দেশটার নাম ভারতবর্ষ৷ ভারত শব্দটার উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক আছে৷ কেউ কেউ বলেন ভরত নামে এক রাজার নাম থেকে ভারত নামটা এসেছে৷ তবে অনেকে এটা মানতে চান না৷ তাদের যুক্তি ভরত নামের রাজা তো ভারতের রাজা ছিলেন, অর্থাৎ ভরত রাজা হওয়ার আগে থেকে দেশটার নাম ভারতবর্ষ৷ তাই ভরত নামের রাজার নাম থেকে ভারতবর্ষ নাম হয়েছে এটা যুক্তিযুক্ত নয়৷ এই মতের পক্ষে যারা তাঁরা কোন ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ তুলে ধরতে পারেনি৷
ভারতবর্ষ নাম প্রসঙ্গে মহান দার্শনিক প্রাউট প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন--- ‘ভর’ ধাতু থেকে ভার শব্দ এসেছে, যার মানে যে বা যিনি ভরণ পোষণ করেন বা যে স্থানে ভরণ-পোষনের পূর্ণ সুযোগ আছে৷ ‘তন’ ধাতু থেকে ‘ত’ শব্দ এসেছে যার মানে যে স্থানে মানসিক বিকাশের সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা আছে৷ তাই ভারত শব্দটার অর্থ হচ্ছে যে স্থানে ভরণ-পোষণের অর্থাৎ জীবিকা নির্বাহের সবরকম সুযোগ সুবিধা আছে আবার মানসিক বিস্তারের যথেষ্ট সুযোগ আছে৷ যাযাবর আর্যরা যখন দেখলেন এই জায়গাটা বসবাসের উপযুক্ত স্থান--- অর্থাৎ এখানে ভরণ পোষণেরও অভাব হবে না, আবার মানসিক বিকাশের উপযুক্ত স্থান--- তখন আর্যরা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে ও জায়গাটার নাম রাখে ভারত৷ বর্ষ শব্দের অর্থ দেশ তাই দেশটার নাম হয় ভারতবর্ষ৷
যদিও এখানে আলোচ্য বিষয় আজকের ভারতবর্ষ নিয়ে যে ভারতবর্ষকে আজ কেউ কেউ হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান বানাতে চাইছে৷ ভারত নামের উৎপত্তি যেখান থেকেই আসুক গোটা ভারতবর্ষ কখনই হিন্দুস্থান নয়৷ এক সময় ভারতবর্ষ কতকগুলি সুবায় ভাগ ছিল৷ সুবা বাঙলা, সুবা পঞ্জাব, সুবা হিন্দুস্থান প্রভৃতি৷ তাই গোটা ভারতবর্ষ কখনই হিন্দুস্তান নয়, হিন্দুস্থান ভারতের মূলত সিন্ধু উপত্যকা ও তার পার্শ্ববতী কিছু কিছু অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল যা আজকের উত্তর পশ্চিম ভারতের মধ্যে পড়ে৷
ভারতবর্ষ কোন একটি বিশেষ ভাষা একটি বিশেষ মতবাদের দেশ কখনই ছিল না৷ ভারতবর্ষ নানা ভাষা কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির একটি দেশ---একটি যুক্তরাষ্ট্র৷ কবির কথায়--- ‘‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান
বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান৷’’
এই কারণেই ভারতবর্ষকে বলা হয় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য৷ আজ বৈচিত্র্যের বৈশিষ্ট্যকে বিলিন করে কেউ যদি একের দোহাই দিয়ে ঐক্যের প্রয়াস করে তবে তার পরিণতি সুখকর হবে না৷ মনে রাখতে হবে উর্দুকরণ করতে গিয়ে পাকিস্তান ভেঙেছে৷ রুশিকরণ করতে গিয়ে সোভিয়েত ইয়ূনিয়ন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে গেছে৷ আবার দুই মতবাদের প্রভাবে দুই জার্র্মন পৃথক হয়ে বেশীদিন থাকেনি৷ কারণ ভাষা কৃষ্টি-সংস্কৃতির দিক দিয়ে তারা এক৷ দুই বিরুদ্ধ মতবাদ তাই বিদ্যুৎ প্রবাহিত কাঁটা তারের বেড়া, বিভেদের প্রাচীর তুলেও পৃথক রাখা যায়নি৷ বিভেদের প্রাচীর গুঁড়িয়ে দিয়ে তারা মিলে গেছে৷ ইতিহাসের শিক্ষা না নিয়ে কেউ যদি ভারতবর্ষকে কোন একটি ভাষা, কোন একটি মতবাদ--- সে ধর্মীয় ও অথবা রাজনৈতিক যাই হোক---চাপিয়ে দিয়ে এক করতে চায় ফল বিপরীত হতে বাধ্য৷ চোখের সামনে সোভিয়েত ইয়ূনিয়ন জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত৷
ভারতবর্ষ মানে বাঙালী অঙ্গিকা, মৈথিলী, ভোজপুরী, উৎকল, কোশল, বুন্দেলী, বাঘেলী, পঞ্জাবী, তামিল, তেলেগু, মালায়ালম....প্রভৃতি ৪৪জনগোষ্ঠীর দেশ৷ এই ৪৪টি জনগোষ্ঠী যেদিন প্রত্যেকের ভাষা কৃষ্টি সংস্কৃতির সম মর্যাদা নিয়ে বলতে পারবে, ভারত আমার ভারতবর্ষ---সেদিনই ভারতের সংহতি সুদৃঢ় হবে৷ অন্য কোন পথ নেই৷
মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর অর্থনৈতিক তত্ত্ব---প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বে সকল স্তরের সর্বশ্রেণী মানুষের সার্বিক বিকাশের দিকে লক্ষ্য রেখে অঞ্চল ভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার পথ দেখিয়েছেন৷ অর্থনৈতিক সমস্যা ও সম্ভাবনা অনুযায়ী, ভৌগোলিক অবস্থান জল হাওয়া ও জনগোষ্ঠীগুলির নৃতাত্ত্বিক ও ভাষা কৃষ্টি সাংস্কৃতিক পরিচয় অনুযায়ী একেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার পরিকল্পনা দিয়েছেন৷ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলেই প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি সুদৃঢ় হবে৷
- Log in to post comments