নারী কল্যাণ ঃ সমাজে নারীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, একান্তই দুর্বিসহ৷ সংঘের যারা ‘তাত্ত্বিক’, তাদের কর্ত্তব্য হ’ল অনগ্রসর মহিলাদের মধ্যে কল্যাণমূলক কাজ করা, তাদের কুসংস্কার–নিরক্ষর দূর করা, ধর্মচক্রের বন্দোবস্ত করা ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা৷ দেখা যায়, স্বামীর মৃত্যুর পর নারীরা আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হন৷ তাই তাঁরা যাতে স্বাধীনভাবে জীবিকার্জন করতে পারেন সে ধরণের সুযোগ তৈরী করতে হবে৷
যৌতুক প্রথার পিছনে কেবল কুসংস্কারই নয়, অর্থনৈতিক কারণও আছে৷ শুধু বত্তৃণতা দিয়ে বা কুসংস্কার দূর করে দিলেই এই জটিল সমস্যার সমাধান হবে না যদি অর্থনৈতিক কারণটা দূর করা না হয়৷ মেয়ের চেয়ে ছেলের গুরুত্ব বেশী কারণ ছেলেকে সমাজে মূল্যবান সম্পদ বলে গণ্য করা হয় আর মেয়েকে মনে করা হয় বোঝা৷ যৌতুক প্রথার অবসান কেবল তখনই হবে যখন মেয়েরা সমাজে জীবিকা অর্জনের স্বাধীন সুযোগ পাবে৷
আনন্দমার্গের সামাজিক আইন মানুষে–মানুষে ভেদকে প্রশ্রয় দেয়না, এখানে স্ত্রী–পুরুষ উভয়কেই জীবনসংগ্রামে সমান দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়৷ বৈধব্য প্রভৃতি সামাজিক কুসংস্কারগুলোকে এখানে কোন মূল্য দেওয়া হয় না৷
রাষ্ট্রীয় তথা সামাজিক আইনের প্রতি আনুগত্যকে এখানে ব্রহ্মের প্রতি আনুগত্যর পরে স্থান দেওয়া হয়৷ কাউকে জাতিচ্যুত করা বা বিধবা মেয়েদের কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদানে অনুমতি না দেওয়া – এ সকল জিনিসের এখানে কোন স্থান নেই৷ আনন্দমার্গ এমন সমাজের পত্তন করছে যেখানে সাধারণ আদর্শ বা তৎসাপেক্ষ সমাজের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে আইন প্রণয়ন করা হয়৷ এই সমাজ অন্য যে কোন জনগোষ্ঠীর সমাজের চেয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কেননা এখানে জাতি–বর্ণগত বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না ব্যষ্টিবিশেষকে জাতিচ্যুত করে তার সংশোধনের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয় না ও মুষ্টিমেয় লোকের স্বার্থের কথা ভেবে আইন তৈরী করা হয় না৷ এ ধরণের সমাজে কেউই দুর্বল বা নিপীড়িত থাকবে না বা কেউই অন্যকে তার ওপর শোষণ চালিয়ে যাবার সুযোগ দেবে না৷ অনেক মনীষী ও অনেক স্মার্ত্তই ইতোপূর্বে এ ধরণের সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ণ দেখেছিলেন বা তদুদ্দেশ্যে প্রচারও করেছিলেন কিন্তু আনন্দমার্গ যেমনভাবে একাধারে চর্তুবর্ণের গুণসমন্বিত মানুষ তৈরী করার মহান ব্রত গ্রহণ করেছে এমন প্রয়াস আর কখনও কারও মধ্যে দেখা যায়নি৷ এ কারণে আনন্দমার্গকে তথা সামাজিক ক্ষেত্রে যদি বিপ্লব আখ্যা দেওয়া যায় তাহলে মানসিক তথা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে একে বৃহত্তর বিপ্লব বলতে হবে৷
(‘‘আনন্দমার্গ – এক বিপ্লব’’, ‘কণিকায় আনন্দমার্গ দর্শন’, তৃতীয় খণ্ড)
সামাজিক নিরাপত্তা ঃ সামাজিক নিরাপত্তার অভাবেও সমাজে ভাঙ্গন দেখা দেয়৷ যে সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদস্যদের নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা নেই সমাজ বেশীদিন স্থায়ী হতে পারে না৷ শৃঙ্খলার অভাবেও সামাজিক নিরাপত্তা বিপর্যস্ত হয়৷ সুতরাং সকলে সমাজের বিধান ঠিকভাবে পালন না করলে সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্ণিত হয়৷ সকলে সমাজের নিরাপত্তার জন্যে যা বিশেষভাবে প্রয়োজন তা হল সুবিচার ও কঠোর শৃঙ্খলা৷
সুবিচার ঃ সামাজিক নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখতে গেলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, জাতিগত তথা স্ত্রী–পুরুষগত কারণে কোন অবিচার থাকতে দেওয়া উচিত নয়৷ অর্থনৈতিক অবিচার মুখ্যতঃ শ্রমের মূল্য না দেওয়ার ফলশ্রুতি৷ সমাজে বৃত্তিগত ভেদাভেদ থেকেই অর্থনৈতিক অবিচারের সৃষ্টি হয়৷ আনন্দমার্গে পরপিণ্ডভোজীর চেয়ে মলাকর্ষীর জীবনকে শ্রেয় মনে করা হয়৷ স্বাধীন জীবিকাকে যে সমাজে এতটা বড় করে দেখা হয় সেই সমাজ থেকে বিভিন্ন প্রকারের অর্থনৈতিক অবিচার দূর হতে বাধ্য৷ অর্থনৈতিক অবিচার ব্যষ্টিবিশেষের স্বাভাবিকী সঞ্চয়বৃত্তি থেকেও এসে যেতে পারে৷ মানুষ যাবতীয় সম্পদ নিজেই ভোগ করতে চায়, কিন্তু যদি তারা এ কথা বুঝতে শেখে যে জগতের সম্পদের ওপর সকলেরই যৌথ অধিকার আছে তাহলে অর্থনৈতিক অবিচার বহুলাংশে হ্রাস পাবে৷ আমাদের মার্গে মনে করা হয়, বিশ্বের যাবতীয় সম্পদ সকলের সাধারণ সম্পদ ও এই সম্পদকে মিলেমিশে ব্যবহার করতে হবে – এই রকম ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ সমাজে অর্থনৈতিক অবিচারের বিশেষ অবকাশ থাকে না৷
