বর্তমান রাজনীতির পঙ্কিল আবর্ত

লেখক
আচার্য অমৃতবোধানন্দ অবধূত

‘‘বাঙলা ও বাঙালী’’র নিজস্ব সমস্যাসহ অন্যান্য সমস্যা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা লোকসভা ও বিধানসভায় উপস্থাপন করলে তো বিষয়গুলোর  দ্রুত ও যথার্থ সমাধান হতে পারতো৷  তবে কেন তারা সরব হন না?’’-আমার ইতোপূর্বে লেখা এক প্রবন্ধের  পরিপ্রেক্ষিতে শ্রদ্ধেয় গোবিন্দ-দার উক্ত জিজ্ঞাসার উত্তরে  আমার এই প্রবন্ধের অবতারণা৷ প্রশ্ণ খুবই স্বাভাবিক হলেও উত্তরটা নিয়ে হয়তো মতানৈক্য থাকতে পারে৷ তবে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ লব্ধ অভিজ্ঞতার  নিরিখে আমার এ মূল্যায়ন৷

প্রথমতঃ কোন বিষয় সমষ্টি স্বার্থের অনুকূল হলেও নেতৃবৃন্দ দলীয় কৌশলের বাহিরে গিয়ে সে বিষয়কে সমর্থন করে’ তাদের নিজস্ব  দলীয় অনুগত্যকে সন্দেহের  চোখে  দাঁড় করার ঝঁুকি নিতে চান না৷ আর এই কৌশলগুলি  নির্ধারিত  হয় যতটা না  জনকল্যাণে তা থেকে অধিক দলীয় রাজনীতির স্বার্থে, ক্ষমতা  ও বোট  ব্যাঙ্কের  দিকে লক্ষ্য রেখে৷ তাঁরা বরং অবলীয়ায় সার্বিক স্বার্থে সময় সময় দলীয় ব্যষ্টি তথা গোষ্ঠী স্বার্থকে য়ূপকাষ্ঠে  বলি দিতে দ্বিধা বোধ করেন না৷  দেশ  ভাগের মধ্য দিয়ে  ক্ষমতা দখলের  সিদ্ধান্তের জন্যে স্বাধীনোত্তর  ভারতের তৎকালীন অদূরদর্শীতা লোভী নেতৃবৃন্দের মধ্যে সেই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন ঘটেছে৷

দ্বিতীয় কারণ পূর্ণাঙ্গ আদর্শ ও যথার্থ নেতৃত্বের  অভাব৷ বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো দূরদর্শিতাপূর্ণ আদর্শ নেতৃত্বের সংকটে ভুগছেন৷ তাছাড়া তাদের হাতে নেই কোনও যুগোপযোগী সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন, যা তাদেরকে যথার্থ পথের দিশা দেখাতে পারে৷

অন্যের উপকার  করতে গেলে চাই একটা অনুভূতিশীল, সংবেদনশীল দরদী মন৷ আর  মন সেই গুণের অধিকারী হয়, জাগ্রত বিবেকের উপস্থিতিতে৷ আর বিবেককে সদাজাগ্রত ও সক্রিয়  রাখতে গেলে চাই  জীবনে সর্বদা নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের  চর্র্চ বা অনুশীলন৷ অন্যথায়  বাগানে কোনও চারাগাছ যেমন জল, সার বা বেড়া প্রভৃতি  পরিচর্র্যর অভাবে অকালে  শুকিয়ে যায়, ঠিক তেমনি আমাদের  মধ্যে ঈশ্বরের দান, বহু উদ্দেশ্য সাধক, মানুষের  পরিচয় বহনকারী  বিবেকরূপ  চারাগাছটাও নীতি ও আদর্শের  চর্র্চর অভাবে আজ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে ক্রমে শূন্যের  কোটায় পৌঁছে  গেছে৷  আজ শুধু রাজনীতিকরাই  নয়, গোটা সমাজের সকলশ্রেণীর মানুষই এই রোগের শিকার৷  তাইতো শুণা যায় ডাক্তাররা শুধুমাত্র তাদের বাড়তি অর্থভাণ্ডারকে স্ফীত করতে সদ্যপ্রসবা সরলপ্রাণা মাকে  মিথ্যা বলে’ তার শিশুটিকে চিরতরে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করে বিক্রি করে দিতো৷ কসাইরা বাড়তি লাভের জন্যে ভাগাড়ের  মৃত পশুর মাংস এনে মাংসলোভী মানুষদের  সরবরাহ  করছে৷ শিশুখাদ্য ও জীবনদায়ী ঔষধে  ভেজাল দেয়া হচ্ছে৷ নারীর জীবন ও দেহ নিয়ে ব্যবসা চালান হচ্ছে৷ এই নর-পিশাচরা হায়নাদের থেকেও বিপজ্জনক৷ এমন  মানুষের দ্বারা পরিচালিত  সমাজে সুশাসনের অবকাশ কোথায়?

