ভারতে গণতন্ত্রের প্রহসন

লেখক
কৃষ্ণমোহন দেব

(পূর্বপ্রকাশিতের পর)

বিহারের পূর্ব মুখ্যমন্ত্রী শ্রীলালু যাদব ও তার কিছু অফিসার মিলে  গো-খাদ্যের কোটি কোটি টাকা আত্মস্যাৎ করেছিলেন৷ তাহা বিরোধী গোষ্ঠীর-দ্বারা প্রকাশ্যে আসে ও বিচারালয়ে আনা হয়৷ মিডিয়া এ ব্যাপারে লালু যাদবকে জিজ্ঞাসাবাদ প্রসঙ্গে বলেছিলেন--- যে ‘এই চারা ঘোটালাতে তো আপনার বদ্‌নাম হয়ে গেল এর ফলে আপনার বোটার (ভোটার) গণ তো বিমুখ হয়ে যাবে, আপনার বোট (ভোট)  কমে যাবে৷’ এর উত্তরে শ্রীলালু যাদব কোনরকম দ্বিধা না করে বলেছিলেন যে ---আমার বোটারগণ খবরের কাগজ পড়ে না আর অনেকে পড়তে জানে না৷ আবার কয়েক জন পড়ে তো ঘোটালা কি তা বুঝে না আর কেউ যদি বোঝে, সে বিশ্বাস করবে না যে আমি এমন কাজ করতে পারি, তারা বুঝবে যে আমাকে বদ্‌নাম করার জন্য করা হয়েছে৷’’ লালু যাদবের রাজনীতি ছিল ‘ফুট (বিভেদ) ডাল আর রাজকর’--- তাঁর কোন সংশ্লেষণাত্মক নীতি ছিল না৷ তাঁর রাজনীতি ছিল ফরওয়ার্ড (উচ্চবর্গ) ও ব্যাকওয়ার্ড (নিম্নবর্গ) এর রাজনীতি৷ বিহারে ফরওয়ার্ড মানে হল যারা ভূমিহার, রাজপুত ব্রাহ্মণ ও লালা (কায়স্থ) সংক্ষেপে লালু যাদব বলতেন ‘ভুরা বাল’ ৷ বলতেন ‘ভুরাবাল’ সাফ্‌ করো৷ লালুজীর দেশগড়ার কোন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্ব নেই৷ এই ফরওয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ডের বিভেদের সেন্টিমেন্ট দিয়ে দীর্ঘদিন বিহারে ক্ষমতায় থেকে গেছেন৷ চারা ঘোটালাতে  অভিযুক্ত হওয়ায় নিজের অল্পশিক্ষিত স্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী রেখে ব-কলমে শাসন কাজ চালিয়ে ক্ষমতা ভোগ করেছেন৷ এ হল আর এক গণতন্ত্রের প্রহসন৷ ভারতের স্বনাম ধন্য ব্যষ্টিগণ মিলে দীর্ঘ তিনবছর ধরে যে বৃহত্তর সংবিধান রচনা করেছিলেন অনেক উচ্চ আশা রেখে, সেইগণতন্ত্রের এই সব পরিণাম৷

পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম-এর নীতি ছিল সংগ্রামের নামে গুণ্ডা ও বদমায়েসদের দ্বারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ক্ষমতাকে ধরে রাখা৷ আর মোদী অমিত শাহ ও বিজেপী পার্টির নীতি হল যে জনগণের মন মোহিত করা প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলা আর যে প্রদেশের ক্ষমতাকে  কুক্ষীগত করতে হবে সে প্রদেশের জন্য বিভিন্ন খাতে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ করে দেওয়া৷ রূপায়ন না হলে তো জনগণের কাছে কোন কৈফিয়ত দেওয়ার ব্যবস্থা ভারতের গণতন্ত্রে নেই আর সে জন্য  জনগণের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কিছুই করার ক্ষমতাও নেই৷ যেমন মোদিজী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিদেশের কালো টাকা আনবেন কিন্তু তা তো আনতে পারেন নি৷ এরজন্য জনগণ কি কিছু ব্যবস্থা নিতে পেরেছে?

