৷ তাই শুধু মানুষ নয়, উদ্ভিদ, পশু, পাখী তরুলতা ও জড় জগতের  অস্তিত্ব রক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব মানুষকে  নিতে হবে৷

সেই মানুষের মনই  আজ দূষণের হাজার  ভাইরাসে  আক্রান্ত৷ সীমাহীন লোভ, হিংসা-বিদ্বেষ, বিভেদের রাজনীতি, ধর্মের নামে ব্যাভিচার, সংস্কৃতির অঙ্গনে বেলেল্লাপনা, শিক্ষার  অঙ্গনে অসংযত আচরণ---সমাজের সর্বস্তরে দূষণ৷ শুধু প্রাকৃতিক  পরিবেশ নয়, মানুষের মন, শরীর সব দূষণ-জর্জরিত৷ এই দূষণই কর্র্পেরেট জগতের শোষণের হাতিয়ার৷ আরও স্পষ্ট করে বললে এই দূষণ কর্র্পেরেট জগতের  তৈরী৷ মানুষকে নানা প্রলোভনে, নানা সংঘাতে মত্ত রেখে সীমাহীন শোষণের  পথ পরিষ্কার রাখা যার উদ্দেশ্য৷ তাই  জল, বায়ু, ধর্ম, অর্থ রাজনীতি শিল্প,শিক্ষা সর্বস্তরে মানুষকে  অমানুষ করার উপকরণে ভরে দেওয়া হয়েছে৷

তবুও সমাজে কিছু মানুষ থাকে যারা প্রলোভনে পা না দিয়ে, অসংযমী উশৃঙ্খলতায় না মেতে একটু ভদ্র জীবন যাপন করতে চায়, তারা যাতে অসতর্ক মুহূর্তে সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা না করে,  মুখ না খোলে, তাদের জন্যে ভদ্রলোকের ব্যবস্থা আজ অমুক দিবস, কাল তমুক দিবস, নানা অছিলায় মাতিয়ে রাখা৷ যাতে সমাজের আসল সমস্যা নিয়ে মাথা না ঘামায়৷

পরিবেশ রক্ষার জন্যে যে চেতনার প্রয়োজন, মানুষকে মানুষ করে গড়ে তোলার জন্যে যে সাধনার দরকার, যে শিক্ষার প্রয়োজন, সেটা বিশেষ একটা দিবস পালন করলেই হবে! এই  সব বিশেষ দিনে বিশেষ দিবস পালনের  উদ্দেশ্য রাজনীতির নোংরা খেলায় যাদের নাবানো যায়না, ধর্মের নামে সুড়সুড়ি দিয়ে যাদের উস্কান যায় না, সংস্কৃতির নামে বেলেল্লাপনা যাদের পছন্দ নয়, শাসক শোষকের অপকৌশল থেকে তাদের দূরে রাখার ব্যবস্থা এই দিবস পালন৷

পরিবেশ, সমাজ স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার শিক্ষা শিশু বয়স থেকেই দেওয়া দরকার৷ তাই বিশেষ একটি দিবস নয়, পাঠ্য পুস্তকে তালিকা ভুক্ত করে শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে৷ যাতে একটি শিশু শিশুকাল থেকেই স্বচ্ছ বুদ্ধি, স্বচ্ছ চিন্তার মধ্য দিয়ে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে৷ তখন কোন প্রধানমন্ত্রীকে স্বচ্ছ দেশ গড়ার জন্যে ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নাবতে হবে না৷

কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি স্বচ্ছ চিন্তা, স্বচ্ছ বুদ্ধির মানুষ হয়ে যায়, তাহলে কর্র্পেরেট শোষক ও তাদের অর্থ পুষ্ট পলিটিক্যাল পার্টির কী অবস্থা হবে! তাই যুক্তির  জালে যতই প্রয়োজন হোক---যাদের বিভেদের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, সংস্কৃতির নামে বেলেল্লাপনায় সামিল করা যাবে না তাদের শাসক ও শোষক থেকে  নিরাপদ দূরে রাখতে এই দিবস পালনের ছড়াছড়ি৷ এর অন্য কোন সার্থকতা নেই৷