সেই যে গল্প আছে না, একজন বাঙলাভাষী জমিদারের সখ হয়েছিল ঊর্দুভাষী সাজবার৷ থাকতেন তিনি গ্রামে৷ গ্রামের লোককে তিনি বোঝাবার চেষ্টা করতেন যে তাঁর পূর্বপুরুষেরা আসলে উর্দুভাষী ছিলেন৷ বাঙলায় আসার পরে ভাষাতে কিছুটা বাংলা প্রভাব পড়ে গেছে, আসলে তাঁরা উর্দুভাষীই৷
গ্রামের লোকেরা ভয়ে ভক্তিতে সামনে কিছু বলত না৷ আড়ালে বলাবলি করত, এরা চৌদ্দ পুরুষ ধরে তো এখানকারই লোক, বাইরে থেকে আবার এল কবে ভদ্রলোক শেষে হালে পানী না পেয়ে তাঁর ঊর্দু বনেদীপনা দেখাবার জন্যে শহরে একটা বাড়ী কিনলেন৷ শহরের প্রতিবেশীদের বোঝাবার চেষ্টা করলেন তাঁরা পশ্চিমদেশীয় অর্থাৎ উর্দুভাষী, তবে বাংলা ভী থোড়া–বহুৎ জানেন৷ শহরের লোকেরা ভাবলে, হয়তো বা কথাটা সত্যি৷ এমন সময় একদিন জমিদার সাহবের বাড়ীতে একটা শোকাবহ ঘটনা ঘটে যাওয়ায় বাড়ীর মেয়েরা চীৎকার করে মড়াকান্না জুড়ে দিলে৷ জমিদার সাহেবের আশায় গুড়ে বালি পড়ল৷ মেয়েরা কান্না জুড়ে দিয়েছে বাংলা ভাষায়৷
পাড়ার লোকেরা এসে বললে–জমিদার সাহেব, আপনি তো উর্দুভাষী, তবে আপনার বাড়ীর মেয়েরা বাংলা ভাষায় কাঁদছেন কেন?
জমিদার সাহেব বললেন–হ্যাঁ, তারা মন্দ কাঁদছে না গোড়ার দিকে উর্দুতেই কাঁদছিল৷ আমি বললুম তোমরা যদি উর্দুতে কাঁদো বংগাল মুলুকের লোকেরা ভাববে তোমরা উর্দুতে সাদীর গান গাইছো৷ তাই বাংলায় কী করে মড়াকান্না কাঁদতে হয় আমি ওদের শিখিয়ে দিয়ে এলুম৷ তা মন্দ কাঁদছে না, শুণে মনে হবে কোন বংগালীন ঔরৎ কাঁদছে৷ আমার বাড়ীর নোকরানী গফুরের আম্মা যেমন ভাবে কাঁদে, এরাও প্রায় তেমনি ভাবেই কাঁদছে৷
পাড়ার লোক তো শুণে থ’৷ তারা বুঝে নিল জমিদার সাহেব একটি আস্ত মজনতালি সরকার৷ তোমরা মজনতালি সরকারের গল্প জান তো
মজনতালি সরকার ছিল একটি বেড়াল৷ তার সখ গেল, বনেদীয়ানা দেখিয়ে বনের রাজা হবে৷ একদিন রাত্রি তৃতীয় প্রহরে বনের জীবজন্তুরা সবাই বসেছে বন–উন্নয়ন পর্ষদের বিশেষ মীটিংয়ে৷ প্রধান আলোচ্য বিষয়, বনে পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা কীভাবে আরও ভাল করা যায় তাই নিয়ে৷ কুকুর, ছাগল, বাঘ, ভাল্লুক, সবাই আছে৷ সবাই নিজের নিজের বক্তব্য বলে যাচ্ছে৷ সভাপতির চেয়ারটি খালি রয়েছে৷ সিংহ আসতে একটু দেরী করছে কি না৷ এমন সময় মজনতালি সরকার সভাপতির চেয়ারে এসে বসে পড়ল৷ দু’তিন বার ম্যাঁও ম্যাঁও করে শরীর ফুলিয়ে দিলে৷ বন্য জন্তুরা দেখলে, আরে শরীরটাকে বেশ ফোলায় কমায় তো
সবাই বললে–জাহাঁপনা, আপনি কে জাহাঁপনা?