১৯২৬ সালে মন্দালয় জেল থেকে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, সমাজ সেবক হরিচরণ বাগদীকে লেখা পত্রে মন্তব্য করেছিলেন (তরুণের স্বপ্ণ)---

‘‘রাজনীতির স্রোত ক্রমশঃ যে রূপ পংকিল হইয়া আসিতেছে তাহাতে মনে হয়, অন্তত কিছুকালের  জন্যে রাজনীতির ভিতর দিয়া দেশের  কোনও বিশেষ উপকার  হইবে না৷  সত্য ও ত্যাগ-এই দুইটি আদর্শ রাজনীতির ক্ষেত্রে যতই লোপ পাইতে থাকে, রাজনীতির কার্যকারিতা  ততই হ্রাস পাইতে থাকে৷ যতদিন  সমাজে বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনে এই রাজনীতি থাকবে,ততদিন ছাত্রদের  মধ্যে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা থাকবে৷ শিষ্টাচার  কর্তব্যবোধ  তাদের  কাছে আশা করা যাবে না৷’’

বর্তমানে বিভিন্ন সময়ে ভারতের  শাসক দলগুলি বিদ্যুৎ দপ্তর  সহ একে একে  বিভিন্ন দপ্তরকে ‘প্রাইবেট সেক্টরের’ হাতে তুলে দিয়ে  তারা দায়িত্ব মুক্ত হচ্ছেন৷ বোট হারাবার  ভয়ে, লোকসভা ও বিধানসভায় স্পর্শকাতর, জনস্বার্থমূলক কোনও বিষয়ে সরাসরি  আলোচনা এড়িয়ে গিয়ে কৌশলে বিচার বিভাগের  ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ বকলমে  বিচার বিভাগই যেন দেশটা চালাচ্ছেন৷ নিকট ভবিষ্যতে তাদের কাজ হবে শুধু নির্বাচন করানো, দেশ-বিদেশ সফর ও সুযোগ বুঝে পকেট ভারী করা৷  লোকসভায় সদস্যদের উপস্থিতির  হার ও অধিবেশনের  দিনসংখ্যাও আজ ক্রমহ্রাসমান৷ ১৯৫০ এর দশকে  লোকসভার অধিবেশন বছরে ১২৭ দিন  বসলেও, ২০১৬তে তা ৭৫ দিনে নেমে এসেছে৷ তার মধ্যেও  বিরোধী  ও সরকার পক্ষের বাকবিতণ্ডায়, কর্মনাশা দিনের সংখ্যা বছরে নহাতই কম নয়৷

আমার দৃঢ় মূল্যায়ন যে বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের জনগণের  দারিদ্র্য, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ও অসচেতনতাকেই পঁুজি করে পৌনপুনিকভাবে  ক্ষমতায়  অধিষ্ঠিত  হচ্ছেন ও টিকে থাকছেন৷