মুড়ি ও মুড়কি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

মুড়ি ঃ এটি একটি দেশজ ৰাংলা শব্দ৷ হিন্দুস্তানীতে ‘মুড়ি শব্দের অর্থ ৰড় নালী (big drain)৷ উত্তর ভারতের ‘মুড়ি’ শব্দটি পূর্বী মাগধী প্রাকৃতজাত ভাষাগুলিতেও প্রচলিত৷ পশ্চিমী মাগধীজাত ভাষাগুলিতে মুড়িকে ‘ফর্‌হী’ ৰলা হয়৷ ‘মুড়ি’ শব্দটির উদ্ভব নামধাতু থেকে৷ চিৰোতে গেলে যা মুড়্‌মুড়্‌ শব্দ করে তা হ’ল ‘মুড়ি’৷ অষ্ট্রিক ৰাংলায় আর একটি শব্দ রয়েছে তা হ’ল হুড়ুম যার মানে হচ্ছে ভাল খাবার৷ মুড়ি একটি মাঝারি দামের মুখরোচক খাদ্য৷ বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে মুড়ি প্রত্যেকটি তণ্ডুলভোজী দেশেই প্রচলিত৷ ভারতের ওড়িষ্যা, ৰাঙলা, অঙ্গদেশ, ছোটনাগপুর ও কেরলে (মালয়ালামে মুড়িকে ৰলা হয় ‘পোরী’) মুড়ির ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপক৷ অতিরিক্ত মুড়ি খেলে অতিসার রোগের সম্ভাবনা থাকে৷ তবে অত মুড়ি কেউই সাধারণতঃ খায় না৷ মুড়ির কোন সোজাসুজি সংস্কৃত প্রতিশব্দ নেই৷ ভর্জিত তণ্ডুল মানে মুড়িও হয়, চালভাজাও হয় অথচ দু’য়ের তফাৎ অনেক৷ চালভাজা কিছুটা বেশী সুস্বাদু হলেও পেটের পক্ষে ভাল নয়৷ কিন্তু জলে বা দুধে ভিজিয়ে খেলে মুড়ি পেটের পক্ষে ভালই৷ চালভাজা ধান না সেদ্ধ করেও আতপ চাল থেকে হতে পারে অথবা ধানকে একবার সেদ্ধ করে সেই সেদ্ধ চাল থেকেও হতে পারে কিন্তু মুড়ির চালের জন্যে ধানকে দু’বার সেদ্ধ করতেই হৰে৷ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমলে সাহেৰরাও রীতিমত আগ্রহ সহকারে মুড়ি দিয়ে জলখাবার সারতেন৷ মুড়ির তারা নাম দিয়েছিলেন ‘বেঙ্গল বিস্কেট’৷

‘‘মুড়ির সঙ্গে নারকোল আর আদার কুচি,

গপাগপ খাবে দাদা ফেলে দিয়ে লুচি৷

বর্ষাকালে মুড়ির সঙ্গে খেলে কচি শশা,

পাকুই ধরে না পায় গায় ৰসে না মশা৷

শীতকালেতে মুড়ির সঙ্গে খেলে রাঙা মূলো,

সালসার কাজ করৰে দাদা গাল দু’টো হবে ফুলো৷

মুড়ির সঙ্গে তেলেভাজা আহা মরি মরি

যেন পদ্মাসনে রাধা-শ্যামে যুগল মাধুরী৷৷’’

মুড়কি ঃ ‘মুড়ি’ শব্দের উত্তর ৰাংলায় ‘ইকি’ প্রত্যয় করে ‘মুড়িকি’ শব্দটি তৈরী হয়েছে৷ ‘মুড়িকি’ কালক্রমে বিবর্তিত হয়ে ‘মুড়্‌কি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অনুরূপভাবে, চুটি+ ইকি= চুটিকি (তাই থেকে চুটকি’, ভে+ইকি= ভেলিকি (তাই থেকে ‘ভেলকি’) মোট+ ইকি= মোটিকি (তাই থেকে ‘মোটকি’---ঘি রাখবার পাত্র)৷ এককালে গ্রাম-বাঙলায় মুড়কি ছিল মুড়িরই অন্যতম অনুষঙ্গ৷ সাধারণতঃ ধানের খইকে গুড়ের রসে মাখিয়ে মুড়কি তৈরী করা হয়৷ এখো গুড়ের রস দিয়ে মুড়কি তো হয়ই, তাছাড়া তাল গুড়, খেজুর গুড়, চীনীর রস, খেজুর-চীনী ও তাল-চীনীর রসেও মুড়কি তৈরী হয়৷ মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাট অঞ্চলে এককালে উত্তম মানের তাল গুড়ের মুড়কি পাওয়া যেত৷ সেকালকার ৰাঙলার শাদামাঠা জীবনে মুড়ি-মুড়কি ছিল সাধারণ জলখাবার৷ মেয়ের শ্বশুর বাড়ীতেও লোকে মিষ্টান্ন হিসেবে মুড়কি পাঠাতে দ্বিধাৰোধ করত না৷ গ্রাম্য ছড়ায় আছে---

‘‘আম-কাঁটালের ৰাগান দেৰ ছায়ায় ছায়ায় যেতে৷

 উড়কি ধানের মুড়কি দেৰ শ্বাশুড়ী ভোলাতে        (পথে জল খেতে)’’৷৷

                                                (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের লঘুনিরক্ত থেকে সংগৃহীত)