সে বললে–আমি মজনতালি সরকার৷ আমি বনের রাজা৷ এই যে বাঘ দেখছ ও আমার ভাগ্ণে৷ শাস্ত্রে আছে ‘নরাণাং মাতুলক্রমঃ’৷ পুরুষ মানুষকে দেখতে হয় মামার মত, আর মেয়েদের দেখতে হয় পিসির মত৷ তা চেয়ে দেখ না, বাঘের চেহারা কতকটা আমার সঙ্গে মিলেছে কি না? আমি মামা কি না
সবাই দেখলে, সত্যিই তো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটা দেখতে অনেকটা মজনতালি সরকারের মতন৷ সবাই মজনতালি সরকারকে রাজা বলে মেনে নিলে৷ লেট লতিফ* সিংহকে আর রাজা বলে মানছি না৷
মজনতালি সরকারের সভাপতিত্বে বন উন্নয়ন পর্ষদের মীটিং ভাল ভাবেই হল৷ ঠিক করা হ’ল, দশ কোটি নূতন বৃক্ষ লাগানো হবে৷ আগামী বৎসর ওই দশ কোটির মধ্যে যে ন’ কোটি গাছ মরে যাবে সেই শূন্যতা পূরণের জন্যে যাদের কন্ড্রাক্ট দেওয়া হবে তারাই বিনা মূল্যে পানীয় জল সরবরাহ করবে৷ এরপর মজনতালি সরকার বললে–তোরা দেখছি সবাই ছোট ছোট জানোয়ার৷ আমার চাপরাশি আর্দালীর কাজের জন্যে দু’একটা বড় জানোয়ার দরকার৷
সবাই বললে–আমাদের জঙ্গলে ঐরাবত হচ্ছে সব চেয়ে বড় জানোয়ার৷ দু’চারটা ঐরাবত আপনার কাছে পাঠিয়ে দোব৷
মজনতালি সরকার বললে–দেখব সে কত বড় জানোয়ার৷ বনের জানোয়ারা ক্যানেস্তারা টিন পেটাতে লাগল৷ আওয়াজ শুনে হাতীরা ছুটোছুটি শুরু করে দিলে৷ একটা প্রকাণ্ড ঐরাবতকে ছুটে আসতে দেখে মজনতালি সরকারের আর গাছের ওপর থাকতে ভরসা হল না যদি ঐরাবতের প্রচণ্ড ধাক্কায় গাছটা পড়ে যায় তবে মজনতালি সরকারের সঙ্গে সঙ্গে ভূমিসমাধি হবে৷ মজনতালি সরকার তখন একটা বট গাছের শিকড়ের তলে আশ্রয় নিলে৷ ঐরাবতের পা বড়বি তো পড় শিকড়ের ওপর পড়ল৷ হাতীর পায়ের চাপে শিকড়টা মজনতালি সরকারের পেট চেক্টে দিলে৷ মজনতালি সরকারের পেট ফেটে গেল৷ তার তখন শেষ অবস্থা৷
এদিকে বনের জানোয়াররা তাদের রাজাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে৷ কোথায় রাজাবাহাদূর, কোথায় রাজাবাহাদূর শেষ পর্যন্ত তারা রাজা–বাহাদূরকে খুঁজে বের করলে৷ রাজ্য বাহাদূরের তখন অন্তিম দশা৷ তারা কাঁদতে কাঁদতে মজনতালি সরকারকে বললে ‘রাজা–বাহাদূর, আপনার এ দশা কে করলে?’
খাবি খেতে খেতে মজনতালি সরকার বললে– তোদের আমি কী অর্ডার করেছিলুম? আমি বলেছিলুম একটা বড় জানোয়ার আনতে৷ আর তোরা কি না পাঠালি ঐরাবতের মত একটা ছোট্ট জানোয়ারকে৷ প্রথমে তো তাকে দেখে বড় রাগ হ’ল৷ পরে এত হাসি পেল যে হাসতে হাসতে আমার পেট ফেটে গেল৷ মজনতালি সরকার মরে গেল৷
* স্বভাবগত ভাবে যে মানুষ কোথাও পৌঁছুতে বিলম্ব করে ভারতীয় ইংরেজীতে তাকে বলে ‘লেট লতিফ’৷