বিশ্বমানবতার মহামিলন যজ্ঞের আর এক নাম--- যোগ

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

২১শে জুনকে রাষ্ট্রসংঘ যোগদিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে৷ শিক্ষক দিবস, নারীদিবস, মাতৃদিবস, শ্রমিক দিবস, পরিবেশ দিবস এইভাবে রাষ্ট্রসংঘ থেকে বিভিন্ন দিবস ঘোষণা  করা হয়---সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সর্ব সাধারণকে সচেতন করে তোলার জন্যে৷ তেমনি  ‘‘যোগের’’ মহত্ত্ব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলার উদ্দেশ্যে যোগ দিবস ঘোষণা করা হয়েছে৷  শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার জন্যে যোগের অসাধারণ গুরুত্বের কথা জাত-পাত সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবাই বর্তমানে স্বীকার করেন৷ যোগাসন  ও কিছু কিছু প্রাণায়মের দ্বারা বিভিন্ন রোগ নিরাময় যে সম্ভব তা চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন৷ তাই রাষ্ট্র সংঘের উদ্যোগে দেশে এদিন যোগ সচেতনতার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে এই ধরণের অনুষ্ঠান করা হয়৷ ভারতে তো সরকারী ভাবেই যোগাসন প্রদর্শণের বিশাল বিশাল  অনুষ্ঠান করা হয়--- তাতে প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী  ও আধিকারিকরাও অংশ গ্রহণ করেন৷

কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করার , তা হ’ল এই সমস্ত অনুষ্ঠানে যোগাসন ও কিছু কিছু প্রাণায়ামের মাধ্যমে বিশেষ করে শরীরকে সুস্থ রাখা বা রোগ নিরাময়ের দিকটাই তুলে ধরা হয়৷ আর , যা প্রদর্শন করা হয়, তা হ’ল যোগাসনের মাধ্যমে  জিমনাস্টিক্স্-এর মতো  বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ৷

 

কিন্তু মানবসমাজের যোগের ভূমিকা এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি৷ প্রকৃত পক্ষে যোগের সুমহান ভূমিকা রয়েছে, যা বর্তমানকালে যোগের এই সব উদ্যোক্তারা অবহিত নন৷

আজ যে দেশজুড়ে চরম নৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, এই সংকট নিরসনের পথ  একমাত্র যোগই দেখাতে পারে৷  সঙ্গে সঙ্গে যোগ হ’ল  আধ্যাত্মিকতার নির্যাস৷ আজ সারাদেশ জুড়ে, শুধু দেশ কেন, সারা বিশ্বজুড়ে, যে ধর্মমতে ধর্মমতে ঘৃণা-বিদ্বেষ- লড়াই চলেছে , এই লড়াই-এর  অবসান ঘটিয়ে মানুষদের এক মানব-ধর্মের পতাকা তলে নিয়ে আসতে পারে এই যোগ--- যা  অবশ্যই কেবল যোগাসন বা প্রাণায়াম নয়--- পূর্ণযোগ----অষ্টাঙ্গিক যোগ৷ অষ্টাঙ্গিক যোগ মানে বোঝায়  যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার ধারণা, ধ্যান সমাধি--- এই অষ্ট অঙ্গ যুক্ত যোগসাধনা৷

যোগীশ্বর শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী এই পূর্র্ণঙ্গ যোগ সাধনাকে  সম্প্রদায়ের গণ্ডি থেকে মুক্ত করে সম্পূর্ণ যুক্তি ও বিজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ও তিনি  তাঁর শিষ্যদের এই সার্বভৌম যোগসাধনাকে তথাকথিত জাতি-ধর্মমত স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের কল্যাণে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন৷ বিশ্বের ১৮২ টি দেশে আনন্দমার্গের প্রচারকগণ এই যোগসাধনা প্রচার করছেন ও সেই সমস্ত দেশের মানুষেরা এই অষ্টাঙ্গিক যোগকে জীবনের অত্যাবশ্যক অঙ্গ হিসেবে  গ্রহণ করেছেন৷ বলা বাহুল্য, আমরা যে বিভিন্ন সংকীর্ণ  ধর্মমতের গোঁড়ামি মুক্ত উদার-বিশ্বজনীন এক মানবধর্মের তথা সর্বপ্রকার সঙ্কীর্ণতা ও কুসংস্কারমুক্ত আধ্যাত্মিকতার কথা বলি, তা এই অষ্টাঙ্গিক যোগের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ও হচ্ছেও৷