মোদী-অমিতশাহরা মাস সাইকোলজি বুঝে গেছেন যে জনগণকে  বোকা বানানো সহজ আর নির্বাচনে জয়ী হওয়া কোন কঠিন ব্যাপার নয়৷ যেমন লালুজী জানতেন যে তাঁর বোটাররা কোন খবরাখবর রাখে না ও অত তলিয়েও দেখে না, তেমনি চালাক মোদী ও অমিতশাহরা বুঝে গেছে যে জনগণের মনে সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য-এমন বিশ্বাস গড়ে তোলা খুবই সহজ ব্যাপার৷ আর ও ছাড়া তো আছে ওদের টাকার খেলা, ও বাহ্যিক চাক্‌ চিকিতের -বেশভূষার প্রদর্শন, মিটিং মিছিলে জমজমাট ‘শো’৷ যে পার্টি কোটি কোটি টাকা দিয়ে---এম.এল-এ ও এম-পি-দের খরিদ করে নেয়, সেই পার্টি গ্রাম্য ও সাধারণ মানুষদের -টাকায় খরিদ করে নেওয়া কি কঠিন ব্যাপার? খুবই সহজ৷ পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯ এর সাংসদ নির্বাচনে একেবারে ১৮ জন সাংসদ সীটে বিজেপির জয়ী হওয়া ছিল টাকার  খেলা ও মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া৷ আর জনগণকে বিভ্রান্ত করা৷ মোদীকে রাজবেশে মিটিং এ ভাষন দান করতে দেখি যার ফলে সাধারণ সরল সহজ মানুষের মনে ছাপ পড়ে যায় যে মোদিজী এক অসাধারণ মানুষ রাজস্তরের মানুস, জনগণের ভাবে যে অন্যসব নেতাদের থেকে অনেক উচ্চস্তরের নেতা৷ ডাঃ মনমোহন সিং তার দশবছরের প্রধানমন্ত্রিত্বে যত না দেশ ভ্রমণ করেছেন মোদীজী পাঁচ বছরে তার চারগুণ দেশ ভ্রমণ করেছেন আর মনমোহন সিং-এর ভ্রমণে যত না খরচা হয়েছে মোদীজীর ভ্রমণে পাঁচ বছরেই তার কয়েক কয়েক গুণ বেশি অর্থ খরচ হয়েছে৷ গণতন্ত্র শাসনব্যবস্থায় মোদীজীর তো রাজকীয় ব্যাপার৷

উল্লেখযোগ্য যে মমতার শাসন ক্ষমতায় আসাটা অন্যান্য নেতাদের মত কপট বা ছল চাতুরীতে লাভ করেছেন? একেবারেও নয়৷ কারণ মমতাদেবী জনগণকে কোন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বা ছল চাতুরী করে শাসন ক্ষমতায় আসেন নি৷ সিপিএম-এর অত্যাচারে জনগণ অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল৷ কেন্দ্রে কম্যুনিষ্টদের সমর্থনে ছিল কংগ্রেস সরকার৷ তথাকথিত প্রদেশ কংগ্রেস পার্টির নেতাগণ জ্যোতিবায়ু বুদ্ধদেব বাবুর কাছ থেকে নিজের সুযোগ সুবিধা লাভ করেই সন্তুষ্ট ছিল৷ আর পশ্চিমবঙ্গের জনগণের ওপর সি.পি.এম-এর  অত্যাচার ব্যাপারে কংগ্রেস নেতাগণ উদাসীন ছিলেন৷ নির্যাতীত জনগণের কাছে গিয়ে মমতা দাঁড়িয়েছিলেন৷ তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারায় কংগ্রেস ত্যাগ করে নোতুন পার্টি তৃণমূল করে আন্দোলনে নামেন সিপিএমের অত্যাচারের বিরুদ্ধে৷ সিপিএম সরকার ও তাদের গুণ্ডাদের দ্বারা নানানভাবে নির্যাচিত হয়েছেন ও মৃত্যুর দোর গড়া থেকে ঈশ্বরের কৃপায় বেঁচে উঠেছিলেন৷ সিপিএম-এর দ্বারা অত্যাচারিত জনগণ আর দীর্ঘদিনের সিপিএমের শাসনে বিরক্ত বুদ্ধিজীবিগণ মমতাকে সমর্থন করেন৷ ফলে মমতা শাসন ক্ষমতায় আসেন৷ তিনি তাঁর শাসনব্যবস্থায় নোতুন ধরনের পরিকল্পনা রূপায়ন করেছেন---যেমন -সবুজসাথী, স্বাস্থ্যসাথী কন্যাশ্রী রূপশ্রী প্রভৃতি যা বিশ্বের দরবারে প্রশংসিত৷ অ্যারিস্টটল যে নিয়মতান্ত্রিক শাসনের কথা বলেছেন মমতার শাসন কিছুটা নিয়ম-তান্ত্রিক বলা চলে৷

