সংসদীয় গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রে লোকসভাই হচ্ছে দেশের আয়না স্বরূপ৷ কারণ এই প্রতিষ্ঠানেই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজ্যগুলির উন্নতি–বনতির খতিয়ান পাওয়া যায়৷ তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় লোকসভা নামক প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ আর এই প্রতিষ্ঠানেই সাংসদরা নিজ নিজ রাজ্যের দাবী সনদ পেশ ও তা আদায়ের কাজটি করে থাকেন৷ কিন্তু লজ্জার বিষয় এই যে, দেশের সংসদীয় আবহে বঙ্গজ সাংসদরা কোনদিনই লোকসভার যথাযথ ব্যবহার করতে পারেননি৷ তাই প্রশ্ণ আসছে দেশের অনেক রাজ্যের সাংসদরা (রাজ্যের) দাবী আদায়ে সমর্থ হলেও বঙ্গজরা তা পারছেন না কেন পরিবর্তে দর্শক হিসাবে লোকসভার কার্যক্রম অবলোকন করা ছাড়া বিশেষ কোন ভূমিকায় তাদের উপস্থিতি অনুভব করা যায় না৷
এক্ষণে জানার বিষয় হচ্ছে দেশের লোকসভায় বঙ্গজ সাংসদদের ব্যর্থতার জন্যে বিদ্যা, বুদ্ধি বা রাষ্ট্রীয় জ্ঞানের দৈন্যই কি এর মূলে না তাও নয়৷ কারণ দেশের অন্যান্য রাজ্যের সাংসদদের তুলনায় আমাদের সাংসদরা উক্ত বিষয়গুলিতে বরাবরই অনেক এগিয়ে থাকলেও রাজ্যের স্বার্থ আদায়ে একেবারে পেছনের সারিতে অবস্থান করতে দেখা যায়৷৷ অথচ বিষয়টা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় এই জন্যে যে, দেশের সর্বশক্তিমান প্রতিষ্ঠান লোকসভায় আমাদের সাংসদরা ব্যর্থতার প্রতীক রূপে পর্যবসিত হলেও এ সম্পর্কে রাজ্যের অভ্যন্তরে কোনরূপ প্রতিক্রিয়া ৭৭ বছরের মধ্যে কখনো দেখা দেয়নি৷ প্রশ্ণ হচ্ছে কেন কোনরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটেনি এর উত্তর দেওয়া অত্যন্ত জটিল কাজ৷ কিন্তু এই জটিলতার মধ্যে থেকেও যে বিষয়টা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় তা হচ্ছে, রাজ্যের স্বার্থে নেতা (সাংসদরা) ও জনতা কোন পক্ষই দায়বদ্ধ নয়৷ এখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় উক্ত দুই পক্ষের মধ্যে এক পক্ষ যদি রাজ্যের কাছে দায়বদ্ধ থাকত তাহলে পশ্চিমবঙ্গকে আজ দেউলিয়ার খাতায় নাম লেখাতে হতনা৷ সুতরাং রাজ্যের এই পরিণতির কারণ সমূহের বিচার বিশ্লেষণে গেলে দেখা যায় কেন্দ্র, রাজ্যের সাংসদ ও জনতা সবাই আপন আপন ব্যষ্টিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থসিদ্ধির সুযোগের সদ্ব্যব্যবহারে ব্যস্ত থাকায় কেউই কারও ব্যর্থতা, প্রতারণা, দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে কোনরূপ বিতর্কে যাওয়ার অবকাশ পায়নি৷ এটাই পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য বললে কমই বলা হয়৷
বস্তুত বঙ্গজ সাংসদরা রাজ্যের স্বার্থ রক্ষায় যে ব্যর্থ তা নতুন কোন তথ্য নয়৷ বিষয়টাকে প্রাঞ্জল ভাবে বললে এই দাড়াঁয় স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত ধারার কোনও পরিবর্তন নেই৷ কেননা শুরুতে যেমন তাদের কার্যকলাপ ছিল, আজও তদ্রূপই আছে৷ অর্থাৎ আমাদের সাংসদরা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে হাত মিলিয়ে সেদিন যেমন রাজ্যের স্বার্থকে লোকসভায় উপযুক্ত ভাবে তুলে ধরেননি, আজ ৭৭ বছরের মাথায়ও একই স্থানে তারা অবস্থান করছেন৷ এই অবস্থায় বঙ্গজ সাংসদদের ব্যর্থতার পিছনে যে শক্তি অতি সক্রিয়, তাকে বলা যায় ‘‘বৃশ্চিক গোত্রীয় ভাইরাস৷’’ এই ভাইরাসের মৌলিক চরিত্র হচ্ছে ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থ ছাড়া দুনিয়ার আর কোনও মহৎ গুণের সঙ্গে পরিচয় ঘটতে দেয়না৷ তাই বাঙালী জাতির