স্ত্রী ও পুরুষগত ভেদবুদ্ধি থেকে আরেক ধরণের সামাজিক অবিচার জন্ম নেয়৷ মানুষের সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে পুরুষের চেয়ে হীন মনে করা হয়৷ এই পৃথিবীর বহু অঞ্চলে স্ত্রীজাতিকে পুরুষের ভোগোপাদান বলে গণ্য করা হয়৷ বিশ্বের অনেক তথাকথিত উন্নত দেশেও মেয়েদের সাধারণ নির্বাচনে ভোটাধিকার নেই৷ কোন কোন দেশে নারী জাতিকে আধ্যাত্মিক সাধনার অনুপযুক্ত বিবেচনা করা হয়৷ আমাদের আনন্দমার্গে স্ত্রী–পুরুষ উভয়েরই সমান অধিকার ও দায়িত্ব স্বীকৃত৷ আনন্দমার্গের বিবাহ পদ্ধতিতে পুরুষ ও নারী উভয়কেই সমান দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়৷ এখানে নারী জাতিকে অধ্যাত্ম অনুশীলনে অনুপযুক্ত বিবেচনা করা হয় না৷ পুরুষ ও নারী উভয়কে আনন্দমার্গে সমান দৃষ্টিতে দেখা হয়৷ তাই এখানে পুরষকে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করার কোন প্রশ্ণই ওঠে না৷
তথাকথিত এক বিশেষ জাতির লোকেরা যারা অন্যের চেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে তারা প্রায়ই অপরের প্রতি অবিচার করে বসে৷ হিটলারের তথাকথিত শ্রেষ্ঠ আর্য জাতি কর্ত্তৃক জার্মানী থেকে ইহুদী–বিতাড়ন সমাজে জাতিগত অবিচারের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত৷ ভারতবর্ষে হরিজনদের ওপর তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষদের অবিচারের ফলে সমাজে দারুণ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে৷ এই সকল সামাজিক অবিচার নির্মূল করতে হলে প্রথমেই জাতিভেদের মূলোৎপাটন করতে হবে৷ আমাদের আনন্দমার্গে প্রথম পর্যায়েই যে কোন মানুষকে তার জাতি, বর্ণ বা সম্প্রদায়ের কথা ভুলে যেতে হয়৷ সে আর নিজেকে বিশেষ জাতি, গোষ্ঠী বা বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত বলে পরিচয় দেয় না৷ জাতিভেদ–কলুষিত সামাজিক অনুষ্ঠানে জাতিগত সংস্কারের প্রভাব খুবই প্রবল৷ আনন্দমার্গের সামূহিক অনুষ্ঠানে সব জাতি বর্ণ–সম্প্রদায়ের লোকই সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে৷ বর্তমান সমাজে বিবাহাদির ক্ষেত্রে জাতপাত–সম্প্রদায়– প্রভৃতির ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ কিন্তু আমাদের আনন্দমার্গে এই ধরণের সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না৷ আমাদের আনন্দমার্গে জীবনের শুরুতেই মানবতাবাদের বীজ বপন করা হয় ও সমগ্র মানবসমাজকে একই বৃহৎ পরিবার হিসেবে গণ্য করা হয়৷ তাই এইরূপ সমাজে অর্থনীতিগত, স্ত্রী–পুরুষগত ভেদভাবনা–সঞ্জাত অন্যায়–বিচার বলে কিছু থাকতে পারে না৷......
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আদর্শ সমাজ তখনই গড়ে ওঠে যখন সমাজে ঐক্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এইরূপ সমাজ গড়ার উদ্দেশ্যেই আনন্দমার্গ সাধারণ আদর্শ হিসেবে ব্রহ্মকে গ্রহণ করেছে৷ সামাজিক একতা আনবার জন্যে আমাদের মার্গে জাতিভেদহীন সমাজ–ব্যবস্থার প্রবর্ত্তন করা হয়েছে, চরম দণ্ডকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ জাতি–বর্ণ–সম্প্রদায়্ নির্বিশেষে এখানে সবাই সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে৷ বৃত্তিগত ভেদ, স্ত্রী–পুরুষগত ভেদ বা জাতিগত ভেদকে কেন্দ্র করে কোন সামাজিক অবিচারকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি৷ এছাড়াও সকল প্রকার সামাজিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক কুসংস্কার বর্জন করে, সুশৃঙ্খল বিজ্ঞানসম্মত সাধনাপদ্ধতি প্রবর্ত্তন করে ও শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রগতি ও শাশ্বতী শান্তি প্রতিষ্ঠার উপযোগী সমাজবিধি রচনা করে আনন্দমার্গ আদর্শ সমাজ গড়ার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে৷
(‘‘সামাজিক মনস্তত্ত্ব’’, ‘কণিকায় আনন্দমার্গ দর্শন’, ৩য় খণ্ড)