তাই যোগ প্রকৃতপক্ষে শরীর, মন ও আত্মার বিকাশের বিজ্ঞান  তথা  নিঃসন্দেহে মানবধর্মের নির্যাস৷ এই যোগই একদিকে যেমন মানুষকে চরম নৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারে,  তেমনি মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটিয়ে এক বিশ্বভ্রাতৃত্বের সূত্রে মানবসমাজকে ঐক্যবদ্ধও করতে পারে৷

বিভিন্ন বিভেদ সৃষ্টিকারী ধর্মমতগুলি স্রেফ অন্ধবিশ্বাসের ও পর প্রতিষ্ঠিত৷ তাই ওই সব ক্ষেত্রে বিভিন্ন সেন্টিমেন্টের লড়াইটাই প্রধান ভূমিকা নেয় ৷

যোগ কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল অর্থাৎ  অনুশীলনগত৷ বিধিমতো অভ্যাস করলে যে কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ তার উপকারিতা সমানভাবেই পায়৷ রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে হোক,  শারীরিক সুস্থতা বিধানের ক্ষেত্রে হোক, মানসিক একাগ্রতা ও শান্তিলাভের ক্ষেত্রে  হোক বা  সূক্ষ্ম থেকে

সূক্ষ্মতর   আনন্দানুভূতির ক্ষেত্রে হোক বা মানসিক বিস্তার লাভের ক্ষেত্রে হোক---সর্বক্ষেত্রেই অভ্যাসকারীদের অনুভূতিও  একই৷ কারণ এটা জৈব  মনোবিজ্ঞান ৷ যোগাভ্যাসের  মাধ্যমে  অনু চৈতন্যকে ভূমাচৈতন্যে মিলিয়ে দেওয়ার  অনুভূতির ক্ষেত্রেও ব্যষ্টিতে ব্যষ্টিতে  কোনও পার্থক্য  নেই৷ তাই মানুষকে এক মানব ধর্মে প্রতিষ্ঠিত করবার মাধ্যম একমাত্র ‘‘যোগ’’ ৷

সর্বদেশের সর্বকালের উচ্চস্তরের সাধকদের অনুভূতিও এক৷ সেখানে কোনও পার্থক্য নেই৷ পার্থক্য এসেছে  পরে --- এর সঙ্গে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন  দেশ-কাল গত পার্থক্যজনিত সেন্টিমেন্ট  যুক্ত হয়ে নানান ভেদ-বিভেদের বেড়াজাল সৃষ্টি করে৷

বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য--- এই   হ’ল বর্তমান যুগের মানবিক অনুভূতি৷ যোগানুশীলন মানুষকে সেই সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক অনুভূতি দিয়ে মানব ঐক্যের ভিত্কে  সুদৃঢ় করবে৷

এক কথায়, যোগ মানুষের শরীরকে সুস্থ রাখবে, মনের মধ্যে দুর্বার মনঃশক্তির জাগরণ ঘটাতে পারবে৷ যোগানুশীলনের মাধ্যমে  মানুষের নৈতিক শক্তিও  বৃদ্ধি পাবে, মানুষ আধ্যাত্মিক অনুভূতি লাভ করে জীবনে প্রকৃত শান্তির পথ খুঁজে পাবে৷ যোগের মাধ্যমে মানুষ পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়ে জীবনের পূর্ণত্ব অর্জন করতে পারবে৷ তাই যোগ হল  মানব জীবনের আদর্শ জীবনচর্যা৷ সঙ্গে সঙ্গে যোগ হল বিশ্বমানব ঐক্যের মাধ্যম--- নব্যমানবতাবাদের ভিত্তি৷

তাই যোগ প্রকৃত পক্ষে অপূর্ণতার সঙ্গে পূর্ণতার যোগ৷ যোগ মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগ, বিশ্বমানবতার  মহামিলনযজ্ঞেরই আর এক নাম ‘‘যোগ’’৷