মোদীজী ও অমিতসাহ আর বিজেপি পার্টির লোকেরা এসে বাঙলার মানুষকে বিভ্রান্ত করছে যে বাঙলার কোন বিকাশ হয়নি৷ বিজেপি ক্ষমতায় এলে বিকাশ করবে আর সোনার বাঙলা গড়ে তুলবে৷ কী ধরনের কপট প্রতিশ্রুতি৷ বাঙালী সেটা বুঝেছিল, তাই আবার বাঙলার মানুষ মমতাকেই  বেছে নিয়েছে৷ বাঙালী জাতির হয়ে মোদী অমিত শাহ ও ইনাদের পার্টিকে বলছি যে বাঙলার প্রতি এত দরদ উঝলে পড়েছে তো ঝাড়খণ্ডে ৬৭ শতাংশ বাঙালী মাহাতোদের বাদ দিয়ে যারা হল আদি বাঙালী তা সত্ত্বেও ঝাড়খণ্ডের প্রথম রাজ্য ভাষা বাংলা হয়নি কেন৷ এই বিজেপি পার্টিই ঝাড়খণ্ডে হিন্দিকে রাজ্যভাষা করেছে  ও ঝাড়খণ্ডে বাংলা ভাষাকে দাবিয়ে রাখা হয়েছে৷ সংবিধানে যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে অধিকাংশ মানুষের ভাষাই হবে মূল রাজ্যভাষা৷ বাঙালীদের হিন্দি পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে৷ ইংরেজ রাজত্বে এমনটি ছিল না৷

গত বিধান সভা নির্বাচনে বাঙলার মানুষকে মোদী ও বিজেপি পার্টির লোকেরা বিভ্রান্ত করেছেন যে বাঙলায় কোন আইনশৃঙ্খলা নেই৷ বাঙলার সাধারণ মানুষ তো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির আইন শৃঙ্খলার দুর্দশার খবর রাখার ক্ষমতা নেই এটা মোদীজী অমিত শাহ ভালভাবে বুঝেন৷ তাই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বাংলার সাধারণ সরল মানুষদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলেন৷ পশ্চিমবঙ্গের  রাজ্যপাল বিজেপি পার্টির ক্যাডার৷ তিনি রাজ্যপাল হয়েও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার শিষ্টাচারটুকুও ধার ধারেন নি৷ অথচ উত্তর ভারতে বিজেপী সরকারের রাজ্যে নির্ভয়া কাণ্ডের মত দু’দুটা ঘটনা ঘটে গেছে আর সেই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে এসে আইন শৃঙ্খলা নেই বলছে৷ এমন কথা বলতে নির্লজ্জে রাও কিন্তু কিন্তু করবে৷