বন্ধ হোক এই অন্ধ রাজনীতি

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

একটা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই উদ্দাম নিষ্ঠুরতা কেন?  যথার্থ গণতন্ত্রে নির্বাচন জনগণের উৎসব৷ এই উৎসবের মধ্য দিয়েই জনগণ আগামী পাঁচবছরের জন্যে গ্রাম-পঞ্চায়েত পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেবে যোগ্য ব্যষ্টিদের হাতে৷ কিন্তু যোগ্যতার কি নিদর্শন রাখছে রাজনৈতিক দলগুলি!  রাজনীতির উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের সেবা করা৷ নাগরিকদের সুখ-সুবিধা যেমন দেখা দরকার তেমনি রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়ীত্বও থাকে৷ কিন্তু বর্তমান সমাজে রাজনীতি কুক্ষিগত করে নিয়েছে একদল অসৎ দুষ্টচক্র৷ অবশ্যই কেন্দ্রীত পুঁজিবাদী সামাজিক অর্থনৈতিক কাঠামোও এর জন্যে দায়ী৷

গণতান্ত্রিক সরকার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার৷ অর্থাৎ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত ব্যষ্টিরা রাষ্ট্র পরিচালনা দায়িত্ব পাবে ও রাষ্ট্র তথা জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য কাজ করে যাবে৷ এখন প্রশ্ণ জনগণ কাকে নির্বাচিত করলে সুশান পাবে সেই বোধ কি জনগণের থাকে? থাকে না বলেই অসৎ ব্যষ্টিরা রাজনৈতিক দলগুলিতে ভীড় জমায় ও ছলে-বলে কৌশলে ক্ষমতার দখল নিতে চায়৷ তারা জানে যে কোনো উপায়ে একবার জয়ী হতে পারলে জনসেবার নামে পাঁচ বছর  লুটে খাওয়ার দরজা খুলে যাবে৷

তাই পঞ্চায়েত নির্বাচন সামনে আসতেই পলিটিক্যাল দানবেরা জেগে উঠেছে৷ শক্তির দম্ভে, স্বার্থে সংঘাতে, লোভের সংগ্রামে রক্তাক্ত গণতন্ত্রের বেদীমূল৷ মৃত্যুর বিভীষিকা গ্রাস করেছে সেই জনগণকে,যারা নিজের কল্যাণের জন্যে, নিজের বোটে নিজের সরকার নির্বাচন করবে৷

জনসেবায় আত্ম নিবেদিত(!) প্রাণ দানবের কাছে জনগণের প্রাণের কোন মূল্য নেই, মানুষের জীবন তাদের কাছে  খেলার জিনিস৷ ভীরু জনগণের সাহস নেই এই দানবিকতাব বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার৷ স্বার্থাদীপ্ত রাজনীতি ভাইকে ভাইয়ের  কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে, মায়ের কোল শূন্য করে দিচ্ছে৷

প্রাউটের (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব) মতে গণতান্ত্রিক শাসন  ব্যবস্থার প্রধান দুটি সর্তই হলো জন শিক্ষা ও নৈতিকতা৷ এখানে  জনশিক্ষা মানে শুধু আক্ষরিক জ্ঞান নয়, সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা৷ অর্থাৎ যথার্ত ও যথেষ্ট জ্ঞান ও বোধ শক্তিই প্রকৃত শিক্ষা৷ প্রাপ্ত বয়স্ক হলেই একজন যথার্থ জ্ঞান ও বোধ শক্তি অর্জন করতে  পারে না৷  অথচ যথার্থ জ্ঞান ও বোধ শক্তি না থাকলে একজনের পক্ষে যোগ্য রাষ্ট্র পরিচালক নির্বাচন করা সম্ভব নয়৷ তাই সার্থক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শিক্ষা একান্ত আবশ্যক৷ একটি রাষ্ট্রে বা সমাজে কমপক্ষে ৫১ শতাংশ মানুষ যথার্থ জ্ঞান ও বোধ শক্তি সম্পন্ন না হলে যোগ্য ব্যষ্টিরা শাসন ক্ষমতায় আসতে পারে না৷ তাই শুধু প্রাপ্ত বয়স্ক হলেই নয়,  যথার্থ জ্ঞান ও বোধশক্তি সম্পন্ন মানুষেরই বোট দানের অধিকার থাকা উচিত৷

সার্থক গণতন্ত্রের দ্বিতীয় সর্ত অবশ্যই নৈতিকতা৷ নৈতিকতার অভাবেই জনগণের বোট যেমন কেনা বেচা যায়, আবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও  কেনা বেচা যায়৷ একদলের  নির্বাচিত  প্রতিনিধি অর্থ ও ক্ষমতার লোভে নির্লজ্জ্যের  মত অন্ন দলে ভীড়ে যায়৷ একটা সময় ছিল রাজনীতি মানে দেশপ্রেম৷ আজ রাজনীতি বিনা মূলধনের  ব্যবসা৷ সেই ব্যবসার  জমি দখলের লড়াই গ্রামবাঙলার মধ্যবিত্তের ঘরে পৌঁছে গেছে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে৷ বাণিজ্যের মতো রাজনীতিতে ও এখন আমদানি রফতানি ভালো চলে৷ তাই গ্রাম দখলের লড়াইতে এই অমানবিক নিষ্ঠুরতা, উন্মত্ত বর্বরতার প্রকাশ সমস্ত  প্রকার নৈতিকতাকে  বিসর্জন দিয়ে৷

বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাজনৈতিক মতভেদ থাকবেই৷ বিরোধিতাও থাকবে৷ কিন্তু তা এমন হিংস্র বীভৎস হবে কেন?

কোন সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজে শাসন ক্ষমতা দখলের এমন কদর্য লড়াই কখনই জনগণের কল্যাণ করতে পারে না৷ শক্তি মদের এই সাংঘাতিক সংঘাতের অন্তরালে রয়েছে স্বার্থ লোভ ও শাসন-যন্ত্র দখলের আদিম বাসনা৷ সমাজ কল্যাণের সামান্যতম ইচ্ছাও এই রাজনীতিতে নেই৷ যথার্থজ্ঞান, বোধশক্তি ও কঠোর নৈতিক অনুশাসন ব্যতীত সার্থক গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়৷ তাই রাজনৈতিক নেতারা যদি এই অন্ধ রাজনীতি ছেড়ে আধ্যাত্মিক অনুশীলন ও নৈতিক অনুশাসন মেনে চলে তখনই আদর্শ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে৷