আজকে আমি তন্ত্রের ইতিহাসের একটা অর্দ্ধলুপ্ত কথা বলব৷ প্রায় সকলেই জান যে আদি তান্ত্রিক, মহাকৌল ছিলেন সদাশিব৷ সদাশিবের ব্রত ছিল–‘‘কুর্বন্তু বিশ্বং তান্ত্রিকম্,’’ গোটা বিশ্বকে তান্ত্রিক করে ফেলা৷ তান্ত্রিক মানে, যে মানুষের সমস্ত বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করে জয়ী হয়ে বিশ্বমানবতার মহান বাণী প্রচার করবে৷ মানুষ যে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, সেটা কেবল কথায় নয়, নীতিগত ভাবে নয়, কাজে প্রমাণ করবে৷
সেকালে মানব জাতির বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্কলহ আজকের চেয়েও বেশী ছিল৷ সেকালে, সভ্যতার আদি কালে মানুষ পাহাড়ে থাকত৷ তারপর সভ্যতার অল্প বিকাশ হওয়ার পর তারা সমতলে নেমে এসে বনে–জঙ্গলে থাকতে শুরু করে, কারণ রাত্রিতে পাহাড়ে থাকা সাধারণতঃ বন–জঙ্গলে থাকার চেয়ে বেশী নিরাপদ৷ তাই পাহাড়ের একটা গুহার মধ্যে তারা ঢুকে পড়ত, একটা বড় পাথর দিয়ে গুহার মুখটা বন্ধ করে রাত কাটাত৷ আদিম যুগে তখনও আগুনের আবিষ্কার হয়নি যে গুহার চারিদিকে বা বনে জঙ্গলে যেখানে থাকবে তার চারিপার্শ্বে আগুন জ্বেলে আত্মরক্ষা করবে৷ আগুনের আবিষ্কার হয়েছে পরে৷
তখনকার দিনে মানুষ পাহাড়ে থাকত৷ বৈদিক সংস্কৃতে পাহাড়কে বলা হ’ত ‘গোত্র’৷ ধরো, রাম নামে একটা পাহাড় আছে৷ সেখানে রাম থাকত, তাই তার নাম রামগোত্র৷ শ্যাম নামে একটা পাহাড় আছে৷ সেখানে যারা থাকত তার নাম শ্যামগোত্র৷ এই রকম ব্যবস্থা ছিল৷ আর প্রতি পাহাড়ের গোড়ার দিকে এক–একজন নেত্রী থাকতেন অর্থাৎ গোত্রমাতা৷ তাঁর কথা সবাই মেনে চলত, তাঁর নামেই সবাই পরিচয় দিত–অমুক আমাদের গোত্রজননী৷ আরেকটা পাহাড়ের লোক বলত–আমাদের গোত্রজননী অমুক, ও তদনুযায়ী ওই পাহাড়ের নাম নির্দ্ধারিত হ’ত৷ আজকাল সেটাই গোত্র রূপ কুসংস্কারে এসে দাঁড়িয়েছে৷
গোত্র মানে পাহাড়৷ যে নেতা যে পাহাড়ে বাস করত তার নামানুযায়ী গোত্র নির্দ্ধারিত হ’ত৷ মহর্ষি কাশ্যপ যে পাহাড়ের নেতা তার নাম কাশ্যপ গোত্র৷ মহর্ষি ভরদ্বাজ নেতা তো ভরদ্বাজ গোত্র৷ এই ছিল নিয়ম৷ প্রথম দিকে এক গোত্রমাতা ছিলেন পরে অবশ্য গোত্রমাতার পরিবর্ত্তে গোত্রপিতা হয়ে গেলেন৷ আর সেই গোত্রপিতা অনুযায়ী পাহাড়ের নাম নির্দ্ধারিত হ’ত অর্থাৎ গোত্র নাম নির্দ্ধারিত হ’ত৷ গোত্রপিতা ব্যবস্থায় এক পাহাড়ে যারা বাস করত, তারা যেহেতু এক পাহাড়ে থাকত সেহেতু তারা পরস্পর ভাই–বোন৷ অন্য পাহাড়ের লোকেদের কাছে শত্রু বলে গণ্য হ’ত৷ সেকালে গোষ্ঠী–সংঘর্ষ বড় বেশী ছিল৷ যেহেতু এক পাহাড়ে আছে ভাই–বোন, সেহেতু ভাই–বোনের মধ্যে বিবাহ হ’ত না সেকালে৷ বিবাহের জন্যে তারা কী করত? –না, অন্য পাহাড়ের ওপর আক্রমণ করত ও সেই পাহাড়ের মেয়েদের জোর করে ধরে বেঁধে এনে তারা বিবাহ করত অর্থাৎ দাসী হিসাবে রাখত৷ আর সেই পাহাড়ের পুরুষেরা যারা হেরে গেল তারা ক্রীতদাস হয়ে থাকত৷