সার্বিক উন্নয়নের দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গজ সাংসদরা লোকসভায় প্রবেশ করেন কিন্তু উক্ত ভাইরাস ঘটিত রোগের কারণে শেষপর্যন্ত শপথের কথা ভুলে যেতে বাধ্য হয়ে পড়েন৷ ফলে খন্ডিত পশ্চিমবঙ্গের দুর্দশা মোচনে আমাদের সাংসদদের সম্মিলিত তৎপরতা রাজ্যবাসী আজ পর্যন্ত দেখেনি৷ সুতরাং রাজ্যের প্রতি তাদের নেতিবাচক কার্যক্রমের নজির বিশ্ব ইতিহাসে দ্বিতীয় কোন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় কি না তা আমরা বাঙালিকেই এই সন্ধান করতে হবে৷ তা না পারলে ইতিহাসের একটি অধ্যায়ই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে৷
এমতাবস্থায় লোকসভায় আমাদের সাংসদদের কার্যকলাপে –র যে ধারা দেখতে রাজ্যবাসী অভ্যস্ত তা হচ্ছে রাজ্যের প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে কোন গোষ্ঠীর সাংসদরা প্রতিবাদী হ’লে, অপর গোষ্ঠী করে কি –না, রাষ্ট্রিয় শোষণ ও বঞ্চনার সহযোগী হয়ে দাঁড়ায়৷ এই অবস্থায় রাজ্যের সমর্থন পেয়ে রাষ্ট্রশক্তি তার বঞ্চনার গতিকে আরোও তীব্র করার সুযোগ পায়৷ ফলে রাজ্যের ক্রমবর্দ্ধমান সমস্যার সমাধানের পথ বঙ্গজরাই আগলে দাঁড়িয়েছে৷ বলতে কি লোকসভায় এমন নজির আছে, যেখানে রাজ্যের স্বার্থে বিবদমান তিন দলের সাংসদরা এক সুরে দাবী তুলেছেন এই বলে যে, আমরা বিবদমান গোষ্ঠী বটে, কিন্তু রাজ্যের স্বার্থে আমরা এক৷ কারণ রাজ্যের স্বার্থকে রক্ষা করতে না পারলে ক্ষতিটা আমাদের রাজ্যেরই হবে৷ অথচ বঙ্গজ সাংসদদের পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থে উক্তপথের পথিক হতে বাধা তো ছিল না৷ কিন্তু এই মহৎ কাজটি বঙ্গজ সাংসদের দ্বারা সম্ভব হয়নি কেন
লোকসভার মতো সর্ব্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানে বঙ্গজ সাংসদদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সাধারণ রাজ্যবাসীর কিছুই জানা নেই৷ অথচ পশ্চিমবঙ্গকে রাষ্ট্রশক্তি যে বঞ্চনা করছে মোটামুটি ভাবে প্রত্যেক বাঙালীই তা জানেন৷ কিন্তু প্রশ্ণ হচ্ছে ভারবর্ষের সংবিধান একটি ফেডারেল স্টেটের সংবিধান হিসাবেই রচিত, গৃহীত ও প্রচারিত৷ এই কাঠামোর মধ্যেই রাষ্ট্রশক্তি গত ৭৭ বছর ধরে ক্রমান্বয়ে বঞ্চনা করে আসছে, অথচ আমাদের সাংসদরা সম্মিলিত ভাবে রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে কখনো প্রতিবাদী হয়েছেন ৪২জন সাংসদের মধ্যে কখনো বৈয়ষ্টিক ভাবে আবার কখনো ছোট একটি গোষ্ঠীর সাংসদদের প্রতিবাদী হতে দেখা গেছে৷ এই পর্যন্তই৷ এক্ষণে জানার বিষয় এই যে, রাজ্যের স্বার্থে কেন একসঙ্গে ৪২ জন সাংসদ লোকসভায় প্রতিবাদী হননি, রাজ্যের কাছে তারা এর জন্যে জবাবদিহি করবেন কি এমতাবস্থায় যে বিষয়টা আজ পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে তা হ’ল রাষ্ট্রীয় শক্তির এই বঞ্চনার পিছনে রাজ্যের সাংসদদের একটি গোষ্ঠীর সমর্থন আগাগোড়াই কেন্দ্রীয় সরকার পেয়ে আসছে৷ যার ফলে তারা ফেডারেল রাষ্ট্রের আইন কানুনকে অস্বীকার করার ক্ষমতা দেখাতে পারছে৷
সুতরাং আমরা এই সিদ্ধান্তে যেতে পারি যে পশ্চিমবঙ্গের সাংসদরাই বাংলার প্রতি গত ৭৭ বছর ধরে বিশ্বাসঘাতকতা যে করে আসছেন তার নথিপত্রের অভাব নেই৷
এক্ষণে সেই দীপ শিখার আলো এপারের নোতুন প্রজন্মের মধ্যে যদি প্রসার লাভ করে তাহলেই পশ্চিমবঙ্গ আবার তার পুরোনো স্থান পেতেও পারে৷ এপারের বঙ্গজ প্রজন্মের বুদ্ধির মুক্তি ঘটলে শুরু হবে দালাল ও প্রতারক নেতৃত্বের জবাবদিহির পালা৷ এর জন্যেই আমরা বঙ্গজরা আশায় বুক বেঁধে আপেক্ষায় আছি৷
- Log in to post comments