তোমরা হয়তো এখনও কেউ কেউ জান যে ছেলে বিয়ের জন্যে শ্বশুর বাড়ী যাচ্ছে, মা জিজ্ঞাসা করছেন, ‘‘বাবা, তুমি কোথায় যাচ্ছ?’’ ছেলে বলছে ‘‘তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি’’৷ মানে, অন্য একটা পাহাড়ে হামলা করে একটা মেয়েকে ধরে আনতে যাচ্ছি৷ দাসী শুধু তাই নয়, বেঁধে আনবার জন্যে দড়ি বা অমনি একটা কিছু রাখত নিশ্চয়ই৷ এখন, সেটাকে গাঁটছড়া বলে৷ আর হাতকড়া দিয়ে আনতে হবে, নইলে মেয়েটা পালিয়ে যাবে৷ তা–ই হ’ল লোহা, এখন নোয়াও বলা হয়৷ হাতে নোয়া বেঁধে দেওয়া হ’ল অর্থাৎ সে বন্দী হ’ল৷ সেকালে মেয়েরাও তো লড়াই করতে পারত ও করতও লড়াই৷ লড়াই করতে গিয়ে মাথা ফেটে যেত, রক্ত বেরুত৷ যেন রক্ত বেরোচ্ছে সেটা দেখাবার জন্যে মাথায় সিন্দুর ঢেলে দেওয়া হ’ল–লাল লাগছে, মাথা ফেটে গেছে৷ এখন সেইটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের কুসংস্কার–যেন সিন্দুর না হলে আর সধবা নারীর সধবাত্বই রইল না৷ কিন্তু তা’ কিছুই না৷ আসলে এসব এক–একটা কুসংস্কার মাত্র৷
আনন্দমার্গে আমি বলেছি, যে যার ইচ্ছে যাবে অলঙ্কার হিসেবে ওটা লাগাতে পারে৷ কোন্ মেয়ে চুড়ি পরবে, কে বালা পরবে তা’ নিয়ে তো আমি কিছু বলব না৷ তেমনি মাথায় কে সিন্দুর দেবে, কে দেবে না, এজন্যে আমি কিছু বলব না কারণ ওটাও তো এক ধরণের অলঙ্কার৷ যার ইচ্ছে যাবে ব্যবহার করবে৷ তোমরা বুঝতে পারছ ব্যাপারটা? কিন্তু আজও মেয়েরা সেই দাসীত্বের কলঙ্ক বহন করে চলেছে, হাতে সেই লোহা বা নোয়া পরে৷ আজও এখানে পরাজিত হয়েছে, হেরে গেছে, রক্ত লেগেছে,–তাই দেখাবার জন্যে সে সিন্দুর পরছে, আজও বিয়ের পরে সে গাঁটছড়া বাঁধতে দিচ্ছে, যেন তাকে বেঁধে আনছে ও আজও সম্পূর্ণভাবে না হোক, কোন কোন ক্ষেত্রে বিয়ে করতে যাবার সময় ছেলে মাকে বলছে, ‘‘তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি’’৷ দাসী আনতে কেন যাবি রে বাবা৷ কেউ কারোর দাস নয়৷ ক্রীতদাস–প্রথা অনেক অগেই শেষ হয়ে গেছে৷ এগুলোর জন্যে তোমাদের প্রতিবাদ করা উচিত৷ এগুলো কুসংস্কার ভিত্তিক জিনিস৷ এগুলো অত্যন্ত আপত্তিকর৷ এইটাই ইতিহাস৷ তোমরা জেনে নাও ভাল করে৷ এরকম হ’ত– গোত্রে গোত্রে লড়াই হ’ত৷ তা’ গোড়ার দিকে গোত্র মাতা ছিলেন, পরে গোত্র পিতা হয়ে গেলেন৷ এই অবস্থায় একজন পুরুষকেই সর্দার করা হ’ত ক্ষলে সেকালে লড়াই–ঝগড়া একটু বেশী হ’ত৷
সেকালে মানব গোষ্ঠীতে মুখ্যতঃ তিনটে শাখা ছিল৷ দক্ষিণভারতে এসে তারা মিশে গিয়েছিল৷ তিনটি শাখাই ভারতের অর্থাৎ একটি অষ্ট্রিক গোত্রীয়–অনার্য, কৃষ্ণকায়–ভারতের আদিবাসী ও আদিবাসীদের একটি বড় অংশের শরীরেও অষ্ট্রিক রক্ত রয়েছে৷ এই বাঙালীরাই অষ্ট্রিক, মোঙ্গোল ও নিগ্রো৷ বাঙালী রক্তে অষ্ট্রিক রক্ত, মোঙ্গল রক্ত, নিগ্রো রক্ত রয়েছে৷ এই তিনটে মিলে বাঙ্লার মানুষ৷ ওই বিশেষ ধরণের তৈরী বলে তাদের একটি বিশেষ ধরণের মানসিকতা আছে৷ আবার চেহারায় একটি বিশেষ ধরণের ছাপও আছে যার’ দেখেই বুঝতে পারা যায়–দেখে বাঙালী বাঙালী মনে হচ্ছে৷ একটা বিশেষ ছাপও এসে যায়, আবার একটা বিশেষ স্বভাবও তৈরী হয়ে যায়, বিশেষ ধরণের রক্তগত সংমিশ্রণের ফলে৷ আবার রক্তগত সংমিশ্রণ যাদের মধ্যে খুব বেশী তারা বেশী বুদ্ধিমান হয়৷ বাঙ্লার মানুষ তাই বুদ্ধিমানও আবার বিশেষ কতকগুলো মানসিক বৃত্তিও থাকে৷ দৃষ্টান্ত স্বরূপ আজকেই বলছিলুম যেমন বাঙ্লার মানুষ নিজে খেলুক বা না খেলুক এরা খেলা–পাগল৷ আর যেমন যাত্রা–পাগল, তেমনি থিয়েটার–পাগল৷ এই কতকগুলো গুণ বাঙলার মানুষের আছে৷ ওগুলো অবশ্য এই কারণেই হয়েছে৷ (ক্রমশঃ)